শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ডায়াবেটিসে কী কী ফল খাওয়া যায়, আর কী কী ফল খাওয়া যায় না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই অনেক রকম প্রশ্ন আছে। কেউ হয়তো রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি বলে সব রকমের মিষ্টি ফলই সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন, তো কেউ আবার মিষ্টির অভাব ভুলতে গাদা গাদা মিষ্টির ফল খেয়ে ফেলেছেন। এ সবই কিন্তু বিপদজ্জনক।

সাধারণত বেশিরভাগ ফলেরই প্রধান উপাদান জলীয় অংশ এবং কার্বোহাইড্রেট হলেও যে সব ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিনস, মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বেশি এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের মাত্রা কম অর্থাৎ দ্রুত রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায় না, সেই সব ফলই ডায়াবেটিকদের জন্য উপযুক্ত।
 

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কী?

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এক বিশেষ ধরনের সূচক, যার দ্বারা কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার গ্রহণের পর কত দ্রুত রক্তে পৌঁছে রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা কতটা বাড়াতে পারে তা পরিমাপ করা হয়। সাধারণত ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই গ্লাসমিক ইনডেক্স মাত্রার উপর গুরুত্ব দিয়ে ডায়েট প্ল্যান করা হয়। সাধারণত যেসব কার্বোহাইড্রেট খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাত্রা ৫৫ এবং তার চেয়ে কম, তা লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত। ৫৬ থেকে ৫৯, অর্থাৎ মানে মাঝারি গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত, আর ৭০ বা তার বেশি, মানে উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত ধরা হয়।

স্পষ্টতই ডায়াবেটিকরা রক্তে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে রক্ত শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ফল ডায়েটে রাখবেন।

অন্যদিকে আবার কিছু ফল আছে, যার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হলেও কার্বোহাইড্রেট বা সুগারের মাত্রা বেশি হওয়ায় রক্তের সুগারের মাত্রা, গ্লাইসেমিক লোড বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এবং কম কার্বোহাইড্রেট কনটেন্ট, অর্থাৎ গ্লাইসেমিক লোড কম এমন ফলই ডায়াবেটিকদের খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত।

এরকম কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত কিছু ফলের কথা আলোচনা করছি, যেগুলো স্বচ্ছন্দে ডায়াবেটিকরা খেতে পারবেন।

 

আপেল

আপেলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, মাত্র ৩৯। মোটামুটি মাঝারি সাইজের একটি আপেল থেকে ৮০ থেকে ৯০ কিলোক্যালরি শক্তি, পর্যাপ্ত পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন সি, বি ভিটামিনস, পটাশিয়াম এবং কোয়েরসেটিন নামক উন্নত মানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধের পাশাপাশি ডায়াবেটিসের জন্য অতি উৎকৃষ্ট ফল হিসেবে গণ্য হয় আপেলকে।
 

কমলালেবু

রক্তের শর্করা মাত্রা বেশি থাকলে মিষ্টি ফল হওয়ায় অনেকেই কমলালেবু খান না। কিন্তু সেটা মোটেই ঠিক নয়। মাত্র ৪০ গ্রাম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাত্রাযুক্ত কমলালেবু ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, বিভিন্ন ধরনের ফ্ল্যাভোনয়েডস ও ফেনোলিক অ্যাসিডের গুণে সমৃদ্ধ কমলালেবু ডায়াবেটিসের পথ্য তালিকায় থাকা উচিত।
 

মুসাম্বি

ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর মুসাম্বি লেবুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। ৪০ থেকে ৫০ হওয়ায় ডায়াবেটিকদের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত।

আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: ড্যাশ ডায়েট, এক ঢিলে কমবে ওজন ও রক্তচাপ

হেলদি ডায়েট: ঘি খেতে ভালোবাসেন? ঘিয়ের এই ১০টি গুণ জানতেন?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

 

পেয়ারা

ডায়াবেটিকদের জন্য আরেকটি অত্যন্ত উপকারী ফল ভিটামিন সি এবং ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ পেয়ারা। এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ভ্যালু মাত্র ৩২।
 

ন্যাশপাতি

হজম ও বিপাকে সাহায্য করার পাশাপাশি রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী অত্যন্ত উৎকৃষ্ট ফল ডায়েটারি ফাইবার ও পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ নাশপাতি। নাশপাতির জিআই ভ্যালু ৩৮, অর্থাৎ বেশ কম।
 

