বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

স্বজন জ্ঞাতিদের প্রাণহরণের চক্রান্ত ব্যর্থ করে গৃহচ্যুত পঞ্চপাণ্ডব, মা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে, রাতের অন্ধকারে, গোপণে, বারণাবত পরিত্যাগ করে এগিয়ে চললেন। দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম, চার ভাই ও মাকে বহন করে, বায়ুবেগে, এগিয়ে চললেন। লক্ষ্য হল দূরত্ববৃদ্ধি। শত্রুদের নাগালের বাইরে যাওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য। এইভাবে গঙ্গাতীরে পৌঁছলেন তাঁরা। পরম হিতাকাঙ্খী মহাত্মা বিদুরের ব্যবস্থাপনায়, সুগঠিত কলের নৌকায়, গঙ্গা নদী উত্তীর্ণ হলেন মাতাসহ পাণ্ডবভায়েরা।

রাত্রি প্রভাত হলে বারণাবতবাসীরা পাণ্ডবদের দগ্ধগৃহে সমবেত হলেন। তাঁরা জতুগৃহের আগুন নির্বাপিত করে, ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনকেই, এই দহনের কারণ হিসেবে, বিরূপ সমালোচনায় মুখর হলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে, দুর্যোধন, পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারতে সাহসী হয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারেই পাণ্ডুর উত্তরাধিকারীদের দগ্ধ করেছেন ধৃতরাষ্ট্রপুত্র। ধৃতরাষ্ট্র, এ বিষয়ে অসম্মতি জানাননি। সমবেত জনতার এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। বিদিতে ধৃতরাষ্ট্রস্য ধার্ত্তরাষ্ট্রো ন সংশয়ঃ। দগ্ধবান্ পাণ্ডুদায়াদান্ ন হ্যেনং প্রতিষিদ্ধবান্।।

বারণাবতবাসীরা, ভীষ্ম সম্বন্ধেও ছেড়ে কথা বললেন না। ভীষ্ম অধার্মিক। দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, বিদুর এবং অন্য মুখ্য কৌরবগণ, প্রত্যেকেই ধর্মবিরুদ্ধ আচরণ করেছেন। ক্রুদ্ধ বারণাবতবাসীরা ধৃতরাষ্ট্রকে খবর পাঠালেন। সংবৃত্তস্তে পরঃ কামঃ পাণ্ডবান্ দগ্ধবানসি। আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। পাণ্ডবরা দগ্ধ হয়েছেন। পাণ্ডবদের দগ্ধ দেহাবশেষ খুঁজলেন তাঁরা। দগ্ধ জতুগৃহে, আশ্রিত মদ্যপ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দগ্ধ ব্যাধপত্নী এবং তাঁর পাঁচ পুত্রের দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। বিদুরপ্রেড়িত ক্ষণক, যিনি পাণ্ডবদের পলায়নের রাস্তাটি মাটি দিয়ে গুপ্ত রেখেছিলেন, তিনিও দগ্ধগৃহ পরিষ্কার করবার সময় আবারও সেই গর্ত ও সুরঙ্গটি মাটি দিয়ে গুপ্ত রেখে দিলেন।
ধৃতরাষ্ট্র খবর পেলেন, পঞ্চপাণ্ডব অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। সেই সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন কৌরবদের বিশ্বস্ত মন্ত্রী পুরোচন।পাণ্ডবদের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকে বিলাপরত অবস্থায় বললেন, অদ্য পাণ্ডুর্মৃতো রাজা মম ভ্রাতা মহাযশাঃ। তেষু বীরেষু দগ্ধেষু মাত্রা সহ বিশেষতঃ।। আজ প্রকৃত অর্থেই মৃত্যু হল আমার ভাই মহাযশস্বী পাণ্ডুর। কারণ তাঁর বীর পুত্ররা, তাঁদের মায়ের সঙ্গে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিলেন কুলের নিয়ম অনুসারে বারণাবতে তাঁদের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হোক। হয়তো আরও মহান হওয়ার চেষ্টা ছিল তাঁর। এবং গতে ময়া শক্যং যদ্ যৎ কারয়িতুং হিতম্। পাণ্ডবানাঞ্চ কুন্ত্যাশ্চ তৎ সর্ব্বং ক্রিয়তাং ধনৈঃ।।

