বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে অনড়, দৃঢ়চেতা রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে পিতা দশরথের কাছে বিদায় নিতে চললেন। দুই সেবক বহন করে নিয়ে চলল মালায় সজ্জিত অস্ত্র। রাজপথে বিপুল জনসমাগমের ফলে চলাচল দুঃসাধ্য। সমৃদ্ধ নাগরিকেরা তাঁদের বিলাসবহুল অট্টালিকা ও সপ্ততল প্রাসাদ থেকে উদাসমনে দেখলেন, বিষয়োপভোগে সম্পূর্ণ বিবাগী দুই রাজকুমার ও রাজবধূ সীতা, নগ্নপায়ে রাজপথে চলেছেন, তাঁদের সঙ্গে নেই কোন অনুসরণরত চতুরঙ্গ বাহিনী। সমবেত জনতার আলোচনার বিষয় হলেন সর্বত্যাগী রাম। যিনি ঐশ্বর্যভোগে অভ্যস্ত, যিনি কাম্যবস্তুপ্রদানের আকরস্বরূপ, সেই রামের ইচ্ছা—ধর্মসঙ্গতভাবে পিতার বাক্য যেন অসত্য না হয়। ঐশ্বর্য্যস্য রসজ্ঞঃ সন্ কামানাঞ্চাকরো মহান্। নেচ্ছত্যেবানৃতং কর্ত্তুং বচনং ধর্ম্মগৌরবাৎ।।

পুরবাসীদের খেদ—সীতা দেবী, যিনি ছিলেন আকাশচারী প্রাণীদেরও দৃষ্টির অগোচরে, হায়, আজ সাধারণের সম্মুখে তিনি দৃশ্যমানা। রামের সহধর্মিনী সীতা, রক্তচন্দনের অনুলেপনে প্রসাধন সারতেন। তিনি শীত, গ্রীষ্ম বর্ষার অভিঘাতে অচিরেই শ্রীহীন হবেন। রাজা দশরথকে ভর করেছে কোন অশরীরীর অশুভ শক্তি তা না হলে রাজা কখনও প্রিয় পুত্রটিকে নির্বাসিত করতে পারতেন না। অদ্য নূনং দশরথঃ সত্ত্বমাবিশ্য ভাষতে। ন হি রাজা প্রিয়ং পুত্রং বিবাসয়িতুমর্হতি।। গুণহীন পুত্রও পরিত্যজ্য নয়, আর যে পুত্র চরিত্রবলে জনচিত্ত জয় করেছেন, তাঁকে ত্যাগকরা তো বলাইবাহুল্য।

