বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের
চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।’


পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জালকে আগাগোড়া সাফ করে এক আলো ঝলমলে ধনাত্মক আবহে মোড়া পৃথিবীকে কোনও নবজাতকের কাছে উপহার দেওয়া হয়তো কোনও মানুষের একার পক্ষে বা এক যুগে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, কিন্তু তথাপি মানুষ চেষ্টা করেন, প্রতিটি বাবা-মা চেষ্টা করেন তাঁদের নবজাতককে এক অনন্য পৃথিবী উপহার দেওয়ার, যে পৃথিবীর আলাদিন একদিন সে নিজেই উঠতে পারবে নিজের সমস্ত শুভ সম্ভাবনাকে আশ্রয় করে। এরকমই এক পৃথিবী দিতে সক্ষম হয়েছেন রহড়া নিবাসী প্রবাল দে এবং চন্দ্রাণী দে। এক অন্যতর আশাভরা, শিক্ষা ও জ্ঞানমণ্ডিত পৃথিবী তাঁরা উপহার দিয়েছেন তাঁদের জ্যেষ্ঠপুত্র পাঞ্চজন্য দে-কে। ‘পাঞ্চজন্য’ এই সময়ের অন্যতম আলোকোজ্জ্বল এক সম্ভাবনার নাম। ২০২১ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম স্থানাধিকারী পাঞ্চজন্য দে ছিল ‘রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন’-এর ছাত্র। বর্তমানে সে ব্যাঙ্গালোরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’-এ চার বছরের কোর্স বিএস রিসার্চে পাঠরত।

আমরা সরাসরি পাঞ্চজন্যকে পাইনি, তাই আমরা যোগাযোগ করেছিলাম পাঞ্চজন্যের বাবা প্রবাল দে-র সঙ্গে। প্রবাল দে এবং চন্দ্রাণী দে-র দুই পুত্রসন্তান। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজ্য সরকারের অধীনে পেশারত সরকারি চাকুরিজীবী। কেমন ছিল পাঞ্চজন্য বরাবর? মিশুকে? অনেকক্ষণ পড়াশোনা করত নিশ্চয়ই? উত্তরে পাঞ্চজন্যের বাবা হেসে বললেন, ‘না না, ও বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির ছিল। স্কুলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলত, খেলাধুলো করত কিন্তু চুপচাপ নিজের মতো থাকতেই স্বচ্ছন্দ বেশি চিরকালই। আর পড়াশোনা? সে ওই ছ-সাত ঘণ্টা। বাকি সময়টা গল্পের বই পড়ে কাটাত পাঞ্চজন্য।’

কী ধরনের বই পড়তে বেশি ভালোবাসত? প্রবালবাবু জানালেন পাঞ্চজন্যের উৎসাহ ছিল মূলত বিভিন্ন রকমের গোয়েন্দা গল্প মূলত ‘ফেলুদা’র গল্প পড়ার দিকে৷ এছাড়া ‘প্রোফেসর শঙ্কু’ও কিন্তু থাকত তার পছন্দের ঝুলিতে আর পূজাবার্ষিকীর চিরকালীন ভালোবাসা ‘আনন্দমেলা’ তো আছেই। খেলাধুলো করতেও বেশ ভালোবাসত পাঞ্চজন্য।

ছোটবেলা থেকে চিরকালই ক্লাসে প্রথম পাঁচের মধ্যে থেকেছে পাঞ্চজন্য। প্রবালবাবুর মতে যত উঁচু ক্লাসে উঠেছে ছেলের পড়াশোনার সঙ্গে একাত্মতা আরও বেড়েছে। ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চ বা এনটিএসি-র পরীক্ষায় পশ্চিমবাংলার মধ্যে প্রথম হয়েছিল পাঞ্চজন্য, পাশাপাশি পাথফাইন্ডারের স্কলারশিপও পেত সে। পাশাপাশি ২০২০ সালে কেভিপিওয়াই-তে সমগ্র দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে এবং ২০২১-এ ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্সেও প্রথম হয় পাঞ্চজন্য।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী পাঞ্চজন্যের? প্রবালবাবু জানান ভবিষ্যতে অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করতে চায় সে। চার বছরের বিএস কোর্স শেষ করে গেট দিয়ে অথবা ইন্টিমেটেড রিসার্চ ফেলো হিসাবে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স থেকেই সম্ভবত তার গবেষণার যাত্রা আরম্ভ করবে সে। ভাগ্য সাথ দিলে পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য পাঞ্চজন্যের স্বপ্ন পা রাখবে বিদেশের মাটিতেও।

আগামী দিনে ছাত্রছাত্রীরা যদি জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পর এভাবে নিজেদের তৈরি করতে চায় তারা কীভাবে তৈরি হতে পারে? হেসে বললেন প্রবালবাবু, ‘বিশেষ কোনও উপায়ই নেই, এক এবং একমাত্র উপায় হল অধ্যবসায়, পরিশ্রম এবং যে বিষয় নিয়ে কোনও ছাত্র পড়াশোনা করতে চায় সেই বিষয়ের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা।’

হ্যাঁ যথার্থই বলেছেন প্রবালবাবু, কেবলমাত্র অধ্যবসায় আর ভালোবাসাই রহড়ায় আজন্মকাল মা, বাবা, দিদা, ঠাকুমা এবং ভাইয়ের সঙ্গে বড় হওয়া পাঞ্চজন্যকে আজ আরও কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছে তার স্বপ্নের পথে, যে পথে তার সঙ্গী ছিল পরিশ্রম আর ভালোবাসা ছাড়াও এক দৃঢ় অঙ্গীকার, যে অঙ্গীকার মিশেছিল প্রবালবাবুর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যের মধ্যে, তার প্রতিটি বাক্যের অন্তরালেই যেন আত্মগোপন করে ছিল সেই অপরাজেয় পংক্তিগুলি—

‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ
তারপর হব ইতিহাস।’

Skip to content