পাণ্ডব এবং কুন্তীর মঙ্গলার্থে আমার যেসব নির্ধারিত অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন, তা আমি করব। এরপরে সপুত্র ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্মসহ কুরুমুখ্যরা, নিরালঙ্কারদেহে, একবস্ত্রাবৃত হয়ে, বিষণ্ণমনে, উষ্ণীষ ত্যাগ করে মরণোত্তর তর্পণাদি সম্পন্ন করবার জন্য গঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কেউ যুধিষ্ঠির, কেউ বা ভীম, কেউ ‘হায় অর্জুন’ বলে, আবার কেউ কেউ নকুল সহদেবের নাম উচ্চারণ করে শোক প্রকাশ করতে লাগলেন। শুধু রাজকুলের সদস্যরাই নন পুরবাসীরাও শোকাতুর হয়ে উঠলেন। শুধু বিদুরস্ত্বল্পশশ্চক্রে। শোকং বেদ পরং হি সঃ। বিদুরের শোকের প্রকাশ অল্প। শুধু তিনিই জানতেন জতুগৃহের অগ্নিদহন থেকে পাণ্ডবদের পরিত্রাণবৃত্তান্ত।

পাণ্ডবরা গঙ্গা নদী উত্তীর্ণ হয়ে রাতের নক্ষত্র দেখে পথ চিনে নিলেন। ক্রমশ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন তাঁরা। শেষে এক গভীর বনে উপস্থিত হলেন পঞ্চপাণ্ডব। ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত, পাণ্ডবভায়েরা আবার ভীমের শরণাপন্ন হলেন। ইতঃ কষ্টতরং কিন্নু যদ্বয়ং গহনে বনে। দিশশ্চ ন বিজানীমো গন্তুঞ্চৈব ন শক্নুমঃ।। এর থেকে কষ্টকর আর কি হতে পারে। আমরা এই গহন বনে দিক চিনতে পারছি না। আমরা সকলে এখন গমনেও অক্ষম। আক্ষেপ করে বলতে লাগলেন, পুরোচনের কী হল? তাও অজ্ঞাত রয়ে গেল। সকলের অগোচরে তাঁরা কীভাবে ভয়মুক্ত হবেন? সে উপায়ও তাঁদের জানা নেই।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা

যুধিষ্ঠির, ভীমকে অনুরোধ জানালেন, পুনরস্মানুপাদায় তথৈব ব্রজ ভারত!। ত্বং হি নো বলবানেকো যথা সততগস্তথা।। হে ভরতবংশীয় ভীম, তুমি আমাদের মধ্যে সতত গতিশীল বায়ুর মতো, তুমি আমাদের আবার সেইভাবেই বহন করে নিয়ে চলো। জ্যেষ্ঠর অনুরোধে, ভীম, চার ভাই ও মাকে বহন করে নিয়ে চললেন। সদ্য যৌবনে উপনীত, গর্বিত, মদগর্বে দর্পিত, প্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থিতি জানতে পেরে, ক্রুদ্ধ, হস্তীশ্রেষ্ঠ যেমন আচরণ করে, তার মতোই ফুলপাতা, ফলবান বৃক্ষ, লতাগুল্ম ভেঙ্গে এগিয়ে চললেন ভীম। গরুড় ও বায়ুর মতো বেগবান ভীমের গতিবেগে পাণ্ডবদের যেন জ্ঞান হারানোর উপক্রম হল। বহু নদী পার হয়ে, গাছপালা গুল্ম লতায় ভরা উঁচু নিচু, নদীর তীরে অতি কষ্টে কোমলাঙ্গী দেবী কুন্তীকে বহন করে নিয়ে চললেন ভীম।

অবশেষে সন্ধ্যাকালে উপস্থিত হলেন, ফলমূল ও পানযোগ্য জল আছে এমন একটি হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে। ঘোর সন্ধ্যায়, ভয়ানক বন্যপশু ও পাখিরা চারিদিকে বিচরণরত অবস্থায় দৃশ্যমান হল। হঠাৎ ধেয়ে আসা বায়ুতে উড়ল শুকনো পাতা, টপটপ করে ফল ঝরে পড়তে লাগল। গাছের ছোট, বড় ডাল ভেঙ্গে পড়ল। নানা গাছ, বায়ুবেগে যেন ঘূর্ণি হয়ে চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেলল। ভীমবিনা চার পাণ্ডবভাই, পথশ্রমে ক্লান্ত, পিপাসার্ত হয়ে নিদ্রাতুর অবস্থায় চলার শক্তি হারালেন। সকলে মিলে ভয়ানক সেই বনমধ্যে প্রবেশ করলেন।

