সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মন্ত্রী সিদ্ধার্থ, রানি কৈকেয়ীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন। তাঁর বক্তব্য মূলত রামের সপক্ষে। নির্দোষ রামের বনে নির্বাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন রানি। রামের সমৃদ্ধি যেন অব্যাহত থাকে। মন্ত্রীর যুক্তিপূর্ণ কথায়, রানি কৈকেয়ীকে প্রবল তিরস্কার করে বলে উঠলেন, শোকাকুল রাজা দশরথ, আস্থায় মার্গং কৃপণং কুচেষ্ট। চেষ্টা হি তে সাধুপথাদপেতা।। কুপথ আশ্রয় করেছো, নীচকাজে প্রবৃত্তি তোমার। সৎপথ বিহীন তোমার যতো প্রচেষ্টা। শেষে রাজা ঘোষণা করলেন, তিনি রাজ্যপাট ছেড়ে রামের অনুগমন করবেন। দীর্ঘদিন ধরে, রানি সপুত্র সুখে ভোগ করুন এই রাজ্য।

রামের বনগমনে মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। তিনি এই ভোগসর্বস্ব জীবন পরিত্যাগ করে চলেছেন বনবাসে। অনাসক্তি তাঁর মনে, কি প্রয়োজন চতুরঙ্গ সেনার? শ্রেষ্ঠ হাতিটিকে দান করে তার বন্ধনরজ্জুর প্রতি মায়া কেন? জ্জুস্নেহেন কিং তস্য ত্যজতঃ কুঞ্জরোত্তমম্। ভরতকে তিনি রাজ্য দান করেছেন, তাঁর চতুরঙ্গ সেনার কি প্রয়োজন? রাম অনুরোধ জানালেন, চীরাণ্যেবানয়ন্তু মে। আমার জন্যে চীরবস্ত্র আনা হোক। বনবাসে তাঁর প্রয়োজন দুটি খনিত্র (খন্তা) ও একটি পেটিকা। রানি কৈকেয়ী নিজে সত্বর উদ্যোগ নিলেন। সাত তাড়াতাড়ি চীরবস্ত্র ধরিয়ে দিলেন রামের হাতে।

লোকলজ্জা উপেক্ষা করে রামকে বললেন, পরিধৎস্বেতি। নাও পরিধান করো। রাম দুটি চীরবস্ত্র গ্রহণ করলেন। নিজের সূক্ষ্মবস্ত্র পরিত্যাগ করে মুনিদের পরিধেয় চিরবস্ত্র পরিধান করলেন। লক্ষ্মণও নিজের রাজবেশ পরিত্যাগ করে তপস্বীর যোগ্য বেশ পরিধান করলেন। শুধু সীতা, যিনি কৌশেয়বসনে অভ্যস্ত, তিনি জালদর্শনে পক্ষিণীতুল্য সন্ত্রস্ত হলেন। কৈকেয়ীর কাছ থেকে বল্কল ও দুটি চীরখণ্ড গ্রহণকালীন বিষণ্ণা সীতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল। সীতা জানেন না, বনবাসী মুনিদের পরিধেয় চীরবস্ত্র কীভাবে অঙ্গে ধারণ করতে হয়? কথং নু চীরং বধ্নন্তি মুনয়ো বনবাসিনঃ। দাঁড়িয়ে রইলেন অপটু, লজ্জিতা সীতা।
রাম স্ত্রীর সাহায্যার্থে ছুটে গেলেন, তাঁর কৌশেয়বস্ত্রের ওপরে চীরবস্ত্র বেঁধে দিলেন। অন্তঃপুরবাসিনীদের চোখের জল আর বাধা মানল না। সীতা কেন বনবাসে যাবেন? ধার্মিক রাম লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে পিতৃশর্তপালনে বনবাসে গমন করুন। নেয়মর্হতি কল্যাণী বস্তুং তাপসবদ্ বনে। তাপসতুল্য জীবন সীতার জন্যে নয়।তাঁদের প্রার্থনা নয়, একপ্রকার দাবি,সীতা অযোধ্যাতেই রয়ে যান। রাম সীতার চীরবস্ত্র বেঁধে দিচ্ছেন — এ দৃশ্য আর সহ্য হলনা রাজগুরু বশিষ্ঠের। প্রবল প্রতিবাদের সুর তাঁর কণ্ঠে। রানিকে ভর্ৎসনা করে উঠলেন তিনি। কৈকেয়ী কুলের কলঙ্ক, তিনি মর্যাদাবোধের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। রাজাকে প্রতারণা করে এখন সাধু সেজেছেন।

