শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

ইডেন/ সামনে ছোট্ট লেক/ আউটডোর/ দুপুর

জলের দিকে চেয়ে মুকুল। ওঁর দিকে পিঠ করে বসে অমলেন্দু।

অমলেন্দু: শুদ্ধু টাকার জন্যে চান্সটা হাত থেকে বেরিয়ে গেল। শুনলুম একটা এয়ারলাইন্স ধারে টিকিট দেয়। কিন্তু সেখানেও কিছুটা অ্যাডভান্স দিতেই হবে।
মুকুল জলের দিকে চেয়ে বলে —

মুকুল: আরও তো তিনদিন সময় আছে!

অমলেন্দু ম্লান হাসে তারপর মুকুলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে—

অমলেন্দু: মিস্টার জ্যামিশনের কাছ থেকে আজই একটা টেলিগ্রাম এসেছে মুকুল। Schedule Date -এ reach না করলে—

মুকুল: তুমি schedule date-এই reach করবে।

অমলেন্দু সামান্য হেসে মাটিতে ঘুসি মেরে বলে—

অমলেন্দু: Hope! Sweet Hope!

মুকুল পার্সখুলে একটা মোটা খাম বের করে অমলেন্দুকে বাড়িয়ে দেয়—

মুকুল: এটা রাখো

অমলেন্দু পাশ ফেরে —

অমলেন্দু: কী এটা?

উঠে বসে খামটা নেয়। মুকুল হাসছে।

মুকুল: কাল সকালেই এয়ারলাইন্স অফিসে জমা দিয়ে আসবে।

অমলেন্দু ইতিমধ্যে খামটা খুলেছে। গোটা পঞ্চাশ-ষাট একশো টাকার নোট।

অমলেন্দুর হাতে ধরা টাকাটার — ক্লোজআপ

আজ থেকে ৩৭ বছর আগের লেখা একটি চিত্রনাট্যের অংশবিশেষ। ১৯৮৬-তে দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা সম্প্রচার করেছিলেন প্রথম স্পনসর্ড সিরিয়াল। শঙ্কর বা মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘সোনার সংসার’ অবলম্বনে নির্মিত ১৩ পর্বের এই ধারাবাহিক প্রযোজনা করেছিল ইনফোকম সংস্থা। চিত্রনাট্য লিখে দূরদর্শনের অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছিল এক বছর আগে ১৯৮৫-তে। ‘৮৬-তে সোনার সংসারের প্রায় সমসাময়িক ধারাবাহিক ‘তেরো পার্বণ’ শুরু হল ক’দিন পরেই।

এই সোনার সংসারে নায়ক অমলেন্দুর ভূমিকায় ছিলেন সদ্যপ্রয়াত প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। নায়িকা মুকুলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রথিতযশা অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার। ছিলেন নেপাল নাগ, স্মিতা সিনহা’র মতো গুণী অভিনেতা অভিনেত্রীরা। অমলেন্দুর ছোট ভাই দিবাকরের ভূমিকায় ছিল সে সময়ে জনপ্রিয় শিলাদিত্য পত্রনবীস। অগ্রদূত গোষ্ঠীর সদস্য নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালনা করেছিলেন। আর অনবদ্য আবহসংগীত রচনা করেছিলেন সঙ্গীত জাদুকর সলিল চৌধুরীর ছেলে সঞ্জয় চৌধুরী (পিপি)। এই নিবেদনে আমার সুযোগ ঘটেছিল সোনার সংসার-এর চিত্রনাট্য রচনা’র।
এই ধারাবাহিকের শ্যুটিংয়ের ১০ বছর আগে ১৯৭৬ সালে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে সত্যজিৎ রায়ের দেশে স্বর্ণকমল এবং বিদেশে কার্লোভিভ্যারি পুরস্কারে ভূষিত জন-অরণ্য। প্রসঙ্গক্রমে এটিও মণিশংকর মুখোপাধ্যায় রচিত এক কাল জয়ী উপন্যাস। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার অ্যাকাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ সত্যজিৎ রায়ের জন-অরণ্য ছবিটি সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শিকাগো রিডার পত্রিকা এই ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। জনাথান রোসেনবাম, জন অরণ্য-কে সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি বলে বর্ণনা করেন এবং বিলি ওয়াইল্ডারের ‘দ্য অ্যাপার্টমেন্ট’ এবং জন কাসসাভেটেস এর ছবি‘ফেসেস’ এর সঙ্গে তুলনা করেন।