পঞ্চপান্ডবের মাতা তৃষ্ণাতুর হয়ে পুত্রগণকে বারবার বললেন, তৃষ্ণয়া হি পরীতাস্মি ভৃশমথাব্রবীৎ। প্রবল তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাতর হয়ে পড়ছি আমি। ভীমসেন, মাতৃস্নেহের করুণাধারায় আকুল হয়ে জল আনবার উদ্যোগ নিলেন। বিজন বনের গভীরে প্রবেশ করে, ভীমসেন, বিশাল একটি বটগাছ দেখতে পেলেন। তিনি সকলকে প্রবোধ দিয়ে বললেন,জলের সন্ধানে তিনি যাচ্ছেন ততক্ষণ সকলে বিশ্রাম করুন। জলচর সারসপাখীদের কলকাকলিতে মুখর স্থানটি।

ভীমসেন অনুমান করলেন, নিশ্চয়ই কাছেই জলাশয় আছে। যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে, সারসদের কূজনে মুখর, স্থানটিতে গমন করলেন তিনি। প্রাণভরে স্নান ও জল পানে তৃপ্ত, ভ্রাতৃবৎসল ভীম, প্রত্যেক ভাইয়ের জন্যে, জল পৃথকভাবে পদ্মপাতায় বেঁধে নিলেন। উত্তরীয়তে সেগুলি নিয়ে দুইক্রোশ দূরে মা ও ভাইদের কাছে উপস্থিত হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম।
আরও পড়ুন:

দেশের ও দশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সুভাষ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯০: মৎস্যজীবীদের সুরক্ষার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে

শোকে, দুঃখে, সাপের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন ভীম। নিজেদের দুর্ভাগ্যকে দোষারোপ করে স্বগতোক্তি করতে লাগলেন। ভূমিশয্যায় শায়িত নিদ্রিত ভাইদের দেখে বেদনার্তচিত্তে বলতে লাগলেন, যাঁরা বারণাবতে উত্তমশয্যায় নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেননি, তাঁরা আজ ভূতলে শায়িত। কৃষ্ণের পিতা শত্রুবিজয়ী বসুদেবের ভগ্নী, হস্তিনাপুরের রাজা বিচিত্রবীর্যের পুত্রবধূ, সম্মানযোগ্যা, সুলক্ষণা,মহান পাণ্ডুর যোগ্যা ভার্যা, যাঁর দেহের বর্ণ পদ্মকোষের মতো শুভ্র, সেই কোমলাঙ্গী দেবী কুন্তী, বহুমূল্য শয্যা যাঁর যথাযোগ্য স্থান, যাঁর ধর্ম, বায়ু ও ইন্দ্রদেবতার ঔরসজাত তিনটি পুত্র আছে, তিনি আজ বনমধ্যে সাধারণ নারীর ভূমিশয্যায় শয়ন করেছেন।

ধার্মিক, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ত্রিভুবনের প্রভু হতে পারতেন তিনি। হায়, ক্লান্তদেহে প্রাকৃতজনের মতো ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে রয়েছেন। অতুলনীয় শৌর্যবীর্যবান,নীলমেঘবরণ শ্যাম, অর্জুনেরও একই অবস্থা। অশ্বিনীকুমারদ্বয়তুল্য ঈর্ষণীয় রূপের আধার নকুল ও সহদেব সাধারণ লোকের ভূশয্যা গ্রহণ করেছেন।