কুলগুরু বশিষ্ঠ ঘোষণা করলেন, দেবী সীতাকে বনে যেতে হবে না। রামের যোগ্য আসনে তিনি অধিষ্ঠিতা হন। আত্মা হি দারাঃ সর্ব্বেষাং দারসংগ্রহবর্ত্তিনাম্। আত্মেয়মিতি রামস্য পালয়িষ্যতি মেদিনীম্।। সকল বিবাহিত পুরুষের পত্নী হলেন আত্মাস্বরূপ। তাই রামের আত্মা, সীতা, পৃথিবী পালন করুন। আবেগাপ্লুত গুরুদেব, সীতাসহ রামের সহযাত্রী হতে চাইলেন। অন্তঃপুররক্ষক, পুরবাসীরা তাঁদের পরিধেয়বসন জীবিকানির্বাহের সামগ্রীসহ রাম ও সীতার অনুসরণ করবেন। শুধু তাই নয়, কুলগুরুর অনুমান, ভরত, শত্রুঘ্ন দুই ভাই চীরবাস ধারণ করে রামের সঙ্গে নিশ্চিত বনবাসী হবেন। তখন এই শূন্য জনহীন, অরণ্যে পরিণত অযোধ্যা শাসন করুন একাকিনী কৈকেয়ী। রাম যেখানে রাজা নন, সেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই, রাম যদি অরণ্যে বাস করেন সেই অরণ্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ন হি তদ্ভবিতা রাষ্ট্রং যত্র রামো ন ভূপতিঃ। তদ্বনং ভবিতা রাষ্ট্রং যত্র রামো নিবৎস্যতি।

রাজা দশরথের যোগ্য পুত্র ভরত, পিতার অপ্রদত্তরাষ্ট্র শাসন করতে অভিলাষী হবেন না। কৈকেয়ীকেও ভরত আর সম্মান করবেন না। মা যদি পৃথিবী হতে আকাশচারিণী হন অর্থাৎ মায়ের জীবনের বিনিময়েও ভরত রাজা হতে চাইবেন না। তাই কৈকেয়ীর সিদ্ধান্ত পুত্রের কল্যাণকামনায় নয়, বরং পুত্রের পক্ষে অহিতকর। রামের অনুগত কে নয়? কৈকেয়ী দেখবেন, যাবতীয় প্রাণী এমন কি অচর বৃক্ষও তাঁর সঙ্গে অরণ্যগমনে উন্মুখ হয়ে আছে। রাজগুরু বশিষ্ঠের অনুরোধ —তাই বধূমাতা সীতার চীরবসন সরিয়ে নিয়ে,তাঁকে উত্তম আভরণ ও পরিধেয় বস্ত্র দান করা হোক।ঋষি বশিষ্ঠের যুক্তি হল—কৈকেয়ী, রামের বনবাস কামনায় বর প্রার্থনা করেছেন,সীতার বনবাস তাঁর প্রার্থিত ছিল না। তাই বসনভূষণে সজ্জিত হয়ে কুলবধূ সীতার বনে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করাই শোভনীয়। রাজবধূ যথাযোগ্য মর্যাদায় পরিধেয় বসনভূষণ,মুখ্য সেবকবর্গ, ও যানসহ অরণ্যগমনে সক্ষম। কারণ তিনি যে রানির বরগ্রহণের এক্তিয়ারভুক্ত নন। যানৈশ্চ মুখ্যৈঃ পরিচারকৈশ্চ /সুসংবৃতা গচ্ছতু রাজপুত্রী। বস্ত্রৈশ্চ সর্ব্বৈঃ সহিতৈর্বিধানৈ/ র্নেয়ং বৃতা তে বরসম্প্রদানে।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৫: ধর্ম, অর্থ, কাম—এই ত্রিবর্গের সাধন, ভীমসেনের আচরণে কী প্রতিফলিত হয়েছে?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯৭: সঠিক পরিমাণে মাছের ডিমপোনা কিনার সহজ উপায় কী, জানেন?

