শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


।। গৌরব ও আভেরি ।।

আজকের সময় হলে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন হতো। তবে আজকের দিনেও বহু লোক সাইক্রিয়াটিক সাপোর্টকে পাগলের চিকিৎসা বলে ভাবেন। টুকটাক জ্বরজালি পেটখারাপ গাঁটে ব্যথার মতো মাঝেমধ্যে মনেরও যে মেরামতি লাগে সেটা সহজভাবে স্বীকার করতে এখনও মানুষ চায় না।

একমাত্র ননদ শান্তির ওপর সুজাতার রাগের একটা কারণ তার ছোট ছেলে গৌরবের সাফল্য। মামার বাড়ির আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা গৌরব সেনগুপ্ত আইসিএসসি বা আইএসসির সময় থেকেই তার জাত চিনিয়ে দিয়েছে। কালিম্পং-এর সেন্ট অগাস্টিন’স বোর্ডিং স্কুলের পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইকনোমিকসে গ্রাজুয়েশন করল সৌরভ। মাস্টার্স করল বিখ্যাত ‘ডি’ স্কুলে। মানে দিল্লি স্কুল অব ইকনোমিকস। সৌরভের কথা লিখতে গিয়ে ডিএসই-র প্রাক্তনীদের লিস্টে চোখ বোলাতে গিয়ে অবাক হলো সুবর্ণ। অবাক হল অর্থশাস্ত্রের নানান পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তার এক অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতার নাম দেখে। আমাদের সকলের প্রিয় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় মানে সুন্দর চট্টোপাধ্যায় দিল্লি স্কুল অব ইকনোমিকসের অ্যালামনি। তিনিও একইভাবে সৌরভের মতো প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে দিল্লি। তবে সৌরভের থেকে উনি ১৮/১৯ বছরের সিনিয়র।

এই সৌরভকে নিয়েও ভেতরে ভেতরে একটা ইন্সিকিয়রিটিতে ভুগতেন সুজাতা। মনে মনে নিজের ছেলে প্রণয়কে সৌরভের প্রতিযোগী বানিয়ে তুলতেন। অথচ প্রণয় গৌরবের থেকে শুধু লেখাপড়া বা বুদ্ধিতে নয় বয়সেও চার বছরের ছোট। দু’জনের কোন তুলনা হয় না। কিন্তু ন’কাকিমা বাড়িতে অশান্তি করে দাদু ঠাম্মির ওপর জোর করে এমন একটা মানসিক চাপ তৈরি করলেন যাতে তারা প্রণয়কে কালিম্পং-এর ওই গৌরবের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হ’ন। সহজভাবে এডমিশন টেস্ট দিয়ে প্রণয় সেন্ট অগাস্টিনে সুযোগ পায়নি। সাংসারিক অশান্তি এড়াতে এই প্রথম বোধহয় বিনয়কান্তি দত্ত বাধ্য হয়েছিলেন নিজের প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করতে। তারক নিয়োগী কালিম্পং-এ গিয়ে সব কিছু ব্যবস্থা করলেন। প্রণয় ক্লাস সিক্সে ভর্তি হল গৌরব তখন ক্লাস টেন পরের বছরই আইসিএসসি পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করলো। গৌরব যেবার আই এস সিতে রেকর্ড নম্বর পেল সে বছরই প্রণয়কে ক্লাস এইটে পর পর তিনবার স্কুল-বোর্ডিঙের ডিসিপ্লিন ভাঙার দায়ে বহিষ্কার করা হল। এর আগে দু’ দুবার বাড়িতে চিঠি দিয়ে স্কুল থেকে গার্জেনকে জানানো হয়েছিল। ন’কাকিমা সে চিঠির ব্যাপারে সব জানতেন। কিন্তু তার অকারণ অহংবোধ তাঁকে এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা বা পরামর্শ করতে দেয়নি। ন’ কাকিমা ভেবেছিলেন কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ, চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেণ্টের নাতি স্কুলের বড় প্যাট্রন বসুন্ধরা গ্রুপ অব কোম্পানিজ-এর মালিকপক্ষ, বসুন্ধরা ভিলার ছেলে। প্রণয়ের গায়ে আঁচটুকু লাগবে না। অকারণ ভয় দেখাতে এসব চিঠি পাঠিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সুজাতা জানতেন না মিশনারি স্কুলে আইনকানুন সুকঠিন। শেষে মাত্র দু’ লাইনের একটা টেলিগ্রামে জানানো হল অভিভাবককে সর্বাধিক সাতদিনের মধ্যে অফিস চালু থাকাকালীন গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে প্রণয়কান্তি দত্ত ও তার জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একটা তালিকা।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৭: শ্যামসুন্দর হয়তো স্বর্গের কোনও অভিশপ্ত পুরুষ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্‌সা,

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৬: বেদজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন যবক্রীত

