ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
রুপোলি পর্দার আড়ালে প্রতিনিয়তই ঘটে চলে কতশত বিচিত্র ও বৈচিত্রময় ঘটনা। সাধারণ দর্শকরা পর্দার সামনে ঘটতে দেখা ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি কিন্তু অপেক্ষা করে থাকেন যদি সেই সমস্ত বৈচিত্রের টুকরো কিছু ঝলকের আভাসমাত্র পাওয়া যায় কোনওভাবে। এবার তাদের সেই অপেক্ষার অবসান হওয়ার পালা। টলিউডে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা সেই সমস্ত নানাবিধ বৈচিত্রের সমাহার নিয়েই এবার থেকে থাকছেন টলিউডের অন্যতম মুখ্য সহকারী পরিচালক বিভাসরঞ্জন বেরা। বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় ঘটনার কাহিনি নিয়েই থাকছে তার এই ধারাবাহিক ‘অচেনা টলিউড’।
পর্ব-২
‘ঝিনুকমালা’ থেকে ‘বাবা কেন চাকর’ স্বপন সাহার সঙ্গে এই ছিল আমার যাত্রাপথ। মাঝে প্রায় ১৯টি ছবি। বুঝে না বুঝে পরপর ছবি করেছি। উনি সবটা খোলসা করতেন না। তাই আমাদের কাছে সবটাই ছিল ধোঁয়াশায় ভরা, ভাসা ভাসা। না জেনে সিনেমায় কাজ করছি, মনে চাপা খেদ কিন্তু দিনের শেষে পকেট ভরার পর সেই আক্ষেপ কর্পূরের মতো উবে যেত। উত্তমকুমার মারা যাবার পর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মরা গাঙে জোয়ার এনেছিলেন অঞ্জন চৌধুরি। ১৯৮৪ সালে, ‘শত্রু’র পর টানা দশ বছর তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর চিত্রনাট্য সংলাপে অন্য পরিচালকরাও একটার পর একটা ছক্কা মেরেছেন। ১০ বছর একা কাঁধে সব সামলাবার পর পাশে পেলেন স্বপন সাহাকে। ১৯৯২ সালে ‘বেদেনীর প্রেম’ দিয়ে টলিউডে আবির্ভাব হলেও ১৯৯৫ সালে ‘সুজন সখি’ দিয়ে নিজের ভিত শক্ত করলেন স্বপন সাহা। একেবারে কম বাজেটের ছবি। কিন্তু প্রযোজকের বিপুল লক্ষ্মীলাভে ইন্ডাস্ট্রিতে হইহই রইরই পড়ে গেল। অঞ্জন চৌধুরির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ১৯৯৬ সালে শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারের প্রথম ছবি ‘ভাই আমার ভাই’ মুক্তি পেল। স্বপনদার সে ছবি বিপুল সাড়া ফেলল শহর থেকে গ্রামে। প্রযোজকরা লাইন দিলেন তার টেকনিশিয়ান স্টুডিওর অফিসে। শুটিং শেষে স্বপনদা নিয়ম করে অফিসে এসে বসতেন। ৩০ দিনের ৩০ দিনই। স্টুডিওতে না এলে নাকি শরীর খারাপ লাগত ওঁর। টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে স্বপনদার অফিসটা ছিল খুবই ছোট। তিন-চারজনের বেশি বসার জায়গা হত না। ইউনিটের লোক সাক্ষাৎপ্রার্থী সবাই অফিসের বাইরে অপেক্ষা করত৷ ছোট্ট একফালি জানালা দিয়ে ভেতরে ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণের মরিয়া চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে এমন ভিড় হত, মনে হতে পারে ভেতরে বোধহয় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেই পুলিনদা (ওঁর এক সহকারী) চোখ পাকিয়ে ভিড়টা পাতলা করে আসত। ভিড়ের হাত থেকে বাঁচতে মাঝে