ছবি: প্রতীকী।
মনোরম ইন্দ্রপ্রস্থনগরে পাণ্ডবদের নতুন বাসস্থান, সুরক্ষিত, মনোরম, বিদ্বজ্জন অধ্যুষিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপম এক রাজ্য। বলাইবাহুল্য রাজকীয় জীবনের সঙ্গে যুক্ত পারিবারিক দাম্পত্যের সম্পর্ক। দ্রৌপদী পঞ্চ পাণ্ডবের ধর্মপত্নী। পাণ্ডবদের উত্তরপুরুষ জন্মেজয়ের মনে প্রশ্ন জাগল, কথং পঞ্চ কৃষ্ণায়ামেকস্যাং তে নরাধিপাঃ। বর্তমানা মহাভাগা নাভিদ্যন্ত পরস্পরম্।। এক কৃষ্ণাতেই আসক্ত রইলেন? তাঁদের মধ্যে বিভেদ জন্মাল না? বক্তা বৈশম্পায়নের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলেন, কৃষ্ণাসম্পর্কিত পাণ্ডবদের মিলিত পারস্পরিক ব্যবহার কেমন ছিল? বৈশম্পায়ন বললেন, ইন্দ্রপ্রস্থে কৃষ্ণাসহ তাঁরা বেশ আনন্দেই ছিলেন। ভাইদের সঙ্গে নিয়ে মহাতেজস্বী, সত্যপরায়ণ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মানুসারে রাজ্য পালন করছিলেন। ষড়রিপুজয়ী, তীক্ষ্ণধী, সত্যসন্ধ পাণ্ডবরা পরমানন্দে ছিলেন। তাঁরা, রাজকীয় অবস্থানে থেকে, সমস্ত পুরকার্য সম্পাদন করতে লাগলেন।
একদিন পঞ্চ পাণ্ডবভাইদের উপস্থিতিতে হাজির হলেন দেবর্ষি নারদ। সশ্রদ্ধ যুধিষ্ঠির দেবর্ষিকে নিজের সুন্দর আসনটি দিলেন, তার ওপরে নিজের কৃষ্ণমৃগচর্মটি বিছিয়ে উপবেশন করলেন নারদ। যুধিষ্ঠির তাঁকে যথোচিত অর্ঘ্যাদি সম্মান প্রদর্শন করে, নিজের রাজ্য উপহার দিতে চাইলেন। তৃপ্ত মহর্ষি সন্তুষ্টচিত্তে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে যুধিষ্ঠিরকে কাছে বসালেন এবং দ্রৌপদীকে ডেকে পাঠালেন সেখানে। তৎক্ষণাৎ শুচিশুদ্ধা হয়ে ভক্তিমতী দ্রৌপদী সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনিবরকে প্রণাম নিবেদন করে, জোড়হাতে দাঁড়ালেন অবগুণ্ঠনবতী দ্রৌপদী। দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করে, তাঁকে বিদায় দিলেন মহর্ষি। পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে দেবর্ষি নারদ বললেন, পাঞ্চালী ভবতামেকা ধর্মপত্নী যশস্বিনী। যথা বো নাত্র ভেদঃ স্যাত্তথা নীতির্বিধীয়তাম্।। পাঞ্চালী তোমাদের একমাত্র ধর্মপত্নী। এই (দাম্পত্যসম্পর্ক) বিষয়ে যাতে বিরোধ না হয় এমন নিয়ম কর। মহর্ষি, তিলোত্তমা নামে এক নারীকে কেন্দ্র করে, এক মন প্রাণ, সুন্দর ও উপসুন্দ নামে তাঁর দুই ভাইয়ের প্রাণঘাতী বিয়োগান্তক পরিণতির কাহিনির সূচনা করলেন।
এই কাহিনি উপস্থাপনার উদ্দেশ্য হল নারীকেন্দ্রিক বিভেদ পরিহার করে, পাণ্ডবদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বরক্ষা। যুধিষ্ঠির এটুকুতেই তুষ্ট নন, তিনি জানতে উৎসাহী হলেন, এই সুন্দ ও উপসুন্দ কার পুত্র? কেন তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হল? কেন তাঁরা একে অপরকে বধ করলেন? তিলোত্তমা কে? তিনি কী দেবকন্যা? না অপ্সরা তিনি কে? কার অধীনা ছিলেন তিনি, যাঁর প্রতি কামোন্মত্ত দুজন পরস্পরকে হত্যা করেছিলেন? এতৎ সর্ব্বং যথাবৃত্তং বিস্তরেণ তপোধন! শ্রোতুমিচ্ছামহে ব্রহ্মন্!পরং কৌতূহলং হি নঃ।। এই সব কাহিনি যথাযথভাবে সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছুক আমরা, আমাদের যে, এ বিষয়ে পরম কৌতূহল।
একদিন পঞ্চ পাণ্ডবভাইদের উপস্থিতিতে হাজির হলেন দেবর্ষি নারদ। সশ্রদ্ধ যুধিষ্ঠির দেবর্ষিকে নিজের সুন্দর আসনটি দিলেন, তার ওপরে নিজের কৃষ্ণমৃগচর্মটি বিছিয়ে উপবেশন করলেন নারদ। যুধিষ্ঠির তাঁকে যথোচিত অর্ঘ্যাদি সম্মান প্রদর্শন করে, নিজের রাজ্য উপহার দিতে চাইলেন। তৃপ্ত মহর্ষি সন্তুষ্টচিত্তে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে যুধিষ্ঠিরকে কাছে বসালেন এবং দ্রৌপদীকে ডেকে পাঠালেন সেখানে। তৎক্ষণাৎ শুচিশুদ্ধা হয়ে ভক্তিমতী দ্রৌপদী সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনিবরকে প্রণাম নিবেদন করে, জোড়হাতে দাঁড়ালেন অবগুণ্ঠনবতী দ্রৌপদী। দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করে, তাঁকে বিদায় দিলেন মহর্ষি। পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে দেবর্ষি নারদ বললেন, পাঞ্চালী ভবতামেকা ধর্মপত্নী যশস্বিনী। যথা বো নাত্র ভেদঃ স্যাত্তথা নীতির্বিধীয়তাম্।। পাঞ্চালী তোমাদের একমাত্র ধর্মপত্নী। এই (দাম্পত্যসম্পর্ক) বিষয়ে যাতে বিরোধ না হয় এমন নিয়ম কর। মহর্ষি, তিলোত্তমা নামে এক নারীকে কেন্দ্র করে, এক মন প্রাণ, সুন্দর ও উপসুন্দ নামে তাঁর দুই ভাইয়ের প্রাণঘাতী বিয়োগান্তক পরিণতির কাহিনির সূচনা করলেন।