রামের চরিত্র পুরুষোচিতগুণগুলিতে সমৃদ্ধ, সেই গুণগুলি হল, অহিংসা, দয়া, শাস্ত্রজ্ঞান, চরিত্রবল, ইন্দ্রিয়সংযম ও প্রশান্তি। প্রজাপুঞ্জের দশা ঠিক যেন গ্রীষ্মে জলের স্বল্পতার দরুণ, পীড়িত জলচর প্রাণীদের তুল্য। রাম যেন মূলস্বরূপ, প্রজারা তাঁর ফল, ফুল, শাখাপ্রশাখা। মূল ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন শাখা-প্রশাখা, ফল-ফুল-সহ সম্পূর্ণ মহীরুহের সমৃদ্ধি ব্যাহত হয় তেমনই অপরিহার্য ধার্মিক, কান্তিমান পৃথিবীপতি মূলরূপ রামের কষ্টে কাতর তার আশ্রিত সকল জীবলোক। তাই আপামর জনতার অভিমত, লক্ষ্মণ যেমন রামের সহযাত্রী হয়েছেন তেমনই সপত্নী, সবান্ধব তাঁরাও রামের অনুগমন করমবেন। তাঁদের প্রয়োজন নেই উদ্যান, ক্ষেত এবং গৃহের। রামের দুঃখসুখে একাত্ম হয়ে ধার্মিক রামের সঙ্গী হবেন তাঁরা। উদ্যানানি পরিত্যজ্য ক্ষেত্রাণি চ গৃহাণি চ একদুঃখসুখা রামমনুগচ্ছাম ধার্ম্মিকম্।। গৃহস্থদের পরিত্যক্ত গৃহের ধন ও সারবস্তু অপহৃত হবে, ধূলিধূসর বিধ্বস্ত সেই গৃহ পরিত্যাগ করবেন দেবতারা, ইঁদুর ছুটে বেড়াবে গৃহপ্রাঙ্গণে, জলহীন, গার্হস্থ্যচিহ্নরহিত ধূমহীন সেই গৃহ পরিষ্কৃত হবে না। আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্মবিহীন, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ধাতুপাত্রযুক্ত সেইসব গৃহের হীনদশা যেন বিপ্লবোত্তর সমাজের দীনহীন পরিণতির ছবি। দেবী কৈকেয়ী এইসব ভগ্ন ও পরিত্যক্ত গৃহগুলি অধিকার করুন। অস্মত্ত্যক্তানি বেশ্মানি কৈকেয়ী প্রতিপদ্যতাম্। রাম যেখানে বসবাস করবেন সেটিই হবে নগর, আর প্রজাদের পরিত্যক্ত নগরী হবে অরণ্য। জনগণ অধ্যুষিত অরণ্যের বন্যপ্রাণীরা আশ্রয় করুক এই পরিত্যক্ত নগরী। পুরবাসীদের অভিলাষ, বনবাসী হয়েও একমাত্র রামের সঙ্গই তাঁদের কাম্য। হিংস্র জন্তুর আবাস এই নগরে সহজলভ্য হবে তৃণ, মাংস এবং ফল। সেই নগর উপভোগ করুন সবান্ধবে রানি কৈকেয়ী ও তাঁর পুত্র কুমার ভরত।
রাম এই বিচিত্র কথোকথন শুনলেন কিন্তু প্রভাবিত হলেন না। চিত্তবিকারহীন প্রমত্ত গজসম রামচন্দ্র ধীরমন্থরগতিতে কৈলাসশিখরতুল্য দশ্য থভবনের দিকে অগ্রসর হলেন। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে বিমর্ষবদনে অপেক্ষমান মন্ত্রী সুমন্ত্রের সম্মুখীন হলেন তিনি। রামের চারিদিকে দুঃখের আবহ। তার প্রভাবমুক্ত রাম। দুঃখ তাঁর মনোজগতে রেখাপাত করতে পারেনি। সহাস্যমুখে বিষণ্ণ অভিজাতদের দেখলেন কিন্তু তাঁর একটাই লক্ষ্য দুঃখে অভিভূত পিতার দর্শনলাভ। পিতার আদেশে বনবাসগমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাম, নিকটে সুমন্ত্রকে দেখে অনুরোধ জানালেন, নিবদয়স্বাগমনং নৃপায় মে। আমার আগমনবার্তা রাজাকে নিবেদন করুন।

সুমন্ত রাজা দশরথকে কী অবস্থায় দেখলেন? ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করছেন শোকে মুহ্যমান রাজা দশরথ। তিনি যেন রাহুর গ্রাসে পরিণত সূর্য, যেন ভস্মরাশিতে সমাচ্ছন্ন বহ্নি কিংবা শুষ্ক জলহীন জলাশয়ের নিষ্প্রভ রিক্ততায় আক্রান্ত রাজা দশরথ। মহাবিজ্ঞ মন্ত্রী সুমন্ত্র করজোড়ে রাজাকে জয়সূচক সম্বর্ধনা জানিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মৃদুস্বরে জানালেন, ব্রাহ্মণ ও সেবকদের ধন দান করে, দশরথের প্রিয় পুত্র রাম রাজা দশরথের সাক্ষাৎপ্রার্থী। রাম ইতিমধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী সুহৃদবর্গের অনুমতি গ্রহণ করেছেন। তিনি আপনার দর্শনার্থী। ত্বাং হীদানীং দিদৃক্ষতে। প্রদীপ্ত সূর্যতুল্য রাজোচিতগুণে বিভূষিত রাম বনগমনে উদ্যত হয়েছেন। হে পৃথিবীপতি তাঁকে দর্শন দান করুন। গমিষ্যতি মহারণ্যং তং পশ্য জগতীপতে। যাঁর গাম্ভীর্য সমুদ্রতুল্য, আকাশের নির্মল স্বচ্ছতা যাঁর আচরণে, সেই সত্যবাদী ধার্মিক রাজা দশরথ সুমন্ত্রকে আদেশ দিলেন, পত্নীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে রামচন্দ্রকে দর্শন করবেন। দারৈঃ পরিবৃতঃ সর্ব্বের্দ্রষ্টুমিচ্ছামি রাঘবম্।