বল্কলপরিহিতা সীতার নাথবতী হওয়া সত্ত্বেও অনাথা অবস্থা দেখে, প্রজারা আর্তস্বরে রাজা দশরথকে ধিক্কার দিয়ে উঠলেন। তস্যাং চীরং বসনায়াং নাথবত্যামনাথবৎ। প্রাচুক্রোশ জনঃ সর্ব্বো ধিক্ ত্বাং দশরথস্ত্বিতি।। কোথায় গেল রাজা দশরথের স্বধর্ম, যশের প্রতি আসক্তি? এমন কি জীবনের প্রতিও তিনি আস্থা হারিয়ে দুঃখে কাতর হলেন। রাজা দশরথ কৈকেয়ীর নিন্দায় সোচ্চার হলেন। তাঁর ভর্ৎসনায়, কুলগুরু বশিষ্ঠের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। হে কৈকেয়ী, সীতা চীরবস্ত্র ধারণের যোগ্যা নন। কৈকেয়ি কুশচীরেণ ন সীতা গন্তুমর্হতি।

আমার গুরু যথার্থ কথাই বলেছেন, সীতা বনবাসের যোগ্যা নন। নেয়ং বনস্য যোগ্যেতি সত্যমাহ গুরুর্মম। কোন অপরাধের শাস্তি ভোগ করে, রাজশ্রেষ্ঠ জনকের পুত্রী, আজ জনসমক্ষে তাপসীতুল্যা চীরধারিণী অবস্থায় দৃশ্যমানা হবেন? কৈকেয়ীকে দৃঢ়কণ্ঠে বোঝালেন রাজা দশরথ, সীতাকেও চীরবস্ত্র ধারণ করতে হবে —আমি, এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইনি। চীরাণ্যপাস্যাজ্জনকস্য কন্যা/নেয়ং প্রতিজ্ঞা মম দত্তপূর্ব্বা। সেই জনকনন্দিনী ধনরত্নসহ যথেচ্ছসুখে অরণ্যে বিচরণ করুন। আক্ষেপ ও অনুশোচনায় হাহাকার করে উঠলেন অযোধ্যারাজ। তিনি তাঁর মৃত্যু পরোয়ানাতেই যেন সাক্ষর করেছেন। প্রতিশ্রুত বরদানের নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে নিরুপায় রাজা এই নিষ্ঠুর কাজে ব্রতী হয়েছেন।

রাম বিমাতা কৈকেয়ীর অনিষ্ট করে থাকলেও, হরিণীর মতো উৎফুল্লনেত্রা, মনস্বিনী, কোমলা বৈদেহী কী অপরাধ করেছেন? রামকে নির্বাসিত করেও পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়নি রানির? অভিষেকের প্রাক্কালে উপস্থিত রামকে জটাবল্কলধারণ করে বনবাসের আদেশ দিয়েছিলেন কৈকেয়ী। বরদানে দায়বদ্ধ রাজা সেটি অনুমোদন করেছিলেন। এখন নিজের ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করে সীতাকেও চীরবস্ত্রধারণে বাধ্য করে রানি কী নরকে যেতে চাইছেন?
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই

রাজা দশরথ কাতর অসহায়। বনগমনোদ্যত রাম,মা কৌশল্যাবিষয়ে বিশেষ চিন্তিত।প্রবীণা মা কৌশল্যা, যশস্বিনী, ধার্মিক,উদারমনা। স্বামীর বিরুদ্ধে তাঁর কোন অভিযোগ নেই। রাম আশা করেন, তাঁর মায়ের প্রতি রাজা কোন অসৌজন্য প্রকাশ করতে পারবেন না। মা কৌশল্যা পুত্রের বিরহে শোকসাগরে নিমজ্জিত হবেন। ইতিপূর্বে অন্য কোন বিষয়ে,তাঁর এমন দুঃখানুভবের অভিজ্ঞতা হয় নি। ময়া বিহীনাং বরদ প্রপন্নাং শোকসাগরম্। অদৃষ্টপূর্ব্বব্যসনং ভূয়ঃ সম্মন্তুমর্হসি।। তাই পিতার কাছে রামের অনুরোধ—জননী যেন যথাযোগ্য প্রাপ্য সম্মান ভোগ করেন। পুত্রের অনুপস্থিতি যেন তাঁর জীবনহানির কারণ না হয়। তথা বনস্থে ময়ি শোককর্শিতা/ন জীবিতং ন্যস্য যমক্ষয়ং ব্রজেৎ।।