স্বজনদের শঠতায় ক্ষুব্ধ, ব্যথাতুর, বিরক্ত,ভীমসেনের অভিমত, যে ব্যক্তির খল স্বভাব কুলাঙ্গার জ্ঞাতি নেই, সেই ব্যক্তি নিঃসঙ্গ একাকী গ্রাম্য বৃক্ষটির মতোই সুখে জীবন কাটায়। জ্ঞাতয়ো যস্য নৈব স্যুর্বিষমাঃ কুলপাংসনাঃ। স জীবেত সুখং লোকে গ্রামদ্রুম ইবৈকজঃ।। একা, সঙ্গীবিহীন, ফুলে পাতায় ভরা গাছটি, দেববৃক্ষের মান্যতা লাভ করে, পান্থজনের দ্বারাও পূজিত ও সমাদৃত হয়। আর যাঁদের আত্মীয়রা বীর এবং ধার্মিক হন, তাঁরা জগতে নির্বিঘ্নে সুখে জীবন যাপনে ধন্য হয়। যেষাঞ্চ বহবঃ শূরা জ্ঞাতয়ো ধর্ম্মমাশ্রিতাঃ। তে জীবন্তি সুখং লোকে ভবন্তি চ নিরাময়াঃ।। ধনবান, বলশালী এবং মিত্র ও বন্ধুদের আনন্দদানকারী এই স্বজনেরা বন্য বৃক্ষের মতো পরস্পরকে আশ্রয় করে বাঁচে। দুরাত্মা দুষ্ট পুত্ররা ঘিরে রয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে, যিনি একাধারে রাজ্যলোভী, মূর্খ এবং যাঁর পরিমণ্ডলে রয়েছেন দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন অমাত্যরা। ধৃতরাষ্ট্র প্রতারক, খল, পাপী, অধার্মিক স্বার্থপর, একরোখা তাঁর বুদ্ধি। তিনি আমাদের প্রবাসবাসে বাধ্য করে দগ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমরা বেঁচেছি শুধু দৈবের সহায়তায়। বিবাসিতা ন দগ্ধাশ্চ কথঞ্চিদ্দৈবসংশ্রয়াৎ।

ভীমসেন কোনও মতে দহনজ্বালা থেকে বেঁচেছেন। কিন্তু এখন তাঁর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। অথচ তাঁদের কষ্টের যে শেষ নেই। ক্ষোভে, ক্রোধে দুর্যোধনকে মনে মনে ভর্ৎসনা করে বলতে লাগলেন ভীমসেন। দুষ্টবুদ্ধি, দুর্যোধনের মনষ্কামনা পূর্ণ হোক। নিশ্চয়ই তাঁর দৈব সহায়। তাই যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে হত্যার অনুমতি দিচ্ছেন না। সেই কারণেই দুর্যোধন প্রাণে বেঁচে আছেন এখনও। তা না হলে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে আজই সমন্ত্রী, কর্ণ, অনুজগণ ও শকুনিসহ তোকে যমের বাড়ি পাঠাতাম। ন ত্বদ্য ত্বাং সহামাত্যং সকর্ণানুজসৌবলম্।। গত্বা ক্রোধসমাবিষ্টঃ প্রেষয়িষ্যে যমক্ষয়ম্। ওই ধার্মিক পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের প্রতি ক্রুদ্ধ নন। তাই ভীমসেনের কিছু করার নেই এখন। কিন্নু শক্যং ময়া কর্ত্তুং যত্তে ন ক্রুধ্যতে নৃপঃ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৪: রাজসহায়ে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের, রাজারই প্রয়োজনে বিপদের মুখে পড়তে হয়

মহাবলশালী ভীমসেন এমনই নিজের মনে বলে চললেন। কখনও ক্রোধে জেরবার হলেন কখনও বা উত্তেজনায় দুহাত ঘষতে লাগলেন, আবার কখনও গভীরদুঃখে দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হল তাঁর। আবার মাঝে মাঝে নিভন্ত প্রদীপের শিখার মতো সমাহিত হলেন তিনি। সাধারণ মানুষের স্নেহব্যাকুলকণ্ঠে, সস্নেহে নিদ্রিত ভায়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, নাতিদূরেণ নগরং বনাদস্মাদ্ধি লক্ষয়ে।জাগর্ত্তব্যে স্বপন্তীমে হন্ত জাগর্ম্ম্যহং স্বয়ম্।।

দূরে একটি নগর দেখা যাচ্ছে। আমি স্বয়ং বিনিদ্র রয়েছি,তাই এদের সুখনিদ্রা সম্ভব হয়েছে। আমি বরং জেগেই থাকি। তিনি স্থির করলেন,ঘুম থেকে জেগে উঠে বরং সকলে জল পান করে ক্লান্তি দূর করবেন।