বেরি জাতীয় ফল

স্ট্রবেরি, র্যা ম্পবেরি, ক্রেনবেরি, ব্লুবেরি ইত্যাদি একাধিক বেরি জাতীয় ফলে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ও অগণিত পুষ্টি উপাদান থাকায় এক কথায় বলা যায়, ‘পাওয়ার হাউস অফ নিউটিশনস’। এইসব বেরি জাতীয় ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, পর্ব-৯: আমাজন যেন স্বর্গের নন্দনকানন, একঝলক দেখে বোঝাই সম্ভব নয় এর ভয়াবহতা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

 

জাম ও জামরুল

অত্যন্ত কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের গুণে সমৃদ্ধ এই দুই ফল ডায়াবেটিকরা যদি নিয়মিত ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম পরিমাণে ডায়েট রাখেন, তাহলে রক্ত শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকার পাশাপাশি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল মাত্রা কমবে এবং হার্ট ভালো থাকবে।
 

শাঁকালু

অনেকেই মনে করেন সুগার বাড়লে মাটির তলার স্টার্চ সব্জি কিছু খাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই ভুল ভাঙার সময় এসেছে। একটা মাঝারি আকারের (১৩০ গ্রাম) শাঁকালুতে ৪৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ১২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, এক গ্রাম প্রোটিনের পাশাপাশি প্রায় ৬.৪ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম এবং জলীয়ভাব অত্যন্ত বেশি হওয়ায় হজমে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং ডায়াবেটিকদের জন্য বেশ ভালো।
 

আনার বা বেদনা

আনারের গড়পড়তা গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ভ্যালু ৫৩ হলেও গ্লাইসেমিক লোড ১৮, অর্থাৎ মাঝারি। তাই মাঝেমাঝে খেলেও মাত্রা মতো খাবেন, ৫০ থেকে ৭৫ গ্রাম যথেষ্ট।

আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা

ভিন্ন স্বাদের চিকেন রেসিপি চান? ক্রিস্পি চিকেন বানাতে সময়ও লাগে কিন্তু খুব কম!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

 

আঙুর

মিষ্টি ফলের মধ্যে আঙুর অন্যতম। বিশেষত ডায়াবেটিক, যাঁদের খুব মিষ্টি ফল খাওয়ায় মানা আছে, তাঁরা কি আঙুর খেতে পারবেন? আঙুরের জিআই ভ্যালু ৫৩ এবং গ্লাসেমিক লোড ৯.৬ অর্থাৎ এই দুই-ই কম রেঞ্জের হলেও আপার মার্জিনের কাছাকাছি হওয়ায় অল্প পরিমাণে (৫০ গ্রাম) মাঝেমধ্যে খেতে পারেন। কারণ, রেসভেরাট্রল ও অন্যান্য ফেনলিক কম্পাউন্ডসের গুণে সমৃদ্ধ আঙুর রোগের বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা বাড়ায়।
 

পাকা পেঁপে

পেঁপের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি ৬০ হলেও গ্লাইসেমিক লোড মাত্র ৫.৫ অর্থাৎ অনেক কম হওয়ায় দ্রুত রক্তের শর্করার মাত্রা বাড়ায় না। উপরন্তু ডায়রি ফাইবার, ক্যারোটিনয়েডস, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ পাকা পেঁপে ডায়াবেটিকদের জন্য আদর্শ।
 

তরমুজ

ডায়াবেটিকদের ফল তালিকায় আরেক বিতর্কিত ফল তরমুজ। তরমুজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭৬ অর্থাৎ অনেকটাই বেশি। কিন্তু তরমুজের বেশিরভাগটাই জল এবং শর্করা মাত্রা কম হওয়ায় গ্লাইসেমিক লোড মাত্র ৫, তাই রক্তের শর্করা মাত্রা বাড়ায় না। তীব্র গরমে দেহের জল ও ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রেখে মিষ্টি সুখ পেতে ডায়েটে রাখতে পারেন লাইকোপিন সমৃদ্ধ এই লাল টুকটুকে ফল।

তবে হ্যাঁ, অন্যান্য ফলের মধ্যে আম, কলা, আনারস, তাল, সবেদা, খেজুর এইসব মিষ্টি ফল খেতে পারবেন কিনা বা খেলেও কতটা খাবেন—এসব ব্যাপারে অবশ্যই আপনার ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলুন।

যোগাযোগ: ৯৮৩০২১৪৯৭১

* ডায়েট ফটাফট (Healthy Diet tips): শম্পা চক্রবর্তী (Shampa Chakrabarty), ডায়েট কনসালটেন্ট।

Skip to content