শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত

কলাগাছকে অতি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে ভাবার কারণটা, কলাগাছের বিজ্ঞানসম্মত নামের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম হল: ‘মুসা প্যারাডাইসিকা’। ‘মুসা’ কথাটি অত্যাভিস অগাস্টাস সিজার রাজার চিকিৎসক অ্যান্টনিয় মুসার নাম অনুসারে হয়েছে বলে উদ্ভিদ-বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

এর প্রজাতির নাম হল ‘প্যারাডাইসিকা’, যেটা ‘প্যারাডাইস’ শব্দ থেকে এসেছে। সুতরাং গাছটির প্রথম উৎপত্তিস্থল ‘স্বর্গ’ ধরে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। লৌকিক কাহিনিতেও বলা হয়েছে যে, আদম এবং ইভের প্রথম আচ্ছাদন ছিল কলা গাছের পাতা।

আমাদের দেশে কলাগাছকে প্রাচুর্য এবং উর্বরতার প্রতীক হিসেবে মানা হয়। যারা বিষ্ণু এবং শিবের উপাসক তারা তো বটেই সমগ্র হিন্দুদের কাছে কলাগাছ খুবই পবিত্র উদ্ভিদ।

বিভিন্ন দেশে আচার ও লোকাচারের সঙ্গে কলাগাছ মিলেমিশে রয়েছে। আমাদের বাংলায় পুজোর ঘট-স্থাপনে, পুজোর ডালাতে, আশীর্বাদের কুলোয় এবং বরণ ডালাতে কলার ছড়া ও প্রসাদে কলার ব্যবহার অপরিহার্য। এছাড়াও বাসন্তী পুজো ও দুর্গা পুজোর সময় নবপত্রিকার পুজোতে একটি পূর্ণ কদলীবৃক্ষ কনের সাজে সজ্জিত হয়। কারণ লৌকিক উপাখ্যান অনুযায়ী কলা ইতর পরাগযোগে নিজেকে নিষিক্ত করে বলে এই গাছকে দেবী পার্বতীর অবতার হিসেবে ভাবা হয়।

পূর্ব ভারতে বিবাহ মণ্ডপে চার কোনায় চারটি কলা গাছ রাখা হয়। আবার ওয়েস্টার্ন ঘাট এ কলাগাছ দেবী নন্দা-দেবীর রূপে পূজিত হন।
প্রসঙ্গত একটি আদিবাসী উপাখ্যানের কথা পাঠকদের শোনাচ্ছি, এক গ্রামে আম, তেতুঁল, কলা, জাম এবং ডুমুর নামে নৃত্যরতা পাঁচ বোন থাকতেন। প্রকৃতির নিয়মে তাঁরা যখন ভরা যৌবনে পা রাখলেন তখন স্থির করলেন বিবাহ করবেন। কিন্তু নানান দেশ-দেশান্তরে ঘোরা সত্ত্বেও কেউ তাঁদের বিয়ে করতে সম্মত হলেন না। তখন লৌকিক দেবতা ইম্পুর মহাপ্রভু পাঁচবোনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি চাও’। কলা বাদে চার বোন বলল, আমরা আমাদের স্বামী চাই এবং অনেক অনেক সন্তান চাই। কিন্তু কলা জানালেন আমি স্বামী চাই না আবার অনেক সন্তানও চাই না কারণ অধিক সন্তান হলে আমি নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবো। অবশেষে মহাপ্রভুর আশীর্বাদে চারবোনই স্বামী এবং তাঁদের মস্তকের কেশ-সংখ্যা-সম সন্তান পেলেন। শুধু কলাই একটি সন্তান জন্ম দিলেন। পরবর্তীকালে মহাপ্রভু ইম্পুর ইচ্ছায় পাঁচ বোন, পাঁচটি বৃক্ষে পরিণত হল।

বাস্তুশাস্ত্র মতেও কলাগাছকে পবিত্র গাছ হিসেবে মানা হয় কারণ এটি বাড়ির ‘পজিটিভ এনার্জি’কে অনেক অংশে বাড়িয়ে তোলে। বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোন-র কলাগাছ অত্যন্ত শুভ ফল দায়ক।
 