এই কাহিনি উপস্থাপনার উদ্দেশ্য হল নারীকেন্দ্রিক বিভেদ পরিহার করে, পাণ্ডবদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বরক্ষা। যুধিষ্ঠির এটুকুতেই তুষ্ট নন, তিনি জানতে উৎসাহী হলেন, এই সুন্দ ও উপসুন্দ কার পুত্র? কেন তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হল? কেন তাঁরা একে অপরকে বধ করলেন? তিলোত্তমা কে? তিনি কী দেবকন্যা? না অপ্সরা তিনি কে? কার অধীনা ছিলেন তিনি, যাঁর প্রতি কামোন্মত্ত দুজন পরস্পরকে হত্যা করেছিলেন? এতৎ সর্ব্বং যথাবৃত্তং বিস্তরেণ তপোধন! শ্রোতুমিচ্ছামহে ব্রহ্মন্!পরং কৌতূহলং হি নঃ।। এই সব কাহিনি যথাযথভাবে সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছুক আমরা, আমাদের যে, এ বিষয়ে পরম কৌতূহল।
নারদ তাঁর কাহিনি শুরু করলেন। পুরাকালে হিরণ্যকশিপুর বংশে মহাবলবান ও তেজস্বী মহাদৈত্য নিকুম্ভের দুই পুত্র হল, নাম তাদের সুন্দ ও উপসুন্দ। দুই পুত্র ছিল মহাশক্তিশালী, দুর্দান্ত ও নিষ্ঠুরস্বভাব। কর্তব্যবিষয়ে দুজনেই সমমনস্ক, সমান একাগ্রচিত্ত, সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন। একে অপরকে বিনা আহার, বিহার কোনটাতেই অংশগ্রহণ করত না। পরস্পরের প্রিয়কাজ ও প্রিয় সম্ভাষণ ছিল তাদের রীতি। এক স্বভাব দুজনের, আচরণেও দুজনে একরূপ, যেন বিধাতাপুরুষ একজনকেই দুইসত্তায় সৃষ্টি করেছেন।
মহাবীর্যশালী সর্বদাই মতৈক্য যাঁদের সেই সুন্দ ও উপসুন্দ, ত্রিভুবন জয়ের লক্ষ্যে সহমত হয়ে, দীক্ষান্তে, বিন্ধ্যপর্বতে অতি উগ্র তপস্যা শুরু করলেন। তাদের তপস্যা ছিল অতি কঠোর। জটা বল্কলধারী দুই ভাই, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় শ্রান্ত হয়ে, দীর্ঘকালীন তপস্যার উপযুক্ত হয়ে উঠল। তাদের সারা দেহ মলযুক্ত। বায়ুমাত্র ভক্ষণকারী দুই ভাই, নিজেদের মাংস যজ্ঞাহুতি প্রদান করে, ভূতলে পায়ের আঙ্গুলে ভর ন্যস্ত করে,ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, পলকহীন দৃষ্টিতে, দীর্ঘকাল ব্রত ধারণ করল। তাঁদের তপস্যার প্রভাবে উত্তপ্ত বিন্ধ্যপর্বতে ধূম উদ্গীরণ শুরু হল।
এমন সব আশ্চর্য ঘটনা ঘটতেই থাকল। তাদের উগ্র তপস্যায়, দেবতারা ভীত হলেন। তাঁরা তপস্যায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হলেন। প্রথমে, দেবতারা, রত্ন, নারী ইত্যাদির মাধ্যমে বার বার তাদের প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট হলেন। মহাতপস্বী সুন্দ ও উপসুন্দের ব্রতভঙ্গ হল না।এর পরে দেবতারা মায়ার আশ্রয় নিলেন। শূলধারী এক রাক্ষস, ভগিনী, মাতা, দাসী প্রভৃতি পরিজনদের টেনে এনে,আঘাত করতে লাগল। স্খলিত কেশাভরণ, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় অত্যাচারিতরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দুই ভাইয়ের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল নারীরা, ত্রাহীতি বাঁচাও। তবুও দুজনের কঠিন ব্রত, ভঙ্গ হল না। সুন্দ ও উপসুন্দের মনে একটুও ক্ষোভ ও দুঃখের উদ্রেক হল না যখন,তখন সেই স্ত্রীলোক ও রাক্ষসরা অন্তর্হিত হল।
মহাবীর্যশালী সর্বদাই মতৈক্য যাঁদের সেই সুন্দ ও উপসুন্দ, ত্রিভুবন জয়ের লক্ষ্যে সহমত হয়ে, দীক্ষান্তে, বিন্ধ্যপর্বতে অতি উগ্র তপস্যা শুরু করলেন। তাদের তপস্যা ছিল অতি কঠোর। জটা বল্কলধারী দুই ভাই, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় শ্রান্ত হয়ে, দীর্ঘকালীন তপস্যার উপযুক্ত হয়ে উঠল। তাদের সারা দেহ মলযুক্ত। বায়ুমাত্র ভক্ষণকারী দুই ভাই, নিজেদের মাংস যজ্ঞাহুতি প্রদান করে, ভূতলে পায়ের আঙ্গুলে ভর ন্যস্ত করে,ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, পলকহীন দৃষ্টিতে, দীর্ঘকাল ব্রত ধারণ করল। তাঁদের তপস্যার প্রভাবে উত্তপ্ত বিন্ধ্যপর্বতে ধূম উদ্গীরণ শুরু হল।