সুমন্ত্র অন্তঃপুরে রাজার আদেশ ঘোষণা করপলেন। রাজা দশরথের তিনশত পঞ্চাশজন রাজপত্নী।তাঁরা রামের আসন্ন বিরহহেতু, অশ্রুপাতের ফলে আরক্তনয়নে, রাজমহিষী কৌশল্যাকে বেষ্টন করে রাজভবনে উপস্থিত হলেন। রাজার নির্দেশানুসারে, সুমন্ত্র নিজে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। জোড়হাতে আসছেন প্রিয় পুত্র রাম। রাজা আর স্থির থাকতে পারলেননা। সিংহাসন ত্যাগ করে দ্রুত তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু পুত্রের কাছে পৌঁছতে পারলেন না। দুঃখদীর্ণ রাজা সংজ্ঞা হারিয়ে ভূপতিত হলেন। রাম, লক্ষ্মণ দুই ভাই, শোকার্ত অচৈতন্য পিতার অভিমুখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদ, মহিলাদের অলঙ্কারধ্বনির সঙ্গে মিশ্রিত ‘হা রাম’ এই নিনাদে মুখরিত হয়ে উঠল। সীতা-সহ রামলক্ষ্মণ উভয়ে আলিঙ্গনবেষ্টনে রাজা দশরথকে পালঙ্কে শুইয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

শোকার্ত রাজার চৈতন্য হল। রাম করজোড়ে মিনতি করলেন, মহারাজ, আপনি আমাদের প্রভু। আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি। দণ্ডকারণ্যে গমনোদ্যত আমার প্রতি মমতাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করুন। আপৃচ্ছে ত্বাং মহারাজ সর্ব্বেষামীশ্বরোঽসি নঃ। প্রস্থিতং দণ্ডকারণ্যং পশ্য ত্বং কুশলেন মাম্।। রামের সঙ্গে গমনেচ্ছু সীতা দেবী ও লক্ষ্মণের বনগমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন রাম। রাম বহুযুক্তি প্রদর্শন করেও তাঁদের এ বিষয়ে নিরস্ত করতে পারেননি। এখন তাঁর একান্ত প্রার্থনা, অনুজানীহি সর্ব্বান্নঃ শোকমুৎসৃজ্য মানদ। হে মাননীয় রাজন্, আপনি শোক পরিত্যাগ করে আমাদের তিনজনকে অনুমতি দিন। রাজা স্বীকার করলেন, কৈকেয়ীকে বরদান তাঁর বুদ্ধিবিভ্রমের ফল। তাই রাজার প্রস্তাব—তুমি আমার সিদ্ধান্তকে অসম্মান করে অযোধ্যার সিংহাসন অধিষ্ঠিত হও। অযোধ্যায়াং ত্বমেবাদ্য ভব রাজা নিগৃহ্য মাম্।

