রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবির একটি দৃশ্যে সৌরসেনী।

 

তাজ সিজন ২: প্রতিশোধের রাজত্ব

ভাষা: হিন্দি, তামিল, তেলেগু
সৃজন: অভিমন্যু সিং
কাহিনি বিন্যাস : ক্রিস্টোফার বুটেরা
চিত্রনাট্য: উইলিয়াম বর্থুইক এবং সায়মন ফ্যান্টাওজো
সংলাপ: অজয় সিং
পরিচালনা: রণ স্ক্যালপেলো এবং বিভু পুরি
অভিনয়ে: ধর্মেন্দ্র, নাসিরুদ্দিন শাহ, অসীম গুলাটি, সৌরসেনী মৈত্র, রাহুল বোস, জারিনা ওয়াহাব, সন্ধ্যা মৃদুল প্রমুখ
পর্ব: ৮টি

মুঘল সাম্রাজ্যের নির্বাসিত রাজকুমার থেকে পরবর্তী সম্রাট হওয়ার রক্তাক্ত শত্রু পরিবেষ্টিত পরিস্থিতিতে সেলিমের যাত্রা। এই অন্ধকার, বিপজ্জনক এবং ধ্বংসাত্মক পথে, তাকে চারদিক থেকে শত্রুরা ঘিরে রেখেছে এবং তাঁকে নতুন বিপদে ফেলতে চাইছে। শুধুমাত্র নতুন প্রেমিকা বুদ্ধিদীপ্ত মেহেরুন্নিসা তাঁর পাশে, তাঁর সহায়।

জাহাঙ্গীর হয়ে ওঠার পিছনে সেলিমের নিজস্ব পরাক্রম ও অনমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগ হয়ে উঠেছিল এই সুন্দরী প্রণয়ী মেহেরুন্নিসার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মেধা। আর মেহেরুন্নিসার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকায় সৌরসেনী মৈত্রের অত্যন্ত সাবলীল এবং সফল অভিনয় আমাদের চমৎকৃত করে। সারা বিশ্বে সমাদৃত এই সর্বভারতীয় ওয়েবসিরিজের দ্বিতীয় অধ্যায়ে নাটকীয় কেন্দ্রীয় চরিত্রে নজরকাড়া অভিনয় করেছেন বঙ্গতনয়া সৌরসেনী।
তাজের প্রমোশনাল ভিডিয়োতে সৌরসেনী মেহেরুন্নিসার চরিত্র নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, এটি তার জীবনের একটি স্বপ্নের চরিত্র। তাজ হয়তো তার জন্যই তৈরি হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে আকবর ও মেহেরুন্নিসার কোন আলাদা দৃশ্য ছিল না। তার কথাতেই জানা গেছে যে এই দৃশ্য পরে ভাবা হয়েছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌরসেনী স্বীকার করেছেন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে কখনও তিনি নাসিরুদ্দিন শাহ’র মতো একজন বিশাল মাপের অভিনেতা সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করবেন।

এও জানিয়েছেন, প্রতিটি দৃশ্যের জন্যই তিনি মন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করবার চেষ্টা করেছেন। তাই সবকটি দৃশ্যই তার কাছে প্রিয়। তবে কঠিনতম দৃশ্য নিশ্চয়ই নাসিরউদ্দিন শাহের সঙ্গে। এই মাপের কোনও অভিনেতার সঙ্গে যে কোনও নতুন অভিনেত্রী অভিনয় করতে গেলে একটা বাড়তি চাপ একটা লুকিয়ে রাখা নার্ভাসনেস কাজ করবেই। চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য একবার অভিনয় করতে হচ্ছে আর ভয় নার্ভাসনেস দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আরও একবার অভিনয় করতে হচ্ছে তাই এই সব দৃশ্য তার কাছে চ্যালেঞ্জিং ছিল।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: তাজ-এর দুটি সিরিজই আসলে চেনা ইতিহাসকে অবাক হয়ে দেখার অভিজ্ঞতা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

মুরাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও সিংহাসনের আকাঙ্ক্ষায় দানিয়েল ও তার সহযোগীদের সেলিমের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ মুঘল সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারের দুশ্চিন্তায় পুত্র মুরাদের অকাল মৃত্যুর শোকে গুরুতর অসুস্থ ভারত সম্রাট আকবর এখানে শেষ হয়েছিল সিজন ১।

সিজন ২ শুরু হয় যুদ্ধের আরো ১৫ বছর পর। মুঘল সাম্রাজ্যে তখন কোন অস্থিরতা নেই, কিন্তু স্বয়ং সম্রাট আকবর মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত। তিনি ছুটে গিয়েছেন সুফি ধর্মগুরু শেখ সেলিম চিসতির কাছে। মুরাদ মৃত। সেলিম অজ্ঞাতবাসে। প্রায় অস্তিত্ব নেই। সুতরাং দানিয়েলের সামনে ভারত সম্রাটের সিংহাসন বাধাহীন, উন্মুক্ত। ঠিক এমন একটা মুহূর্তে সেলিম ফিরে এল।
সেলিমের বিরুদ্ধে যখন রাজ পরিবারের একটা বড় অংশ ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত তখন সেলিমের পাশে দাঁড়ালো মেহেরুন্নিসা। ভারতসম্রাজ্ঞী হবার ভয়ংকর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল মেহেরুন্নিসার। ধীর স্থির কূটনৈতিক চালে হারেমের রাজনীতিকে মুঠোবন্দি করে ফেলল মেহেরুন্নিসা। অল্পদিনেই সে যোধাবাঈ-এর প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলো।