এমন সব আশ্চর্য ঘটনা ঘটতেই থাকল। তাদের উগ্র তপস্যায়, দেবতারা ভীত হলেন। তাঁরা তপস্যায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হলেন। প্রথমে, দেবতারা, রত্ন, নারী ইত্যাদির মাধ্যমে বার বার তাদের প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট হলেন। মহাতপস্বী সুন্দ ও উপসুন্দের ব্রতভঙ্গ হল না।এর পরে দেবতারা মায়ার আশ্রয় নিলেন। শূলধারী এক রাক্ষস, ভগিনী, মাতা, দাসী প্রভৃতি পরিজনদের টেনে এনে,আঘাত করতে লাগল। স্খলিত কেশাভরণ, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় অত্যাচারিতরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দুই ভাইয়ের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল নারীরা, ত্রাহীতি বাঁচাও। তবুও দুজনের কঠিন ব্রত, ভঙ্গ হল না। সুন্দ ও উপসুন্দের মনে একটুও ক্ষোভ ও দুঃখের উদ্রেক হল না যখন,তখন সেই স্ত্রীলোক ও রাক্ষসরা অন্তর্হিত হল।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮২: মা সারদার ভক্ত যোগেন মায়ের কথা
শেষে সর্বলোকের হিতাকাঙ্খী পিতামহ ব্রহ্মা,তাঁদের দুজনকে বরদান করে সন্তুষ্ট করবেন—এই উদ্দেশ্যে সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তখন সুন্দ ও উপসুন্দ এই দুই দৃঢ় পরাক্রমী বীর অঞ্জলিবদ্ধ হাতে বললেন, আমাদের তপস্যায় যদি প্রীত ও তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আমরা দুজনে যেন মায়াবিদ, অস্ত্রবিদ, বলশালী ও যথেচ্ছরূপধারী এবং অমর হতে পারি। মায়াবিদাস্ত্রবিদৌ বলিনৌ কামরূপিণৌ।উভাবপ্যমরৌ স্যাব প্রসন্নো যদি নৌ প্রভুঃ।। ব্রহ্মা বর দিলেন,অমরত্ব বিনা তোমাদের আর সব ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। মৃত্যু ব্যতীত দেবতুল্য প্রভাবশালী হবে তোমরা। ঋতেঽমরত্বং যুবয়োঃ সর্ব্বমুক্তং ভবিষ্যতি। অন্যদ্ বৃণীতং মৃত্যোশ্চ বিধানমমরৈঃ সম্মত।। যেহেতু ত্রিভুবনের প্রভুত্বই, তাদের এই কঠোর তপস্যার লক্ষ্য, তাই তারা অমরত্বলাভের যোগ্য নয়। দৈত্যদ্বয়ের কামনা পূর্ণ হল না। সুন্দ, উপসুন্দ অভয় প্রার্থনা করলেন, ত্রিলোকের স্থাবর, জঙ্গম যা কিছু প্রাণী আছে, পরস্পরের একে অন্যকে ছাড়া আর কারও থেকে আমাদের যেন কোন ভয় না থাকে। ত্রিষু লোকেষু যদ্ভূতং কিঞ্চিৎ স্থাবরজঙ্গমম্। সর্ব্বস্মান্নৌ ভয়ং ন স্যাদৃতেঽন্যোন্যং পিতামহ !।।
সবকিছুই মঞ্জুর করলেন ব্রহ্মা, শুধুমাত্র মৃত্যুর বিধান যথানিয়মেই হবে। বর লাভ করে অবধ্য দুই ভাই নিজেদের আবাসে ফিরে গেল। ব্রহ্মার বরলাভে ধন্য হলেন দুই ভাই। তাঁদের মনস্কামনা সিদ্ধ হওয়ায় সুহৃদবর্গ আনন্দিত হল। দুজনেই জটা খুলে ফেলল,বাবরি চুল ধারণ করল। মহামূল্যবান অলঙ্কার ও পরিষ্কার বসন গায়ে দিল। বন্ধুদের বিনোদনের জন্যে,অসময়ে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না নিরন্তর ধরে রাখল তারা। সব বাড়িতেই নিত্য এক রব উঠল, চর্বিতচর্বণ কর, খাও, দাও, আনন্দ কর, গান গাও, পান কর। চারিদিকে হৃষ্ট জনেদের আনন্দধ্বনি, হাঁকডাক,আনন্দকরতালির শব্দে মুখর হল দৈত্যদের নগর। আমোদ প্রমোদে কামরূপী দৈত্যদের বহু বৎসর যেন একটি দিনের মতো অতিবাহিত হল।
সবকিছুই মঞ্জুর করলেন ব্রহ্মা, শুধুমাত্র মৃত্যুর বিধান যথানিয়মেই হবে। বর লাভ করে অবধ্য দুই ভাই নিজেদের আবাসে ফিরে গেল। ব্রহ্মার বরলাভে ধন্য হলেন দুই ভাই। তাঁদের মনস্কামনা সিদ্ধ হওয়ায় সুহৃদবর্গ আনন্দিত হল। দুজনেই জটা খুলে ফেলল,বাবরি চুল ধারণ করল। মহামূল্যবান অলঙ্কার ও পরিষ্কার বসন গায়ে দিল। বন্ধুদের বিনোদনের জন্যে,অসময়ে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না নিরন্তর ধরে রাখল তারা। সব বাড়িতেই নিত্য এক রব উঠল, চর্বিতচর্বণ কর, খাও, দাও, আনন্দ কর, গান গাও, পান কর। চারিদিকে হৃষ্ট জনেদের আনন্দধ্বনি, হাঁকডাক,আনন্দকরতালির শব্দে মুখর হল দৈত্যদের নগর। আমোদ প্রমোদে কামরূপী দৈত্যদের বহু বৎসর যেন একটি দিনের মতো অতিবাহিত হল।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৫: বাথটাব/১৭
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী
আমোদ-আহ্লাদ শেষ হওয়ার পরে, সুন্দ ও উপসুন্দ ত্রিলোকবিজয়ের উদ্দেশ্যে, সুহৃদ ও মন্ত্রীগণের অনুমতিক্রমে, গদা, পট্টিশ,শূল, মুদ্গর ও বর্মধারী বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন। প্রথমেই আক্রমণের লক্ষ্য দেবলোক। দুই ভাইয়ের আগমনবার্তা জেনে দেবতারা দেবলোক থেকে আশ্রয় নিলেন ব্রহ্মলোকে। উগ্রবিক্রমশালী দুভাই যথাক্রমে সুরলোক এবং যক্ষ, রক্ষ, নভশ্চর প্রাণীদের জয় করে, নাগেদের নিবাস পাতালেও বিজয় পতাকা ওড়ালেন। সমুদ্রতীরবর্তী ম্লেচ্ছজাতিরাও বাদ গেল না। ভয়ঙ্কর শাসকদ্বয় সৈন্যদের এক কঠোর নির্দেশ দিলেন।রাজর্ষিরা মহাযজ্ঞ করেন,ব্রাহ্মণরা যজ্ঞাহুতি দান করেন।
দুই পক্ষেরই উদ্দেশ্য দেবতাদের তেজ,বল ও শ্রীবৃদ্ধি। তাই তাঁদের নির্দেশ হল, তেষামেবং প্রবৃত্তানাং সর্ব্বেষামসুরদ্বিষাম্সম্ভূয় সর্ব্বৈরস্মাভিঃ কার্য্যঃ সর্ব্বাত্মনা বধঃ।। আমাদের সকলের উচিত কাজ হল, এই কাজে প্রবৃত্ত, সেই অসুররবিদ্বেষীদের বধ করা। সুন্দ ও উপসুন্দ, স্বয়ং যজ্ঞকর্তা বা অপরের জন্যে যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণদের বলপ্রয়োগ করে হত্যা করতে লাগলেন। সৈন্যরাও শাসকদের নির্দেশানুসারে অগ্নিহোত্রযাগকারী সংযতেন্দ্রিয় মুনিদের সমস্ত যজ্ঞীয় আয়োজন নষ্ট করে দিল। ব্রহ্মাপ্রদত্ত বরের প্রভাবহেতু তপোনিধি ক্রুদ্ধ ঋষিদের অভিশাপ কার্যকর হল না। পাথর বিদ্ধ করতে ব্যর্থ তীরের মতো, অভিসম্পাতগুলি বিফল হল।
অগত্যা ব্রাহ্মণরা ক্রিয়াকর্ম পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। সংযতেন্দ্রিয়, শমগুণপ্রধান, তপস্বীরা, সুন্দ, উপসুন্দের ভয়ে, বিনতাপুত্র গরুড়ের ভয়ে ভীত নাগেদের মতো পলায়ন করলেন। অত্যাচারী রাক্ষসদ্বয়, মুনিদের আশ্রমগুলি ও হোমের উপকরণসমূহ তছনছ করলেন। কালের নিয়মে পৃথিবীর যেন শূন্যাবস্থা। সুন্দ ও উপসুন্দ, পলায়নপর রাজর্ষি ও মহর্ষিদের বধের ইচ্ছায়, খুঁজে বেড়াত। তারা দুজন, কখনও বাঘ, কখনও সিংহের রূপ ধরে কখনও লুক্কায়িত থেকে মুনিদের দেখামাত্র হত্যা করত। যজ্ঞ ও বেদপাঠ বন্ধ হল, রাজা ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হল।
পৃথিবী, উৎসবাদির সমারোহের অভাবে, যজ্ঞহীনা হল। সর্বত্র হাহাকার ধ্বনি, ক্রয়বিক্রয়স্থান থাকল না। দেবকার্য ব্যহত হল, পুণ্যকাজ ও বিবাহাদি সংস্কার আর রইল না। কৃষি ও গোরক্ষা ব্যহত হল। নগর ও আশ্রমগুলি বিনষ্ট হল। অস্থি ও কঙ্কালসার হল পৃথিবীর রূপ। পিতৃকার্য ও দেবতাদের হবির্দানের সময়ে উচ্চারিত বষট্-শব্দ আর ধ্বনিত হল না। সুন্দ ও উপসুন্দের ক্রিয়াকলাপ দেখে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, সপ্তর্ষিমণ্ডলে স্থিত তারারা, নক্ষত্রপুঞ্জ, ব্রহ্মলোকে অবস্থানকারী দেবতারা বিষণ্ণ হলেন। এইভাবে নিষ্ঠুর কাজ করে, সর্বদিকজয়ী, শত্রুহীন দুই ভাই, সুন্দ ও উপসুন্দ, কুরুক্ষেত্রে রাজধানী স্থাপন করল।
দুই পক্ষেরই উদ্দেশ্য দেবতাদের তেজ,বল ও শ্রীবৃদ্ধি। তাই তাঁদের নির্দেশ হল, তেষামেবং প্রবৃত্তানাং সর্ব্বেষামসুরদ্বিষাম্সম্ভূয় সর্ব্বৈরস্মাভিঃ কার্য্যঃ সর্ব্বাত্মনা বধঃ।। আমাদের সকলের উচিত কাজ হল, এই কাজে প্রবৃত্ত, সেই অসুররবিদ্বেষীদের বধ করা। সুন্দ ও উপসুন্দ, স্বয়ং যজ্ঞকর্তা বা অপরের জন্যে যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণদের বলপ্রয়োগ করে হত্যা করতে লাগলেন। সৈন্যরাও শাসকদের নির্দেশানুসারে অগ্নিহোত্রযাগকারী সংযতেন্দ্রিয় মুনিদের সমস্ত যজ্ঞীয় আয়োজন নষ্ট করে দিল। ব্রহ্মাপ্রদত্ত বরের প্রভাবহেতু তপোনিধি ক্রুদ্ধ ঋষিদের অভিশাপ কার্যকর হল না। পাথর বিদ্ধ করতে ব্যর্থ তীরের মতো, অভিসম্পাতগুলি বিফল হল।
অগত্যা ব্রাহ্মণরা ক্রিয়াকর্ম পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। সংযতেন্দ্রিয়, শমগুণপ্রধান, তপস্বীরা, সুন্দ, উপসুন্দের ভয়ে, বিনতাপুত্র গরুড়ের ভয়ে ভীত নাগেদের মতো পলায়ন করলেন। অত্যাচারী রাক্ষসদ্বয়, মুনিদের আশ্রমগুলি ও হোমের উপকরণসমূহ তছনছ করলেন। কালের নিয়মে পৃথিবীর যেন শূন্যাবস্থা। সুন্দ ও উপসুন্দ, পলায়নপর রাজর্ষি ও মহর্ষিদের বধের ইচ্ছায়, খুঁজে বেড়াত। তারা দুজন, কখনও বাঘ, কখনও সিংহের রূপ ধরে কখনও লুক্কায়িত থেকে মুনিদের দেখামাত্র হত্যা করত। যজ্ঞ ও বেদপাঠ বন্ধ হল, রাজা ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হল।