পঞ্চপাণ্ডব, মা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে, অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছেন। তাঁদের ঐক্যই শক্তি।জীবনে ধর্মবোধ, শক্তিমত্তা, সৌন্দর্য, মাতৃগৌরব, প্রখ্যাত পিতৃপরিচয় কী ছিল না তাঁদের? সম্পূর্ণ প্রতারণার শিকার হলেন তাঁরা। একান্ত স্বজন পিতৃতুল্য অভিভাবক, বিশ্বস্ত মন্ত্রী,জ্ঞাতিভায়েরা তাঁদের হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন,শুধুমাত্র গদিদখলের লিপ্সায়। বিশ্বাসঘাতকদের সব পরিকল্পনা জেনে, বুঝেও, নিরাশ্রয় হয়ে পথে নামতে হয়েছে তাঁদের। হিতাকাঙ্খী বিদুরের সহায়তায় চক্রান্ত ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছেন পাণ্ডবরা। ছলনার মুখোশধারী স্বজনদের যে দ্বিচারিতা, সেটি প্রতিফলিত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের আচরণে। তবে রাজনীতির বাতাবরণে জনতা জনার্দনকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় আছে কী? সবটুকুই ধরা পড়ে যায় তাঁদের অভিজ্ঞদৃষ্টিতে।

ভীমসেন, প্রতারক শঠ স্বজনের থেকে জ্ঞাতিশূন্যজীবন শ্রেয় মনে করেছেন। এ বিষয়ে প্রবাদ আছে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।প্রকৃত স্বজনের সঙ্গ সর্বদাই নিরুপদ্রব ও আনন্দদায়ক, সেটি ভীমসেনের আচরণে প্রমাণিত হয়েছে।

জীবনে যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ, অর্জুনের বীর্যবত্তা, নকুল সহদেবের সহায়তা, বিদুরের সহমর্মিতার হাত, সবকিছুর সাযুজ্য বজায় থাকে যদি জীবন সচল গতিময় হয়। ভীম যেন সেই গতিময়তার প্রতীক। তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন,ছন্দে বেঁধেছেন শ্রান্ত, ক্লান্ত, ঘটনার অভিঘাতে হতচকিত, স্থবির জীবনকে।ভীম, ভারবহনের সামর্থ্য, চলমান স্বাচ্ছন্দ্য। জীবনে অন্তর্ঘাত,শত্রুতার চোরাস্রোত, দ্বন্দ্ব প্রতিকূলতা নিত্য। এ সবই আবশ্যিক জীবনের অনুপান। কখন পতন, অবস্থান্তর হয় সেটি বুঝে ওঠা দুষ্কর। বিদুরের মতো সহানুভূতির মন, ঊষর জীবনের মরুপ্রান্তরে একখণ্ড মরূদ্যান যেন। পাণ্ডবদের মতো ভাগ্যবান কেউ হন। আবার কোন দুর্ভাগা একটু অনুকম্পা,সহানুভূতির স্পর্শ না পেয়ে অকালে শুকিয়ে যান, যা কিছু বিরোধী শক্তিকে রুখে দেওয়া সম্ভব যদি চলার পথটি গতির উদ্যমে সাবলীল হয়। ফোকাস বা উদ্দেশ্য হারালে দিকভ্রান্তি, পদস্খলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সেই কারণে ঐক্যের সঙ্গে স্বার্থত্যাগ, সামর্থ্য প্রয়োজন। যেটি পঞ্চপাণ্ডবদের ছিল। ভীমের উৎসাহ,সামর্থ্য পাণ্ডবদের অন্যতম শক্তি।

ভীম অবলীলায় নিজে অগ্রণী হয়ে যাত্রাপথের আনন্দগান হয়ে উঠেছেন। তিনি ছাড়া এ নিরুদ্দেশযাত্রা হয়তো নৈরাশ্যে পর্যবসিত হোত। এই জীবনের সফরসঙ্গী সকলে, সঠিক সহযাত্রী হতে পারেন না। পারেন শুধু অদম্য উদ্যমী, সহানুভূতিতে ভরা কোন মনের মানুষ। পাণ্ডবদের অজানা গন্তব্যে, যাত্রাপথে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে কোন জীবনশিক্ষা, যা কেবল মহাভারতের গভীর তত্ত্বানুসন্ধানের বিষয় নয়, সাধারণ কোন মননের বিষয়।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content