যুক্তিনিষ্ঠ, ধার্মিকশ্রেষ্ঠ রামের দুহাত অঞ্জলিবদ্ধ, কাতরকণ্ঠে তিনি পিতার সহস্রবৎসরের রাজত্ব কামনা করলেন। রাম জানালেন, রাজ্যে তাঁর কোন আকাঙ্খা নেই। অরণ্যবাস তাঁর অভিপ্রেত। তিনি পিতার প্রতিজ্ঞাপালন করে, চতুর্দশ বৎসর যাবৎ বনবাসান্তে পিতার চরণাশ্রয় করবেন। নব পঞ্চ চ বর্ষাণি বনবাসে বিহৃত্য তে। পুনঃ পাদৌ গ্রহীষ্যামি প্রতিজ্ঞান্তে নরাধিপঃ।। রাজা সত্যরক্ষার পাশে আবদ্ধ। এখন রোদনই তাঁর একমাত্র সম্বল। সত্বর রামকে বিদায় দেওয়ার জন্য, অন্তরাল থেকে রানি কৈকেয়ীর ইশারা সর্বদাই আছে। রাজা আশীর্বাদ করে বললেন, হে রঘুনন্দন, ধর্মজ্ঞ ও সত্যনিষ্ঠ তুমি। তোমার অবিচলিত বুদ্ধির পরিবর্তন, দুষ্কর। শ্রেয়লাভের লক্ষ্যে, উন্নতিকামনায়, আবার প্রত্যাবর্তনের নিমিত্ত ঔৎসুক্যহীন হয়ে, বাছা, তুমি নির্বিঘ্নে, ভয়হীন পথে, যাত্রা করো। শ্রেয়সে বৃদ্ধয়ে তাত পুনরাগমনায় চ। গচ্ছস্বারিষ্টমব্যগ্রঃ পন্থানমকুতোভয়ম্।। ন হি সত্যাত্মনস্তাত ধর্ম্মাভিমনসস্তব। সন্নিবর্ত্তয়িতুং বুদ্ধিঃ শক্যতে রঘুনন্দন।। রাজা দশরথের একটাই অনুরোধ, আজ রাতে তুমি যেয়োনা। অদ্য ত্বিদানীং রজনীং পুত্র মা গচ্ছ সর্ব্বথা।

একটা দিন শান্তিতে থাকতে পারবেন তিনি। ব্যাকুল পিতার একটাই কামনা, পুত্র রাম, পিতামাতার সান্নিধ্যে শুধু একটা রাত অতিবাহিত করুন। রামের প্রিয় যা কিছু স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা তিনি করবেন। রাঘব রাম, পিতার সর্বাঙ্গীন কল্যাণকামনায় অতি দুষ্কর বনবাস আশ্রয় করতে চলেছেন। রাজা দশরথ, সত্যের নামে শপথ করে বললেন, রামের বনবাস তাঁর প্রিয় নয়। ন চৈতন্মে প্রিয়ং পুত্র শপে সত্যেন রাঘব। অসহায় রাজা অকপটে বললেন, ভস্মাবৃত অগ্নিতুল্যা স্ত্রী কৈকেয়ীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন তিনি। সেই বঞ্চনার ফল ভোগ করছেন রাম। এটি স্বীকার করতেই হবে, জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে রামের এই পিতার সত্যরক্ষার দায়ভারগ্রহণ,আশ্চর্যের বিষয় নয়। ন চৈতদাশ্চর্য্যতমং যত্ত্বং জ্যেষ্ঠঃ সুতো মম।অপানৃতকথং পুত্র পিতরং কর্ত্তুমিচ্ছসি।।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩২: কলি কলিং