পৃথিবী, উৎসবাদির সমারোহের অভাবে, যজ্ঞহীনা হল। সর্বত্র হাহাকার ধ্বনি, ক্রয়বিক্রয়স্থান থাকল না। দেবকার্য ব্যহত হল, পুণ্যকাজ ও বিবাহাদি সংস্কার আর রইল না। কৃষি ও গোরক্ষা ব্যহত হল। নগর ও আশ্রমগুলি বিনষ্ট হল। অস্থি ও কঙ্কালসার হল পৃথিবীর রূপ। পিতৃকার্য ও দেবতাদের হবির্দানের সময়ে উচ্চারিত বষট্-শব্দ আর ধ্বনিত হল না। সুন্দ ও উপসুন্দের ক্রিয়াকলাপ দেখে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, সপ্তর্ষিমণ্ডলে স্থিত তারারা, নক্ষত্রপুঞ্জ, ব্রহ্মলোকে অবস্থানকারী দেবতারা বিষণ্ণ হলেন। এইভাবে নিষ্ঠুর কাজ করে, সর্বদিকজয়ী, শত্রুহীন দুই ভাই, সুন্দ ও উপসুন্দ, কুরুক্ষেত্রে রাজধানী স্থাপন করল।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭০: অনিশ্চিত ফলের পিছনে না ছুটে নিশ্চিত ফল-প্রদায়ক কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ
মহর্ষি, দেবতারা, ব্রহ্মর্ষি, বিষ্ণু, শিব, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, শুক্র, ব্রহ্মার মানসপুত্র মরীচি সকলে যখন ব্রহ্মলোকে অবস্থান করছিলেন, সেই সময়ে বৈখাধস, বালখিল্য, বানপ্রস্থ, মরীচিপ অর্থাৎ সৌরকিরণভক্ষণকারীমুনিগণ, বিষ্ণূপাসকেরা, মোহমুক্ত ও অন্তর যাঁদের তোজোগর্ভ এমন তপস্বী ঋষিগণ সকলে, প্রতীকারের জন্যে, পিতামহ ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। ত্রিভুবন জয়ী সুন্দ ও উপসুন্দের রাজ্যজয়ের পন্থা ও ক্রম-সহ সব কাজের বর্ণনা করলেন। ব্রহ্মা, সুন্দ ও উপসুন্দকে দমন করবার উপায় চিন্তা করে, বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিলেন, সৃজ্যতাং প্রার্থনীয়ৈকা প্রমদেতি মহাতপাঃ।
সকলের প্রার্থনীয়া, এক রমণী সৃষ্টি কর। বিশ্বকর্মা, বিশ্বচরাচরের প্রাণীদের যা কিছু উত্তম সেগুলি চয়ন করে দর্শনীয়া এক নারী সৃষ্টি করলেন, সুরনারীতুল্যা সেই নারীর দেহে কোটি কোটি রত্ন। অনুপমা সেই কন্যার শরীরের কোনও অংশই দর্শনীয় নয় এমন নয়। দেহ ধারণ করে, সুদর্শনা, সুতন্বী, মূর্তিমতী সেই কন্যা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হয়ে, বললেন, কিং করোমীতি আমায় কী করতে হবে?
প্রীত ব্রহ্মা সেই কন্যাকে বর দিলেন, কান্তত্বং সর্ব্বভূতানাং সা শ্রিয়ানুত্তমং বপুঃ। তুমি সব প্রাণীদের মধ্যে কমনীয়তায় এবং সৌন্দর্যের নিরিখে সর্বোত্তম দেহের অধিকারিণী হও। সকল প্রাণীর নয়ন ও মনোহারিণী সেই কন্যাকে বিশ্বকর্মা তিল তিল করে শ্রেষ্ঠ বস্তু চয়ন করে নির্মাণ করেছিলেন, তাই ব্রহ্মা তাঁর নামকরণ করলেন তিলোত্তমা। তিলং তিলং সম্মানীয় রত্নানাং যদ্বিনির্ম্মিতা। তিলোত্তমেতি তত্তস্যা নাম চক্রে পিতামহঃ।। ব্রহ্মার নির্দেশে,রূপের আকর্ষণ সৃষ্টি করে, দর্শনমাত্র সুন্দ ও উপসুন্দের মনে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বিরোধ-সৃষ্টি, হল তিলোত্তমার লক্ষ্য। ত্রিভুবনের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে সুন্দ ও উপসুন্দ বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। একদা তারা দুই ভাই বিন্ধ্যপর্বতের সমভূমিতে কুসুমিত শালবনে বিহার করছিলেন।
একদা, নৃত্যগীতরতা রমণী পরিবৃত হয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায় রয়েছে সুন্দ ও উপসুন্দ। রক্তবর্ণবসনে সজ্জিতা হয়ে, পুরুষের চিত্তাকর্ষক রূপ ধারণ করে, পুষ্পচয়নরতা তিলোত্তমা, নদীতীরে প্রস্ফুটিত স্থলপদ্ম চয়ন করতে করতে সেইখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে,সুরাপানের ফলে আরক্তনয়ন, দুই ভাই কামোন্মত্ত হল। দুজনেই কামোন্মাদনাবশত কামনা করল সেই এক নারীকে। দুজনের মধ্যে সুন্দ উপসুন্দকে বললেন, আমার স্ত্রী তোর গুরু স্থানীয়া। মম ভার্যা তব গুরুরিতি উপসুন্দ সমান স্পর্ধাভরে উত্তর দিলেন, মম ভার্যা তব বধূঃ আমার ভার্যা তোর পুত্রবধূ। দুজনের এক কথা—নৈষা তব মমৈষেতি এ তোমার নয় শুধু আমার।দুজনের ভাবভালবাসা অন্তর্হিত হল। অহং পূর্ব্বমহং পূর্ব্বমিত্যন্যোন্যং নিজঘ্নতুঃ। আমি একে আগে ভোগ করব, আমি আগে এমন বলতে বলতে, গদা হাতে কামোন্মত্ত দুই ভাই পরস্পরকে আঘাত করতে থাকলেন। রক্তাক্ত দেহে, ভূপতিত সুন্দ ও উপসুন্দের মৃত্যু হল। ব্রহ্মার আশীর্বাদে তিলোত্তমার স্থান হল সূর্যলোকে, তাঁর তেজের প্রভাবে তিনি যেন কারও দৃষ্টিগোচর না হন।