এক নজরে

বিজ্ঞানসম্মত নাম: মুসা প্যারাডাইসিকা
বাংলা নাম: কলা
সংস্কৃত নাম: কদলী
গোত্র: মুসেসি
গাছের প্রকৃতি: কলাগাছ
গুপ্তবীজী, একবীজপত্রী, সরল বড় পাতাযুক্ত এবং পুষ্পবিন্যাস যৌগিক স্পেডিক্স ধরণের।
 

গাছের বিস্তৃতি

এই গাছের প্রাচীন উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বিজ্ঞানীদের মতে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিনস ছিল এই গাছের আদি জন্মভূমি। বর্তমানে প্রায় ১৩০টির বেশি দেশে কলাগাছের চাষ চলছে।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: সবসময়ের সাথী ‘হরিতকী’

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: মাঝে মাঝেই মাথাব্যথায় ভুগছেন? মাইগ্রেন নয় তো

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

পাকা কলা

প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কলাতে থাকে ৮৫ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম, ০.৬ মিলিগ্রাম আয়রন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স 8 গ্রাম, ফসফরাস ৫০ মিলিগ্রাম, প্রোটিন ১.২ মিলিগ্রাম, ফ্যাট ০.৩%, খনিজ লবণ ০.৮%, শর্করা ৭.২% এবং জলের পরিমাণ ৭০.১%।
 

মোচা

রান্না করা কলার মোচায় প্রতি ১০০ গ্রামে— প্রোটিন থাকে ১.৭ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট থাকে ৫.১ গ্রাম, খনিজ লবণ থাকে ১.৩ গ্রাম, ভিটামিন থাকে ১-০.০৫, মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি থাকে ১৬ মিলিগ্রাম, ক্যালশিয়াম থাকে ৩২ মিলিগ্রাম, লোহা থাকে ১.৬ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন থাকে ২৭মাইক্রোগ্রাম ও এনার্জি থাকে ৩৪ কিলো ক্যালোরি।
 

থোড়

খাবার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম থোড়ে— প্রোটিন থাকে ০.৫গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট থাকে ৯.৭ গ্রাম, খনিজ লবণ থাকে ০.৬ গ্রাম, ভিটামিন বি থাকে, ১ থেকে ০.০২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি থাকে ৭ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম থাকে ১০ মিলিগ্রাম লৌহ থাকে ১.১ মিলিগ্রাম এবং এনার্জি থাকে ৪২ কিলো ক্যালোরি।
 

চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহার

রক্ত তৈরিতে

কলার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আয়রন উপস্থিত। ফলে কলা খেলে আয়রনের চাহিদা পূরণ হয় এবং অ্যানিমিয়াতে উপকার পাওয়া যায়। হিমোগ্লোবিন তৈরিতে কলা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে

মল নিয়ন্ত্রণে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে কলার ফাইবার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ রোজ সকালে ব্রেকফাস্টের সঙ্গে দুটি কাঁঠালি কলা এবং শিশুরা প্রতিদিন একটি করে কাঁঠালি কলা খেতে পারেন।
 

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে

কলার মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। অন্যদিকে লবণের পরিমাণ কম থাকায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এটি সাহায্য করে। আমেরিকাতে একটি সংস্থা (ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও স্ট্রোকের হার কমাতে কলার ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল

মনের আয়না: নেতিবাচক ভাবনা সরিয়ে সঙ্গীকে বোঝার চেষ্টা করুন, ফিরবে হৃত যৌনজীবন

 

বুদ্ধি বাড়াতে

প্রায় দুশো প্রজাতির উপর একনাগাড়ে পরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছে যে প্রতিদিন কলা যদি খাদ্য তালিকায় রাখা যায় তবে ব্রেনের কর্মক্ষমতা আরও ক্ষুরধার হয়।
 

মনকে চনমনে রাখতে

কলা খেলে ডিপ্রেশন অনেকাংশে কমে যায় কারণ কলাতে ট্রাইপ্টোফান নামক এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে যা ডিপ্রেশন কমিয়ে সুখী সুখী ভাব আনতে সাহায্য করে।
 