পিতার অনুরোধের প্রত্যুত্তরে ভাই লক্ষ্মণের সঙ্গে সহমত হয়ে রাম করুণকণ্ঠে বললেন, তিনি আজ, যা কিছু সুখভোগ করবেন, কে রামকে সেটি আগামীকালে দেবেন? তাই আজ তিনি বনবাসগমনে ইচ্ছুক। রামের পরিত্যক্ত, ধনধান্যে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র, প্রজাবৃন্দসহ ভরতকে দান করুন রাজা দশরথ। বনবাসের স্থিরসঙ্কল্পে অবিচলিত রাম। বরদানের দায়বদ্ধতাপালন হবে রাজার সত্যনিষ্ঠতার প্রমাণ। চতুর্দশ বৎসর বনচরেদের সঙ্গে বাস করবেন রাম। এ বিষয়ে আর কোন বিবেচনার অবকাশ নেই। এ পৃথিবী ভরতকেই প্রদান করা হোক। তিনি দ্বিধাহীনভাবে জানালেন, তিনি রাজত্ব কামনা করেছিলেন, কারণ, আত্মসুখ রামের অভিপ্রেত ছিল না, শুধু পিতার আদেশপালনেই ছিল তাঁর অভিরুচি। রামের ঐকান্তিক কামনা, পিতার দুঃখ দূর হোক। পিতার চোখে অশ্রুপ্লাবন,আর নয়। দুর্ধর্ষ নদীপতি সমুদ্র কী ক্ষুব্ধ হয়? তেমনই রাজা দশরথের মন উত্তাল কেন? রামের দায়বদ্ধতা শুধু পিতার নৈতিক দায়ভার গ্রহণে। রাজ্য নয়, সুখ নয়, পৃথিবী নয়,যাবতীয় লৌকিক ভোগ্যসামগ্রী নয়, স্বর্গ নয়, এমন কি জীবনও তাঁর অভিপ্রেত নয়। নৈবাহং রাজ্যমিচ্ছামি ন সুখং ন চ মেদিনীম্। নৈব সর্ব্বানিমান্ কামান্ ন স্বর্গং ন চ জীবিতম্।। রাম পিতার সম্মুখে, সত্য এবং সুকৃতির নামে শপথ করে বললেন, তাঁর লক্ষ্য শুধুমাত্র পিতাকে অসত্য থেকে মুক্ত করা এবং সত্যরক্ষায় যুক্ত করা। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাম সম্মত নন। ন চ শক্যং ময়া তাত স্থাতুং ক্ষণমপি প্রভে। আর শোক,আক্ষেপ নয়।

রানি কৈকেয়ীর আদেশ ছিল, বনং গচ্ছেতি বনে গমন করো, রামের উত্তর ছিল ব্রজামীতি ‘বনে যাব’ সেই সত্যরক্ষা করতেই হবে। পিতাকে আশ্বস্ত করলেন রাম, বিহঙ্গের কালকাকলিমুখর, হরিণ পরিবৃত, শান্ত অরণ্যে তাঁরা পরমসুখে বাস করবেন। শাস্ত্রমতে, পিতা দেবগণেরও দেবতা। তাই দেবতাদের আদেশ মনে করে, পিতৃ আজ্ঞা পালন করবেন রাম। এইভাবে চতুর্দশ বৎসর অতিবাহিত হলেই অযোধ্যায় সমাগত রামের দেখা পাবেন রাজা। কেন এই দুঃখের, অশ্রুজলের আবহ? সাধারণের অশ্রু সংহত করে, পরিবেশের শান্ত সুস্থিতি রক্ষার পরিবর্তে নরসিংহতুল্য রাজার এই চিত্তবিকার কেন? যেন সংস্তম্ভনীয়োঽয়ং সর্ব্বো বাষ্পাকুলো জনঃ। স ত্বং পুরুষশার্দ্দূল কিমর্থং বিক্রিয়াং গতঃ।।

রামের অনুরোধ, এই পুর,রাষ্ট্র,পৃথিবী যা কিছু রাম পরিত্যাগ করে যাচ্ছেন,এ সবকিছুই ভরতকে দান করুন রাজা।রাজার বচন সত্য হোক। ত্বয়া যদুক্তং নৃপতে তথাস্তু তৎ। ভরত, এই পৃথিবী,পর্বত, নগর, উদ্যান সুখে প্রতিপালন করুন। রামের মন বিষয়বিমুখ। তাই রামের সুখহীনতায় বিচলিত বোধ করার কোন কারণ নেই। পিতাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে এই অক্ষয় রাজ্যসুখ, ভোগ্যবস্তু, পৃথিবী এমন কি মৈথিলী সীতাও রামের কাঙ্খিত নয়। রামের মন এখন অরণ্যমুখী। সেখানে বিচিত্র বৃক্ষপরিপূর্ণ বনরাজি, পর্বত, সরোবর, নদী দর্শনে এবং বন্য ফলমূল ভক্ষণেই তাঁর সুখ। তাই পিতা নিশ্চিন্ত হোন।