সকলের প্রার্থনীয়া, এক রমণী সৃষ্টি কর। বিশ্বকর্মা, বিশ্বচরাচরের প্রাণীদের যা কিছু উত্তম সেগুলি চয়ন করে দর্শনীয়া এক নারী সৃষ্টি করলেন, সুরনারীতুল্যা সেই নারীর দেহে কোটি কোটি রত্ন। অনুপমা সেই কন্যার শরীরের কোনও অংশই দর্শনীয় নয় এমন নয়। দেহ ধারণ করে, সুদর্শনা, সুতন্বী, মূর্তিমতী সেই কন্যা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হয়ে, বললেন, কিং করোমীতি আমায় কী করতে হবে?
প্রীত ব্রহ্মা সেই কন্যাকে বর দিলেন, কান্তত্বং সর্ব্বভূতানাং সা শ্রিয়ানুত্তমং বপুঃ। তুমি সব প্রাণীদের মধ্যে কমনীয়তায় এবং সৌন্দর্যের নিরিখে সর্বোত্তম দেহের অধিকারিণী হও। সকল প্রাণীর নয়ন ও মনোহারিণী সেই কন্যাকে বিশ্বকর্মা তিল তিল করে শ্রেষ্ঠ বস্তু চয়ন করে নির্মাণ করেছিলেন, তাই ব্রহ্মা তাঁর নামকরণ করলেন তিলোত্তমা। তিলং তিলং সম্মানীয় রত্নানাং যদ্বিনির্ম্মিতা। তিলোত্তমেতি তত্তস্যা নাম চক্রে পিতামহঃ।। ব্রহ্মার নির্দেশে,রূপের আকর্ষণ সৃষ্টি করে, দর্শনমাত্র সুন্দ ও উপসুন্দের মনে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বিরোধ-সৃষ্টি, হল তিলোত্তমার লক্ষ্য। ত্রিভুবনের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে সুন্দ ও উপসুন্দ বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। একদা তারা দুই ভাই বিন্ধ্যপর্বতের সমভূমিতে কুসুমিত শালবনে বিহার করছিলেন।
একদা, নৃত্যগীতরতা রমণী পরিবৃত হয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায় রয়েছে সুন্দ ও উপসুন্দ। রক্তবর্ণবসনে সজ্জিতা হয়ে, পুরুষের চিত্তাকর্ষক রূপ ধারণ করে, পুষ্পচয়নরতা তিলোত্তমা, নদীতীরে প্রস্ফুটিত স্থলপদ্ম চয়ন করতে করতে সেইখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে,সুরাপানের ফলে আরক্তনয়ন, দুই ভাই কামোন্মত্ত হল। দুজনেই কামোন্মাদনাবশত কামনা করল সেই এক নারীকে। দুজনের মধ্যে সুন্দ উপসুন্দকে বললেন, আমার স্ত্রী তোর গুরু স্থানীয়া। মম ভার্যা তব গুরুরিতি উপসুন্দ সমান স্পর্ধাভরে উত্তর দিলেন, মম ভার্যা তব বধূঃ আমার ভার্যা তোর পুত্রবধূ। দুজনের এক কথা—নৈষা তব মমৈষেতি এ তোমার নয় শুধু আমার।দুজনের ভাবভালবাসা অন্তর্হিত হল। অহং পূর্ব্বমহং পূর্ব্বমিত্যন্যোন্যং নিজঘ্নতুঃ। আমি একে আগে ভোগ করব, আমি আগে এমন বলতে বলতে, গদা হাতে কামোন্মত্ত দুই ভাই পরস্পরকে আঘাত করতে থাকলেন। রক্তাক্ত দেহে, ভূপতিত সুন্দ ও উপসুন্দের মৃত্যু হল। ব্রহ্মার আশীর্বাদে তিলোত্তমার স্থান হল সূর্যলোকে, তাঁর তেজের প্রভাবে তিনি যেন কারও দৃষ্টিগোচর না হন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া
মহর্ষি নারদ এই কাহিনি বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। সুন্দ ও উপসুন্দ ঐক্যবদ্ধ এবং সমস্ত বিষয়ে সহমত হয়েও তিলোত্তমার কারণেই এক অপরের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে, পরস্পরকে হত্যা করেছিলেন। তাই দেবর্ষির উপদেশ, দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে তোমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না হয় এমন কিছু কর, যাতে আমি প্রীত হই। পাণ্ডবরা এক নিয়ম করলেন। একৈকস্য গৃহে কৃষ্ণা বসেদ্বর্ষমকল্মষা। অপাপবিদ্ধা দ্রৌপদী আমাদের এক একজনের গৃহে এক বৎসরকাল অবস্থান করবেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বসবাসের সময়ে অন্য কোনও (ভাই) যদি দ্রৌপদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তবে তাঁকে ব্রহ্মচারী হয়ে, বার বছরের জন্যে বনে বাস করতে হবে। দ্রৌপদ্যা নঃ সহাসীনানন্যোন্যং যো২ভিদর্শয়েৎ।স নো দ্বাদশ বর্ষাণি ব্রহ্মচারী বনে বসেৎ।। নারদের উপদেশানুসারে এই নিয়ম পালন করায়,পাণ্ডবদের মধ্যে কোনওদিন বিভেদ সৃষ্টি হয়নি।
