বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কোটা ফ্যাক্টরি।

 

কোটা ফ্যাক্টরি

ভাষা: হিন্দি
ঘরানা: কমেডি
প্রযোজনা: সমীর সাক্সেনা, টিভিএফ
সৃজন: সৌরভ খান্না, অরুণাভ কুমার
কাহিনী ও চিত্রনাট্য: তমোজিৎ দাস
পরিচালনা: রাঘব সুব্বু, প্রতীশ মেহতা
অভিনয়: জিতেন্দ্র কুমার, ময়ূর মোরে, রঞ্জনরাজ, আলম খান, আহসাসচান্না, রেবতী পিল্লাই, উরভি সিং, তিলোত্তমা সোম প্রমুখ
ওটিটি রিলিজ: নেটফ্লিক্স (সিজন ১, ২ ও ৩) ইউটিউব (সিজন ১)
সিজন প্রতি পর্ব: ৫
রেটিং: ৮.৭৫ /১০

গল্পের খোঁজে জীবনের নানান স্তরে ঝাঁপ দিয়েছেন নির্মাতারা। এ ভাবেই ইউপিএসসি-তে সুযোগ পাওয়ার লড়াই নিয়ে সিরিজ হয়েছে, ঠিক তেমন ভাবেই আইআইটি’র লড়াই নিয়ে সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরি’। এপ্রিল ২০১৯ এ শুরু হয় সিজন-১, সেপ্টেম্বর ২০২১ এ সিজন-২, আর এই জুন মাসের দিন কয়েক আগে মুক্তি পেল কোটা ফ্যাক্টরি সিজন-৩ ।

নামকরণ থেকে সাদাকালোয় সিরিজের বিন্যাস চরিত্রায়ণ টাইটেলে কারখানার সাইরেন-সহ উঁচু উঁচু চিমনির ছবি প্রতি পর্বের প্রথম অংশের ঝলকের পরের দৃশ্যে যাওয়ার সময় কোটা ফ্যাক্টরি টাইটেলের পিছনে ফটোকপি মেশিন-এর অনবরত গতানুগতিক কাগজ ছেপে যাওয়ার শব্দ সবকিছুর মধ্যে একটা অন্য স্বাতন্ত্র্য আছে, যা আর কোনও অন্য সিরিজের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। চিত্রভাবনার এই স্বকীয়তা এই সিরিজে অন্য প্রেম অন্য হিংসা অন্য ভালোলাগা অন্য সাফল্যের গল্প বলার তাগিদকে স্পষ্ট করেছে। এই ছাত্রছাত্রীরা জীবনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে, তাই তাদের জীবন বর্ণহীন। সাদাকালো।

হ্যাঁ! এখন ছবির দর্শক স্পষ্টত ভাগ হয়ে গিয়েছেন। এই বিভাজনটা সিনেমার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে, কিন্তু সিরিজের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে গিয়ে খারাপ লাগলে উঠে আসা যায় না। দেখি আরও খানিকক্ষণ! আরও কী কী হয়? এই বলে মনকে প্রবোধ দিয়ে বসিয়ে রাখতে হয়। সিরিজের ক্ষেত্রে যদিও মাসে, ৬ মাসে বা বছরে একটা নির্দিষ্ট মোটা টাকা মেটাতে হয়। তবুও খারাপ লাগলেই মানুষ অন্য ছবিতে অন্য সিরিজে চলে যেতে পারেন। চলে যানও। আর দর্শকের ওটিটি সিরিজ দেখার এই মানসিকতার ভয়েই একঘেয়ে সাংসারিক ছবি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ওটিটি যে শুধু, প্রভাব প্রতিপত্তি পরিচিতি বা ঘনিষ্ঠতার কারণে এতদিন কাজ পেতে থাকা গতানুগতিক নায়কনায়িকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে তা নয়, একই কারণে পুরনো বাংলা প্রেমের ছবির ছিপি-বোতল বদলে এতদিন ক্রমাগত ছবি করতে থাকা মিডিয়ার আলোয় আলোকিত একসময়ের ‘সফল’ একক বা জোটবদ্ধ চিত্রনির্মাতারা জোট ভেঙ্গে এখন সরকারি বা বেসরকারি নানান কাজের ফিকির খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিংবা সিরিজ বা সিরিয়ালে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন। কারণ ওটিটির এই বদলে যাওয়া মানসিকতার দর্শকই আবার সময় পেলে সিঙ্গল স্ক্রিন বা মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখেন। রিমোট ঘুরিয়ে সারা ভারত এবং পৃথিবীতে এই মুহূর্তে তৈরি হওয়া ছবি এবং সিরিজ দেখতে পাওয়ার সুফল এবং কুফল সমানভাবে বাজারে প্রতিফলিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: পঞ্চায়েত সিজিন-১ এবং ২ এক অন্য স্বাদের নেশা ধরাবে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

এখান সেখান থেকে অন্য ভাষার ছবি বা সিরিজ টুকলিফাই করবার যে প্রবল প্রবণতা ছিল সেটা অল্প হলেও কমছে। কারণ আজকাল ছবি ও সিরিজ নানান ভাষায় মুক্তি পাচ্ছে। এর ওপর নতুন লেখকরা আজকাল কাউকে গল্প বা চিত্রনাট্য শোনাবার বা জমা দেওয়ার আগে অনলাইনে বসেই সেটিকে রেজিস্ট্রেশন করে নিচ্ছেন। ফলে একসময় যেসব নামী পরিচালক পরিচালিকারা নির্দয়ভাবে নতুনদের কনসেপ্ট দৃশ্যায়ন গল্পের মূলসুর বা পাতা মিলিয়ে গল্প ও চিত্রনাট্য চুরি করতেন এবং বিনিময়ে তাদের আর্থিকভাবে ও ব্যক্তিসম্মানের দিক থেকে নির্মমভাবে শোষণ করতেন সেটাও এখন পুরোপুরি না হলেও অনেকটা কম।