পুত্রের সান্ত্বনাবাক্যে চরম বিপন্ন, সন্তাপ ও দুঃখে ব্যথিতচিত্তে, রাজা দশরথ রামকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারালেন। কৈকেয়ী ব্যতীত অন্য রাজপত্নীরা কেঁদে উঠলেন। সেখানে উপস্থিত শোকাকুল সুমন্ত্র মূর্চ্ছিত হলেন।চতুর্দিকে হাহাকার রব উঠল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

রামের বনগমনের সিদ্ধান্ত, তাঁর কোন কর্মফলের কারণে নয়। সবটাই তাঁর পিতা দশরথের অপরিণামদর্শিতার ফল। রাজা দশরথের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তকে, সত্যে পরিণত করাই রামচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল। স্নেহাধিক্য ও প্রতিশ্রুতিরক্ষার দ্বন্দ্বে দোলাচলচিত্ত দক্ষ প্রশাসক রাজা দশরথের প্রতিজ্ঞারক্ষার সিদ্ধান্তটিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন পুত্র রাম। জ্যেষ্ঠ পুত্রের পিতার নির্দেশ পালন, নিঃসন্দেহে যথার্থ পুত্রের কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয়। নৈতিকতার মানদণ্ডে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, রাজার সত্যপ্রতিজ্ঞারক্ষা একটি আবশ্যিক দিক। দ্বিধান্বিত রাজাকে নৈতিক সাহস যুগিয়েছেন রাম। রাজার প্রস্তাব অনুসারে, রাম যদি পিতাকে নিগৃহীত করে রাজ্যভার গ্রহণ করতেন, তাহলে রামের সমুন্নত মহিমা কলঙ্কিত হোতো। এছাড়াও রামরাজ্যের হোতা রামচন্দ্রকে ঘিরে যে মিথ্ বা কিংবদন্তী সেটি যুগান্তরেও ভারতবর্ষের আপামর জনচিত্তের আবেগকে স্পর্শ করতে পারত কী?
শুধু রাজকীয় পরিমণ্ডলে নয়, যে কোনও প্রশাসনের ক্ষেত্রে, রাজতন্ত্রে বা গণতন্ত্রে বা পারিবারিক শাসনতন্ত্রে শপথ বা কমিটমেন্ট নিঃসন্দেহে মূল্যবান।

রাজা দশরথের অযোধ্যার রাজতন্ত্রেও ভাবি প্রশাসক নির্বাচনে জনতার রায়ের বিশেষ গুরুত্ব হয়তো ছিল। ভাবি অযোধ্যারাজ নির্বাচনে রামচন্দ্রের প্রতি জনসাধারণের অকুণ্ঠ জনসমর্থন তাঁর নিজের অর্জিত গৌরব। রাজতন্ত্রে—পারিবারিক শাসনতন্ত্রের প্রভাব, অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্র, রাজাদের বহুবিবাহে ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দাবিতে কূটচক্রান্তের অবকাশ ছিল। অযোধ্যারাজ, পত্নীদের প্রতি সমদর্শী ছিলেন না। রানি কৌশল্যার খেদোক্তিতে তা প্রতিফলিত। রামের জনপ্রিয়তা পুর, নগর, রাষ্ট্রের বিরাট পরিসরে এতটাই ছড়িয়ে পরেছিল যে প্রজারা অরণ্যেও নতুন রাজ্য গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছিলেন। আবেগপ্রসূত এ সিদ্ধান্ত মনে হতেই পারে। তবে পছন্দের ভাবি রাজার প্রতি তাঁদের এই আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অভিব্যক্তি, রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় মনে। প্রাসাদের অন্দরমহলের ঘেরাটোপের অন্ধকারেও সমানভাবে প্রোজ্জ্বল রামের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অমোঘ প্রভাব।