সিজন ১-এ আসা বহু চরিত্রের সঙ্গে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দর্শকের পরিচিতি ঘটেছে। সিজন-২ এইসব চরিত্রদের নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। তাদের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো স্পষ্ট হয়েছে।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৫: উমা নাম জপতে জপতে বাঘের কাছে গিয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন রবি ঘোষ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

ইতিহাসে আনারকলিই মোগল আমলের প্রথম কোন মহিলা যিনি বড় ঘেরের ঘাগরা পরতেন কিনা বা আনারকলি ড্রেসের স্রষ্টা তিনি কিনা এটা বলা ভারি শক্ত। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আনারকলি মুঘল আমলের এক উজ্জ্বলতম মহিলা চরিত্র। তোয়াইফ মানে কিন্তু বারবনিতা নয়। এঁরা অত্যন্ত গুণী নর্তকী, উচ্চপর্যায়ের হিন্দুস্থানী মার্গীয় সঙ্গীতে পারদর্শী, একাধারে চারুকলা ও উর্দূ য় ফারসি সাহিত্যের অনুরাগিণী। ৫০০ খৃস্টপূর্বে শুদ্রকের নাটক মৃচ্ছকটিক-এর নায়িকা নটী বসন্তসেনা এমনই একটি চরিত্র। আনারকলি ঠিক তেমনই এক সঙ্গীত ও নৃত্যে বিশেষ পারদর্শী এক আকর্ষণীয় নারী। যিনি একমাত্র ভারতসম্রাট আকবরের রক্ষিতা। দেশের সর্বশক্তিমান পুরুষকে অস্বীকার করার ক্ষমতা অনেকের মতোই আনারকলিরও ছিল না। তাই হারেমে স্থান না পাওয়া আনারকলি তাঁর সন্তান দানিয়েলকে কাছে পাননি।
তবে মুঘল সম্রাট দ্যানিয়েলকে সম্রাটপুত্র হিসেবেই রাজপ্রাসাদে মানুষ করেছেন। আর আনারকলিকে প্রায় বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে প্রাসাদের মধ্যে এক লুক্কায়িত কক্ষে । কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে। এত ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও যুবরাজ সেলিমের সঙ্গে আনারকলির প্রেম হয়ে গেল। শুরু হল আনারকলিকে ঘিরে পিতা পুত্র আকবর ও সেলিমের মধ্যে ত্রিকোণ জটিলতা। জীবিত অবস্থায় আনারকলিকে প্রাসাদের দেওয়ালের মধ্যে গেঁথে ফেলা হল। এরপর দানিয়েল জানতে পারলো আসলে আনারকলি কে? মুঘলে আজম-এ দেখা সেই বহু প্রচলিত গল্পে একটা মোচড় আনা হয়েছে এই সিরিজে। আসলে মুঘল আমল নিয়ে নানান ইতিহাসিক গবেষণাকারীদের নানারকম মত রয়েছে। সেরকমই কোন এক তথ্যকে অনুসরণ করে নিশ্চয়ই এই কাহিনি বিন্যাস করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

রকম-রকম, হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২২: ওরে মোর শিশু ভোলানাথ!

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৬: ঐতিহ্যবাহী বাড়ির শহর মধুপুর

এই চমকের পরেও আনারকলির মৃত্যু হয়েছে এবং সেলিম সেই মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। সম্রাট আকবরের ভয়ংকর নৃশংসতার জন্যই সেলিম বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। সিজন ওয়ান থেকে আগাগোড়া আনারকলির ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন অদিতি রাও হায়দারি।

এমনই এক উজ্জ্বল চরিত্র হলেন মেহেরুন্নিসা । ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আজকের আফগানিস্তানের অন্তর্গত কান্দাহারে জন্ম। নামের অর্থ স্ত্রীজাতির সূর্য। সাহিত্য শিল্পকলা সঙ্গীত ও নৃত্যে বিশেষ পারদর্শী মেহেরুন্নিসা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যুৎপন্নমতি রাজনৈতিক কৌশলী। শিকার শরাব আর আফিমে আচ্ছন্ন সেলিম বা পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর হয়ে উঠলেও তাঁর স্বভাবের বিশেষ বদল ঘটেনি। আর এই কারণেই মোগল সামাজ্যের প্রশাসনিক এমনকি সামরিক সিদ্ধান্তেও সরাসরি যুক্ত থাকতেন এই মেহেরুন্নিসা বা পরবর্তীকালে ভারতসম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠা নুরজাহান। যে নামের অর্থ জগতের আলো। হয়তো সিনেম্যাটিক লাইসেন্স নিয়েই মেহেরুন্নিসারচেহারায় কিছুটা আনারকলির সাদৃশ্য রাখা হয়েছে।

তাজ।

অদিতি রাও হায়দারি এবং সৌরসেনী মৈত্রের মেকআপেও কিছুটা সাদৃশ্য রাখা হয়েছে। কিন্তু এই অত্যন্ত জোরালো চরিত্রে নাসিরুদ্দিনসহ অনেক প্রথিতযশা শিল্পীদের মধ্যে থেকে নিজের দিকে দর্শকের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন, বালিগঞ্জ শিক্ষাসদনের প্রাক্তনী সৌরসেনী মৈত্র। তাঁর অভিনয় জীবনের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ কামনা করি।
* ফিল্ম রিভিউ: জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছেন।

Skip to content