মর্নিং সিকনেস

সকালে যাদের ‘মর্নিং সিকনেস’ হয় তাদের কলা খেলে এই ভাবটা কেটে যায়।
 

স্নায়ুকে সতেজ রাখতে

কলার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি থাকে, যা স্নায়ুকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়াও কাঁঠালি কলা রক্তে শর্করার মাত্রাকে সঠিক মাত্রায় বজায় রেখে মানসিক অবস্থার স্থিতাবস্থা বজায় রাখে।
 

অ্যাসিডিটিতে

অম্বলের জন্য বুক জ্বালা করলে কলা খেলে জ্বালাভাব অনেকাংশে কমে যায়। দুধ ও কলা একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে তা পেটের পক্ষে উপকারী। পাকস্থলী ঠান্ডা থাকে। এবং হ্যাংওভারও অনেক অংশে কেটে যায়।
 

ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস এবং পেট খারাপে থোড়ের রস খুবই উপকারী। কাঁঠালি কলা এবং মোচার তরকারি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে কাঁচা থোড়ের রস আপনারা গ্রহণ করতে পারেন।
 

পাথুরী রোগ নিরাময়ে

থোড়েরে রস, কিডনি এবং শুক্রথলির পাথর গলিয়ে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।
 

আলসার নিরাময়ে

আলসার নিরাময়ে ক্রনিক আলসারে পাকা কলা খুব উপকারী খাবার। কলার মধ্যে থাকা মূলত সেরোটোনিন, ট্রিপ টুফান ,ওর-ফি-নিফিরিন, ক্যাটেকোলানি, ৩, ৪
ডিহাইড্রোক্সাইড, ফিনালামা অ্যালানিন ইত্যাদি থাকে। তাই কলা পেপটিক জাতীয় আলসার, ইউরেমিয়া, নেফ্রিটিস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে।
 

বাতের উপশমে

কলা গেঁটে বাত ও বাতের ব্যথায় বিশেষভাবে উপকারী।

আরও পড়ুন:

হোমিওপ্যাথি: আপনি কি গর্ভবতী? মর্নিং সিকনেসের শিকার? নিজেকে সামলাবেন কীভাবে

জিম-ট্রিম: আকর্ষণীয় ট্রাইসেপ চাই? রইল সহজ সমাধান

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১০: অমিতাভদাকে মাস্টারমশাই হিসেবে নয়, আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাবুদাদা

 

সাবধানতা

প্রতি সকালে খালি পেটে বা জল খাবারে কলাটা যতটা উপকারী ততটাই ক্ষতিকর হবে এই সুমিষ্ট ফলটা সূর্যাস্তের পর যদি খাওয়া হয়।

যাদের সর্দি-কাশি বা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে তাদের কখনোই দই, বাটার বা ঠান্ডা দুধের সঙ্গে কলা খাওয়া চলবে না এতে তাদের সমস্যা আরও বাড়তে পারে।

যাদের সাইনাস এবং অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে তারাও পাকা কলা এড়িয়ে চলবেন।

পাকা কলাতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকায় এটি বেশি খেলে শরীরে পটাশিয়ামের অত্যাধিক্য লক্ষ্য করা যায় যা হাইপার্ক্যালেমিয়া ডিজিস নামে পরিচিত।

যারা দীর্ঘকাল যাবৎ কিডনি ও হার্টৈর সমস্যায় ভুগছেন তারা পাকা কলা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবেন কারণ এই সুমিষ্ট ফলে পটাশিয়ামের অত্যাধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
 

শেষে পাতে

একটা কথা বলতেই হয়, কলাগাছের প্রতিটি অংশ প্রতিটি বাঙালির ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এমন ভাবে মিলেমিশে আছে যে ইচ্ছা করলেও এর থেকে দূরে থাকা অসম্ভব। আর শুধু বাঙালির কথাই বা কেন বলব? আগেই বলেছি পৃথিবীর প্রায় ১৩০টির বেশি দেশে বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির কলার চাষ হচ্ছে। মানুষ খাচ্ছেও প্রিয় ফল হিসাবে।—চলবে

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content