ছবি: প্রতীকী।

রাজা দশরথ হয়তো রানি কৈকেয়ীর আচরণে, অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্রের প্রভাব আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর সাড়ে তিনশো পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসগমনে উন্মুখ পুত্রের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন। পত্নীদের আরক্তনয়ন, তাঁদের প্রিয় রামের বিচ্ছেদকাতরতার ভাষা হয়ে উঠেছিল। রাজা দশরথের প্রিয় পত্নীকে বরদানের প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রশাসকের আবেগতাড়িত অদূরদর্শিতার ফল। এই অবিবেচনাপ্রসূত প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত অযোধ্যার বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরটিকে প্রভাবিত করেছিল।প্রশাসক রাজা দশরথের, বরদানের সিদ্ধান্ত ভার্সেস অনমনীয় রামচন্দ্রের বনবাস গমনের দৃঢ় একরোখা মনোবৃত্তি, এই দুয়ের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে রামের একক সিদ্ধান্ত। এ জয় নৈতিকতার জয়। রামচন্দ্র পিতাকে সত্যপ্রতিশ্রুতিরক্ষায় সাহায্য করেছেন কারণ তাঁর বনবাসগমন, এই প্রতিশ্রুতিরক্ষার একটি অন্যতম অংশ। তাঁর পরিত্যক্ত রাজ্যে অভিষিক্ত হবেন কৈকেয়ীপুত্র ভরত। দুটি প্রতিশ্রুতি একটি অপরটির পরিপূরক, দুটিই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আধুনিক গণতন্ত্রে নির্বাচনে যেমন একটা কমিটমেন্ট থাকে।

অযোধ্যায় রাজা দশরথ প্রজাদের কাঙ্খিত রাজাকে রাজপদে অভিষিক্ত করতে পারেননি। তিনি কিন্তু প্রজাদের ভাবি যোগ্য উত্তরাধিকারীদানের কমিটমেন্টরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর প্রতিশ্রুত বরদানের অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন মাত্র। এ বিষয়ে তাঁর একদা কামুকতা প্রধান অন্তরায় হলেও, কৈকেয়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশে যে কথা দিয়েছিলেন সেটি তাঁকে রক্ষা করতে হয়েছে।বলা যায় রামচন্দ্র তাঁর নিজের ত্যাগধর্মের উদারতাবলে, পিতাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। রামের প্রশাসকরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠার এখানেই শুরু। বৃহত্তর স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থ বিসর্জন, রাজ্যত্যাগ করে বনবাসগমনেই এর সূচনা। তাই তিনি যখন অকপটে বলেন, তদদ্য নৈবানঘ রাজ্যমব্যয়ং ন সর্ব্বকামান্ বসুধাং ন মৈথিলীম্। ন চিন্তিতং ত্বামনৃতং যোজয়ন্ বৃণীয় সত্যং ব্রতমস্তু তে তথা।। তিনি অক্ষয় রাজত্ব, সমস্ত কাম্যবস্তু, পৃথিবী এমনকি মৈথিলী কে ত্যাগ করতে চান শুধু পিতাকে দায়মুক্ত করবার লক্ষ্যে তখন তাঁর জীবনাদর্শ হয় বৃণীয় সত্যং ব্রতমস্তু তে সত্যকে বরণ, ব্রতপালনের অনুরূপ। এটি শুধু সান্ত্বনাবাক্য থাকেনা, ভবিষ্যতের এক সার্থক প্রশাসকের বাক্য ও মনের সাযুজ্যরক্ষার ভবিষ্যদ্বাণীরূপ সতর্কবার্তা বলেই মনে হয়। এটি আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনীতিবিদদের প্রতি হুঁশিয়ারি নয়তো?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content