মাঝে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসতে হত। ভিড় হবে নাই-বা কেন? তখন তো মেগাসিরিয়ালের এত দাপাদাপি ছিল না। সিনেমাই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। তার ওপর অঞ্জন চৌধুরি, স্বপন সাহার ছবি মানেই ‘হিট’। তাই একটা সুযোগ পাওয়া মানে অক্ষয় অমর হয়ে থাকা। স্বপনদার অধিকাংশ গল্পই ছিল সামাজিক এবং গ্রাম্য প্রেক্ষাপটের। ফলে সাধারণ, অতিসাধারণ চেহারার লোকজনই সুযোগ পাওয়ার আশায় ভিড় জমাত বেশি। একদিন সন্ধেবেলা সল্টলেক থেকে আউটডোর শুটিং সেরে স্টুডিওতে ঢুকেই গাড়িটা অফিসের সামনে রেখে কোথাও যেন বেরিয়ে গেলেন। অফিস খোলার পর রোজকারমতো যথারীতি সেই বিরক্তিকর ভিড়। স্বপনদা না থাকায় আমরাও ভিড় এড়াতে জানালাটা খোলা রেখে দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে আড্ডা মারতে লাগলাম। দূর থেকে দেখলাম, ভিড় ঠেলে ব্রিফকেস হাতে কেউ যেন একজন ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি মারলেন। চেহারাটা রাশভারী। কেউ নেই দেখে সরে দাঁড়ালেন। মিনিট পনেরো পর আবার একজন কেউ চামড়ার ব্যাগ হাতে দরজায় উঁকি মেরে ঘর ফাঁকা দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করলেন। চেহারা দেখে পার্টপ্রার্থী মনে হল না। তবে কে? যাকগে, স্বপনদা এলে বোঝা যাবে। কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়? আধ ঘণ্টা পর অফিসের সামনে একটা দামি গাড়ি এসে দাঁড়াল। যিনি নেমে দরজার সামনে গেলেন তিনি হোমরা-চোমরা কেউ সেটা বুঝে পুলিনদা হাজির হলেন। কথা বলে ফিরে এসে পুলিনদা বললেন, উনি একজন নামকরা প্রোডিউসার, দাদার সঙ্গে সকালে ফোনে কথা হয়েছে, এখন ছবির জন্য টাকা অ্যাডভান্স করতে এসেছেন। অফিস খোলার পর প্রায় ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেল স্বপনদার পাত্তা নেই। তখন তো আমাদের হাতে মোবাইল ছিল না যে জিজ্ঞেস করব কোথায় আছেন? অগত্যা ধৈর্য হারিয়ে পার্টপ্রার্থী সহ সবাই একে একে ফিরে গেলেন। অফিসের সামনে যখন পুরো ফাঁকা, স্টুডিওতেও তেমন কোনও লোকজন নেই, তখন স্বপনদা কালো কাচ দেওয়া একটা অন্য গাড়ি (নিজের গাড়ি নয়) থেকে নেমে এলেন। হাবভাব অনেকটা যেন ‘হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল’র মতো। ব্যাপারটা কী? কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? উত্তর দিলেন: আজ একসঙ্গে তিনটে প্রোডিউসার ছবি তৈরির জন্য অ্যাডভান্স করতে আসার কথা ছিল। অলরেডি চার জনের কাছে টাকা নিয়ে বসে আছি। অ্যাডভান্স দিয়ে সবাই বলবে, তাদের ছবিটা আগে বানিয়ে দিতে। সেটা সম্ভব নয়। তাই বুঝেশুনে ওই গাড়িটার পেছনে লুকিয়ে বসেছিলাম। ভাবা যায়! সেসব দিনের কথা! প্রোডিউসাররা অফিসের গেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাকা দেবে বলে, আর টাকা নেবার ভয়ে ডিরেক্টর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন! অথচ হওয়ার তো কথা ছিল উলটোটা! তাই না?