পঞ্চ পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর দাম্পত্য এবং সম্পর্কের জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে, মহর্ষি নারদের তিলোত্তমার কাহিনির অবতারণা যেন নারী ও পুরুষের সম্পর্কের এক নতুন দিগ্দর্শন। দ্রৌপদী যদি হন তিলোত্তমাতুল্যা এক নারী, পঞ্চ পাণ্ডব তাঁকে কেন্দ্র করে সুন্দ ও উপসুন্দের পর্যায়ভুক্ত যুযুধান পাঁচ পুরুষ যেন —এমনটাই স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে। মাতৃ-আজ্ঞা ছিল সমেত্য ভুঙ্ক্তেতি। সকলে মিলে ভোগ কর। দ্রৌপদী পাঁচ জনের স্ত্রী হবেন, এ সিদ্ধান্ত জেনে তাঁদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হল? তেষান্তু দ্রৌপদীং দৃষ্ট্বা সর্ব্বেষামমিতৌজসাম্। সম্প্রমথ্যেন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসীন্মনোভবঃ।। দ্রৌপদীকে দেখে সেই অমিত তেজোবান তাঁরা, সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযমের বাঁধনভাঙ্গা মানসিকতায় উপনীত হয়েছিলেন।
দ্রৌপদী এই নারীরত্ন। তাঁকে বিধাতা সকলের মনোহারিণী রূপে সৃষ্টি করেছেন, বভূবাধিকমন্যাভ্যঃ সর্ব্বভূতমনোহরাম্। তিলোত্তমার সঙ্গে কোনও পার্থক্যই নেই তাঁর। তিলোত্তমার সৃষ্টি হয়েছিল অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে। সুন্দ ও উপসুন্দের অত্যাচার দূর করবার জন্যে ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করেছিলেন। দ্রৌপদীসৃষ্টির লক্ষ্য ছিল কুরুবংশধ্বংস। দুজনেরই দৈবোৎপত্তি। দুজনেই এক বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের উদ্দেশ্যে জন্ম। মধ্যে রয়েছে মানুষের কামোন্মত্ততার প্রতি সন্দেহ ও আশঙ্কা,এক সাধারণ জৈবিক প্রবৃত্তিকে অনুশাসনের লাগাম দিয়ে নিয়মে বাঁধবার প্রয়াস।
পঞ্চ পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর দাম্পত্য এবং সম্পর্কের জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে, মহর্ষি নারদের তিলোত্তমার কাহিনির অবতারণা যেন নারী ও পুরুষের সম্পর্কের এক নতুন দিগ্দর্শন। দ্রৌপদী যদি হন তিলোত্তমাতুল্যা এক নারী, পঞ্চ পাণ্ডব তাঁকে কেন্দ্র করে সুন্দ ও উপসুন্দের পর্যায়ভুক্ত যুযুধান পাঁচ পুরুষ যেন —এমনটাই স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে। মাতৃ-আজ্ঞা ছিল সমেত্য ভুঙ্ক্তেতি। সকলে মিলে ভোগ কর। দ্রৌপদী পাঁচ জনের স্ত্রী হবেন, এ সিদ্ধান্ত জেনে তাঁদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হল? তেষান্তু দ্রৌপদীং দৃষ্ট্বা সর্ব্বেষামমিতৌজসাম্। সম্প্রমথ্যেন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসীন্মনোভবঃ।। দ্রৌপদীকে দেখে সেই অমিত তেজোবান তাঁরা, সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযমের বাঁধনভাঙ্গা মানসিকতায় উপনীত হয়েছিলেন।
দ্রৌপদী এই নারীরত্ন। তাঁকে বিধাতা সকলের মনোহারিণী রূপে সৃষ্টি করেছেন, বভূবাধিকমন্যাভ্যঃ সর্ব্বভূতমনোহরাম্। তিলোত্তমার সঙ্গে কোনও পার্থক্যই নেই তাঁর। তিলোত্তমার সৃষ্টি হয়েছিল অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করবার উদ্দেশ্যে। সুন্দ ও উপসুন্দের অত্যাচার দূর করবার জন্যে ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করেছিলেন। দ্রৌপদীসৃষ্টির লক্ষ্য ছিল কুরুবংশধ্বংস। দুজনেরই দৈবোৎপত্তি। দুজনেই এক বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের উদ্দেশ্যে জন্ম। মধ্যে রয়েছে মানুষের কামোন্মত্ততার প্রতি সন্দেহ ও আশঙ্কা,এক সাধারণ জৈবিক প্রবৃত্তিকে অনুশাসনের লাগাম দিয়ে নিয়মে বাঁধবার প্রয়াস।
ছবি: প্রতীকী।
সুন্দ ও উপসুন্দ রয়েছে পুরুষদের মনের গভীরে। তিলোত্তমার মনোমোহিনী রূপ দেখে, কামোন্মাদনায় মাথা চাড়া দেয় অন্তর্নিহিত রাক্ষসদ্বয়ের বৃত্তি।পঞ্চ পাণ্ডব এই বৃত্তির ঊর্দ্ধে নন।মানুষের জৈবপ্রবৃত্তির বশে নারীভোগেচ্ছা, স্বাভাবিকনিয়মেই মনে আসে। তিলোত্তমারাই, প্রেরণাময়ী, স্ত্রীরূপে এই জৈবিক প্রবৃত্তিকে সংযমে শাসিত করে থাকেন। পাণ্ডবভাইদের জৈবিক প্রবৃত্তিকে অনুশাসনের নিয়মে বাঁধতে চেয়েছেন দূরদর্শী মহর্ষি নারদ। দ্রৌপদী এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে সফল হয়েছেন।