রামের বনগমনের সহযাত্রিণী সীতা,অযোধ্যার রাজনৈতিক আবহে অনেক প্রশ্ন এনে দিলেন। আধুনিক পরিভাষায় একরকম আইনি জটিলতা বলা যেতে পারে। প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ঋষি বশিষ্ঠ বনবাসে সীতার পরিধেয়বসন চীরবস্ত্রের প্রসঙ্গে ব্যথিত হয়ে কৈকেয়ীকে যে তিরস্কার করলেন সেটি আবেগমথিত হলেও, যেন সামাজিকক্ষেত্রে নারীর উদার মুক্ত অবস্থানের দিগদর্শন বলা যেতে পারে। সীতাকে উপলক্ষ্য করে রাজগুরু বশিষ্ঠ যেন ব্যবহারজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রাজার বরপ্রদানের শর্ত সীতা সম্পর্কে প্রযুক্ত হতে পারে না। কুলগুরু রানির আচরণের ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন এবং রাজা দশরথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রামের বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর স্বামীর পদচ্যুতির ফলভাগিনী হতে পারেন না। বরং সীতা রামের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলাভিষিক্তা হয়ে রাজ্যশাসনের যোগ্য অধিকারিণী এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কৈকেয়ীপুত্র ভরতের ভাবি আচরণের সঠিক মূল্যায়ন তাঁর অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক।

ভবিষ্যতে ভরতের, রামের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য তার প্রমাণ। অনুশোচনা ও আক্ষেপে ভেঙ্গে পরা রাজা দশরথকে নৈতিক সমর্থন যুগিয়েছেন কুলগুরু বশিষ্ঠ। সীতার প্রতি কৈকেয়ীর আচরণের প্রতিবাদের সাহস পেয়েছেন রাজা।সংসারে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ বিজ্ঞ অভিভাবকের ভূমিকায় রয়েছেন বশিষ্ঠ। শুধু সংসার নয় অযোধ্যার রাজনৈতিক বাতাবরণে এমন এক প্রাজ্ঞের হস্তক্ষেপের হয়তো প্রয়োজন ছিল। যদিও অবশ্যম্ভাবী বনবাস তিনি প্রতিরোধ করতে পারেননি। কৈকেয়ীর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন মন্ত্রীমণ্ডলীর সদস্য,রাজগুরু থেকে আপামর জনতা, যা ন্যায়সঙ্গত নয়,যে সিদ্ধান্ত অসঙ্গত,অনৈতিক সেটি প্রতিবাদের ঝড় সৃষ্টি করতে পারে। যদিও সেই প্রলয়কে সবসময়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।এখানে,কারণ বোধ হয় ফলভোক্তা রামের অসহযোগিতা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৭: তিনটি মেয়ের তিনটি কলম!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত

রাম বনবাসে সম্মত হয়েছিলেন। নৈতিকতার দায়বোধ থেকে তাঁর এই অঙ্গীকারে পিতৃসত্যরক্ষার তাগিদও ছিল। তিনি কোন প্রতিবাদে গলা মেলাননি। নিজে মাথা নিচু করে রানি কৈকেয়ীর আদেশ মেনে নিয়েছেন। তিনি বোধ হয় রাজকুলে জন্মহেতু নয়, আজন্ম আদর্শ রাজা হিসেবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তাঁর নীতি, বোধ হয়,প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধিতা নয়, সহযোগিতা। কারণ অসহযোগিতায় রয়েছে রাজপরিবারের তথা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্কট, ভাঙনের বার্তা। আদর্শ রাজা বা আদর্শ দেশনায়কের নৈতিক পদক্ষেপ অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকে। রামচন্দ্র আদর্শ রাজা হিসেবে সফল হয়েছেন, তাঁর এই ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণচিন্তায় নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতার জন্যে।