হাতে হাতে মোবাইল ক্যামেরা থাকার জন্য কোথায় কি হচ্ছে সেটা এখন খুব দ্রুত সকলের কাছে স্পষ্ট। এটা যেমন ভালো দিক, তেমনি ক্ষতির দিকটা হল আগের থেকে প্রযোজক এখন অনেক বেশি সাবধানী। তাঁরা এখন সচেতনভাবেই প্রকৃত যোগ্যতা আর কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলত, একসময়ে ছবির পর ছবি করতে থাকা নিম্ন ও মধ্য মেধার কাহিনিকার-পরিচালকেরা এখন আর কাজ পাচ্ছেন না। গল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ তারা কখনই নতুন কিছু সৃষ্টির কথা ভাবেননি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

তিন সিজনের কোটা ফ্যাক্টরি কোটার আশপাশের অসংখ্য শহর ও দেশের নানান রাজ্যে থেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে চাওয়ার স্বপ্ন দেখা ভিন্ন ভিন্ন আর্থ সামাজিক অবস্থার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের গল্প। ইউপিএসসির ক্ষেত্রে যেমন দিল্লির ওল্ড রাজেন্দ্র নগর মুখার্জি নগর করোল বাগ বা লক্ষীনগর, আইআইটি/ জেইই, নেট পরীক্ষার ক্ষেত্রে তেমনই বিখ্যাত হল রাজস্থানের কোটা। দিল্লি রাজেন্দ্র নগর বা মুখার্জি নগরের মতোই পুরো কোটা শহরে গোটা ভারতবর্ষকে খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়িতে বাড়িতে পিজি স্টুডেন্ট থাকে, খাবার দোকান থেকে অটোওয়ালা সকলে আইআইটি জেইই নেট পরীক্ষার খবরাখবর রাখে। রাস্তাঘাটে দিনের সারাক্ষণ কোশ্চেন অ্যানসার পার্সেন্টাইল ফ্রেশার রিপিটার এই সবই আলোচনার বিষয়বস্তু। শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে ঝকঝকে কলেজের মাপের কোচিং ইনস্টিটিউট। এক অন্য জগত এক অন্য কর্মকাণ্ড। আর এর পরিচিতি পেতে দেখতেই হবে কোটা ফ্যাক্টরি সিজন এক দুই তিন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

কোটাতে এক বিখ্যাত ফিজিক্স টিচারের নাম এনভি স্যার। নিতিন বিজয়। কোটা ফ্যাক্টরি সিরিজের বিখ্যাত চরিত্র জিতু ভাইয়া কিছুটা এনভি স্যারের আদলে গড়া। ঠিক এমনই আরেকজন হলেন দিল্লির মুখার্জি নগরে বিকাশ দিব্যকীর্তি স্যার। বিকাশ দিব্যকীর্তিকে আমরা টুয়েলভথ ফেল ছবিতে তারই নিজস্ব ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেছি। ছবির চিত্রনাট্যেও বিকাশের বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি একসময়ের আইএএস, পরে চাকরি ছেড়ে মুখার্জি নগরে ক্লাস করাতেন। এখন নিজস্ব কোচিং সেন্টার দৃষ্টি আইএএস কোচিং ইনস্টিটিউট।

একইভাবে নিতিন বিজয় আইআইটি, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এরপর কোটাতে নানান কোচিং সেন্টারে ফিজিক্স পড়াতেন। তারপর নিজস্ব কোচিং সেন্টার মোশান এডুকেশন। এই সিরিজে রয়েছে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব। তিনি বিনোদ কুমার বনশল। ১৯৮৩ সালে মানে ৪১ বছর আগে তিনিই কোটার বন্সল কোচিং-এর মাধ্যামে আইআইটি কোচিং-কে বিখ্যাত করে তোলেন। পেশিজনিত রোগে তাঁর গোটা শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।এই সিরিজে তার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিও রয়েছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৯: এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা

জাদুঘর পঞ্চায়েত-সহ এই মূর্হুতের অনেক ছবি ও সিরিজে অত্যন্ত সফল এবং কোটা ফ্যাক্টরি’র মুখ্য ভূমিকাভিনেতা জিতেন্দ্র কুমার কিন্তু খড়্গপুর আইআইটির স্নাতক। কিন্তু অভিনয়ের নেশা তাঁর পথ ঘুরিয়ে দিয়েছে। জিতেন্দ্রকুমার ছাড়াও এই সিরিজের অন্যতম চরিত্র বৈভব পাণ্ডের ভূমিকায় ময়ূর মোরে বাল মুকুন্দ মিনার চরিত্রে রঞ্জন রাজ, উদয় গুপ্তের ভূমিকাভিনেতা আলম খান, শিবাঙ্গী রানুয়াতের চরিত্রে আহসাস চান্না, ভর্তিকা রাতোয়ালের চরিত্রে রেবতী পিল্লাই এবং মিনাল পারেখের ভূমিকায় উরভি সিংএবং ছোট্ট ভূমিকায় তিলোত্তমা সোমের উল্লেখযোগ্য অভিনয় এই টানটান সিরিজকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content