আজকের সময়ে একজন এত প্রশংসিত চিত্রাভিনেতার যে ধরনের হাবভাব হতে পারে, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে তার লেশমাত্র ছিল না। ধারাবাহিকের অন্যতম প্রধান চরিত্রাভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায় সম্ভবত অন্যান্য সহ অভিনেতার থেকেও চুপচাপ থাকতেন। স্বল্পভাষী নিপাট ভদ্রলোক অভিনেতা। যাঁর অভিনীত চরিত্রেরা দ্যুতিময় হয়ে থেকে গিয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে চুপচাপ থেকেছেন।
সে সময় ধারাবাহিক কেমন হবে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। প্রতি শুক্রবার রাতে দেখানো হতো হরলিক্স নিবেদিত সোনার সংসার। এক সপ্তাহের পর আবার পরের সপ্তাহে পরের পর্ব। আজকের ডেইলি সোপের যুগে সে সব ভাবাই যায় না। সেই সময়টা ধরা নেই। হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে অমলেন্দু।

চিত্রনাট্যে যে অংশটি রয়েছে, সেটি খুবই নাটকীয়। কারণ, মুকুল তার মৃত মায়ের একটা ভারী সোনার হার পরেছিল বলে প্রেমিক অমলেন্দু বলেছিল ‘এত দামি হার খুব সাবধানে রেখো।’ আমেরিকায় একটা কাজের সুযোগ শুধু প্লেনের টিকিটের টাকা জোগাড় হয়নি বলে হাতছাড়া হতে বসেছিল। মুকুল সেই হারটা বিক্রি করেই অমলেন্দুকে টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছিল। পরে অমলেন্দুর মধ্যে একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ কাজ করতো। কারণ, তখন তার জীবনে এসেছে এক বিদেশিনি বান্ধবী।
জন অরণ্যের সোমনাথও, সৎ ভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। পরিশ্রম করে নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। নিজের অজান্তেই এই জন-অরণ্যে সে এক মিডলম্যান বা দালাল হয়ে উঠেছিল। তাই সোমনাথ তার আদর্শবাদী বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারে না।

অভিনীত চরিত্রের এই সূক্ষ্ম টানাপোড়েন, মুখের সামান্য অভিব্যক্তির পরিবর্তনে যিনি অক্লেশে ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে পর্দায় চারিয়ে দিতে পারতেন, সেই সোমনাথ বা প্রদীপ মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন।

সোনার সংসার ধারাবাহিকের অংশ বিশেষ।

শ্যুটিং ফ্লোরে অল্প আলাপ ছাড়া ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু ওঁর কথা ভেবেই যেন হালে আমার লেখা বহুরূপী নিবেদিত ‘রোদ্দুর ও অমলকান্তি’ নাটকে সোমনাথ চরিত্রটি ফিরে এসেছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি কবিতা অবলম্বনে এই নাটকের মূল চরিত্র চোখে দেখতে পেত কিন্তু এক দুরারোগ্য চোখের অসুখে এখন অন্ধ। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা-সহ নানান বাংলা সিনেমার অন্ধভক্ত এই মানুষটি, এখন বন্ধুহীন- স্বজনহীন। সে তার অন্ধকার জগতে আলো খোঁজে। মানস-ভ্রমণে তাঁর বন্ধু হিসেবে ফিরে পায় সত্যজিৎ, তপন সিনহার ছবির নানান চরিত্রকে। এ ভাবেই তাঁর দেখা জন অরণ্যের সোমনাথ আর মহানগরের বাণীর সঙ্গে। এই নাটকের অভিনয় চলতে থাকলে প্রদীপদাকে হয়তো দেখতে আসতে অনুরোধ করতাম। তা আর হল না।
পর্দায় খারাপ মানুষের চরিত্র করাটা কতটা শক্ত সেটা জানি না। তবে নির্ভেজাল ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করাটা কিন্তু বেশ কঠিন কাজ। যে মানুষ ভালো থাকতে চায় কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার জন্যে নিজের অজান্তেই আদর্শচ্যুত হয়ে পড়ে, এমন দোটানায় বাঁধা চরিত্রগুলো যেন তাঁর জন্যই লেখা হয়েছিল।

নক্ষত্র নাট্যদলে অভিনয় জীবন শুরু। প্রথম ছবিতেই পুরস্কারের বন্যা। তারপর দৌড়, দূরত্ব, অশ্লীলতার দায়ে, চপার, সতী, শাখা-প্রশাখা, দহন, উৎসব, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, গয়নার বাক্স-সহ চল্লিশের বেশি ছবিতে নিজের অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

প্রচারবিমুখ এই গুণী অভিনেতা তাঁর অভিনীত চরিত্রের মধ্যে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content