সব নারীর মধ্যেই হয়তো আছে সর্বোত্তমার নির্যাস। বিশ্বকর্মা তিলোত্তমাকে তিল তিল করে সৌন্দর্য আহরণ করে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রত্যেক নারীর মধ্যেই হয়তো তিলোত্তমার মতো সর্বোত্তমার সম্ভাবনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। দুই নারী পুরুষের তিল তিল করে গড়ে ওঠা, মিলিত অনেক স্বপ্ন চয়নের ফল হলেন একেকটি তিলোত্তমা। তিলোত্তমার জন্ম সার্থক হয় অশুভ শক্তির ধ্বংসার্থে,কেউ আবার নিজের দীপ্তির জৌলুসে মিশে যান সূর্যপ্রভায়। সব তিলোত্তমাই, সূর্যপ্রভাসম দীপ্তিময়ী, দৈহিক সৌন্দর্য তো বাইরের আবরণ, আন্তরসৌন্দর্য তাঁদের করে তুলেছে মহীয়সী। পুরুষের কামোন্মাদনা সেই মনোহর সৌন্দর্য মুছে ফেলতে পারে না। তাঁরা নিজেরা ভোগ্য বা উপভোগ্য যাই হন,জৈবিক চাহিদার এই ক্লেদ কাটিয়ে ওঠেন আত্মশক্তিতে,স্বমহিমায় তাঁরা উজ্জ্বল। দ্রৌপদী পঞ্চ স্বামীর স্ত্রী। তিনি নিয়মানুসারে বাৎসরিক কাল ঘর করেছেন একেকজন স্বামীর সঙ্গে। মহাভারতে তাঁর উপস্থিতি কিরণময়ীর ভূমিকায়। তাঁকে ঘিরেই ভারতযুদ্ধের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। পঞ্চ স্বামী তাঁকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। স্বামীরা, আপোষহীন, দ্বন্দ্বময়, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, সেই স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করেছেন। জীবনযুদ্ধে পাণ্ডবদের সহযোদ্ধা হয়েছেন দ্রৌপদী। তাঁর এই স্বামীদের সহবাসের শর্ত মানুষ মনে রাখেনি। মনে রেখেছে আত্মদীপ্তিতে উজ্জ্বলা এক নারীকে।
ত্রিলোকের শঙ্কা হরণ করেছিলেন তিলোত্তমা, তার পরে তাঁর দীপ্তির বিভায় কোনও অশুভ দৃষ্টির কালিমা তাঁকে কলুষিত করতে পারেনি। তিনি অপাপবিদ্ধা রয়েছেন। তিলোত্তমারা ধর্ষিতা, নিপীড়িতা, নির্যাতিতা হলেও নিজেদের তিল তিল করে গড়ে তোলা সৌন্দর্যের আলোয় আলোকময়ী, অনবদ্যা, অনন্যারূপে বন্দিতা হন যুগে যুগে। —চলবে।
সব নারীর মধ্যেই হয়তো আছে সর্বোত্তমার নির্যাস। বিশ্বকর্মা তিলোত্তমাকে তিল তিল করে সৌন্দর্য আহরণ করে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রত্যেক নারীর মধ্যেই হয়তো তিলোত্তমার মতো সর্বোত্তমার সম্ভাবনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। দুই নারী পুরুষের তিল তিল করে গড়ে ওঠা, মিলিত অনেক স্বপ্ন চয়নের ফল হলেন একেকটি তিলোত্তমা। তিলোত্তমার জন্ম সার্থক হয় অশুভ শক্তির ধ্বংসার্থে,কেউ আবার নিজের দীপ্তির জৌলুসে মিশে যান সূর্যপ্রভায়। সব তিলোত্তমাই, সূর্যপ্রভাসম দীপ্তিময়ী, দৈহিক সৌন্দর্য তো বাইরের আবরণ, আন্তরসৌন্দর্য তাঁদের করে তুলেছে মহীয়সী। পুরুষের কামোন্মাদনা সেই মনোহর সৌন্দর্য মুছে ফেলতে পারে না। তাঁরা নিজেরা ভোগ্য বা উপভোগ্য যাই হন,জৈবিক চাহিদার এই ক্লেদ কাটিয়ে ওঠেন আত্মশক্তিতে,স্বমহিমায় তাঁরা উজ্জ্বল। দ্রৌপদী পঞ্চ স্বামীর স্ত্রী। তিনি নিয়মানুসারে বাৎসরিক কাল ঘর করেছেন একেকজন স্বামীর সঙ্গে। মহাভারতে তাঁর উপস্থিতি কিরণময়ীর ভূমিকায়। তাঁকে ঘিরেই ভারতযুদ্ধের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। পঞ্চ স্বামী তাঁকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। স্বামীরা, আপোষহীন, দ্বন্দ্বময়, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, সেই স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করেছেন। জীবনযুদ্ধে পাণ্ডবদের সহযোদ্ধা হয়েছেন দ্রৌপদী। তাঁর এই স্বামীদের সহবাসের শর্ত মানুষ মনে রাখেনি। মনে রেখেছে আত্মদীপ্তিতে উজ্জ্বলা এক নারীকে।
ত্রিলোকের শঙ্কা হরণ করেছিলেন তিলোত্তমা, তার পরে তাঁর দীপ্তির বিভায় কোনও অশুভ দৃষ্টির কালিমা তাঁকে কলুষিত করতে পারেনি। তিনি অপাপবিদ্ধা রয়েছেন। তিলোত্তমারা ধর্ষিতা, নিপীড়িতা, নির্যাতিতা হলেও নিজেদের তিল তিল করে গড়ে তোলা সৌন্দর্যের আলোয় আলোকময়ী, অনবদ্যা, অনন্যারূপে বন্দিতা হন যুগে যুগে। —চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।