ব্যক্তিগত আক্রোশ শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে চলে যায় সেখানে প্রিয়জনেরাও সেই আক্রোশের তালিকাভুক্ত হয়ে পরেন। সীতা সেইরকমই একজন। একজন সহধর্মিণী স্বামীর প্রাণবায়ুসম।তাঁর অস্তিত্ব স্বামীর আত্মার গভীরে হওয়াই কাম্য। রামায়ণ রামের জীবনদর্শন,তাঁর জীবনালেখ্য,সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যেতো যদি সীতার সাহচর্য না থাকতো। একটি ছবিকে পূর্ণতা দেয় রঙের বাহার বা সাদাকালোর সাযুজ্যময় সহাবস্থান।রামের স্বামীত্ব, প্রভুত্ব, বীরবত্তা, ন্যায়শাসন, সৌভ্রাতৃত্ববোধ, সৌজন্য, মিত্রতা, বিশ্বস্ততা, সত্যপরায়ণতা,শ্রদ্ধাবোধ এই সবকিছুই সেই জীবনচিত্রের নানান বর্ণ, আলো কালোর শান্তিময় সহাবস্থান। সেই চরিত্রটিকে পূর্ণতা দিয়েছে সীতার উপস্থিতি। রামের পাশে তাঁর উপস্থিতি, রামের ঘটনাবহুল জীবনবিন্যাসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তাঁর অনুপস্থিতিতে রামের দ্বন্দ্ববহুল জীবনযুদ্ধ, রামকে মানবিক করে তুলেছে।

প্রশাসক হিসেবে রামকে এক আদর্শের মানদণ্ডে সার্থক করে তোলাতেও সীতার অবদান কম নয়। অবতারতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত রামের প্রস্তরমূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে অরণ্যবাসের সিদ্ধান্তে অনমনীয়া থেকে তিনি রামচরিত্রের বিনির্মাণে সহায়ক হয়েছেন। রাজকুলের তথা গণসমর্থনে তাঁর অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের সুরক্ষিত অবস্থান, অনায়াসেই সম্ভব ছিল। চারিত্রিক দৃঢ়তাবলে সেই বিলাসময় জীবনের সুখ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদি সীতা গুরুজনদের অনুরোধে বনবাসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতেন তবে রাম হয়তো যুগান্তরেও জাতীয়নায়কে উত্তীর্ণ হতে পারতেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয়তো থেকেই যায়। কুলগুরু বশিষ্ঠ,অযোধ্যাপতি দশরথ, সকলের স্নেহের পাত্রী, সুদূর অরণ্যে স্বামীর সাহচর্যলাভের প্রত্যাশায় কৈকেয়ীর দেওয়া চীরবসন সাশ্রুনয়নে গ্রহণ করেছেন। রাম, নিজহাতে তাঁকে, তাপসীর বেশে সাজিয়েছেন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

এ সাজ যেন, চিরন্তন গৈরিকবর্ণকে বরণ করে নেওয়ার অঙ্গীকার। স্বামীপরিত্যক্ত হওয়াই যে তাঁর নিয়তি। ভবিষ্যতে দাম্পত্যের নিরাপদ সুখের ঘেরাটোপ স্বেচ্ছায় নয়,স্বামীর একক সিদ্ধান্তে পরিত্যাগ করে আশ্রমজীবন বেছে নিতে হয়েছে সীতাকে। তপস্বিনীতুল্য জীবন তাঁর অভীপ্সিত ছিল না নিশ্চয়ই।কৃতীস্বামীর সুখী গৃহকোণ আর পাঁচটি ভারতীয় নারীর মতো তাঁরও হয়তো প্রার্থিত ছিল। রামপ্রদত্ত চীরবসনসজ্জা কী ভাবি অযোধ্যাপতির অনুগত স্ত্রীকে আশ্রমিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার গূঢ় ইঙ্গিত বহন করছে?

রামায়ণে সীতার অবস্থান যেন, চিরকালীন পারিবারিক বা সামাজিক গণ্ডীতে, পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাধান্যে ভারতীয় নারীর নুয়ে পরা জীবনের দ্যোতক। সেখানে আছে, কিছুটা স্বীকৃতি, সম্মান কিন্তু স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় ভিত্তি নেই সেখানে। আছে শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার অধীনে দোদুল্যমান জীবন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content