এই প্রথম সুজাতা দত্ত একটু মুষড়ে পড়লো। বসুন্ধরা ভিলার আর কারও সঙ্গে খুব একটা কথা না বললেও আমার বাবা অমলকান্তি আর মা সুরঙ্গমার সঙ্গে ন’কাকিমার কথাবার্তা হতো। সব শুনে মা বললেন—

এত চিন্তা করো না সুজাতা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে প্রণয়কে নিয়ে এসো। বাচ্চা ছেলে একা ওই পরিবেশে ভয় পাবে। প্রণয়কে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করানোর দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তোমার সেজদার অনেক জানাশোনা আছে। একটা না একটা ব্যবস্থা হবে।

মার উদ্যোগে প্রণয়কে কলকাতার একটি আইসিএসসি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। খালি বাবা মাকে বলেছিল—

তোমার কথা রাখতে গিয়ে এ বয়েসে শেষে আবার যেন বেইজ্জত না হই। মা-বেটাকে একটু সামলে চলতে বলো। কালিম্পং থেকে কলকাতায় এসেছে। এখানে বজ্জাতি করলে ক্যানিং ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে যেতে হবে। ওখানে আমার পরিচিত বলতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বাবার এমন চূড়ান্ত ঠাট্টায় আমার মা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই উপযুক্ত উত্তরও দিত।

বাঘেরা গল্প উপন্যাস না পড়লেও সিনেমা তো দেখতো । আমার এক দুটো ফ্যান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

আইসিএসসি বা আইএসসি উতরে গেল প্রণয়। সেন্ট অগাস্টিনের ধাক্কাটা স্কুল জীবনটায় তাকে খানিকটা শুধরে দিয়েছিল। দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে মাস্টার্স করার পর গৌরব বসুন্ধরা গ্রুপ জয়েন করলো। অনেক মানুষের নানান স্বপ্ন থাকে। গৌরবের স্বপ্ন ছিল লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস পড়াশোনা করার। কিন্তু গৌরব চেয়েছিল লন্ডনে নিজের পড়াশোনার খরচটা সে নিজেই জোগাড় করবে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে এক্সিকিউটিভ গ্লোবাল মাস্টার্স করতে গেলে তিন বছর চাকরি করার অভিজ্ঞতা লাগে। সুতরাং অর্থ আর অভিজ্ঞতা জোগাড় করতে গৌরবের সামনে অনেক বেশি সুযোগসুবিধে অনেক মোটা স্যালারিতে দেশি-বিদেশি কোম্পানির হাতছানি ছিল। কিন্তু ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য যে মামার বাড়ি বা দাদু তার হাত ধরেছিল পায়ের তলায় জমিটা শক্ত হলেও তখন গৌরব সে হাতটা ছাড়তে চায় নি। তাই সে বসুন্ধরা গ্রুপ অব কোম্পানিতেই জয়েন করলো।

আভেরি দীক্ষিত, পড়াশোনা সব বম্বেতে। বাবা মাতুঙ্গার বিখ্যাত ভিজেটিআই-এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক। মেয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইকোনমিক্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করল তারপর লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস-এ মাস্টার্স করবার সময় সৌরভের সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা।

আভেরিরা বর্ধিষ্ণু পরিবার। ওরলিতে অনেকটা জায়গা নিয়ে তার দাদুর বাড়ি ছিল। দাদুর পৈতৃক ব্যবসা ছিল কটন মিলস-এর। সেই রমরমা না থাকলেও সৌরভের বিয়ের সময় আভেরির অন্যান্য কাকা-জেঠারা সেই ব্যবসা সামলাতো। আভেরির বাবা ছোট্ট থেকে পড়াশোনার জগতের মানুষ। তিনি মেজভাই। দাদা বা ভাইদের ব্যবসাতে মাথাও দেননি আর ব্যবসার রোজগারের কোন ভাগও তিনি নিতেন না। আভেরির দাদু বিষয়ী মানুষ ছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের কিছুদিন পরেই তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন তাঁর মেজছেলে মানে আভেরির বাবার পৈতৃক ব্যবসা বা টাকা-পয়সা নিয়ে খুব একটা উৎসাহ নেই সে পড়াশোনা ছাত্র রিসার্চ পেপার ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের নতুন কাজকর্ম এসব নিয়ে সম্পূর্ণ একটা আলাদা দুনিয়ার মানুষ।তাই তিনি শরীর অসুস্থ হবার পরে পরেই বাড়ি-ব্যবসা সব আলাদা করে দিয়েছিলেন। যেহেতু ব্যবসার ভাগ নেয়নি তাই মেজো ছেলে ও তার পরিবারকে নিজের বাড়ির সবচেয়ে ভালো অংশটা লিখে দিয়েছিলেন। আর নাতনি আভেরির বিয়ের জন্যে আলাদা করে একটা টাকা ব্যাংকে ফিক্সড করে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১০: পেটের গ্যাস সারা দেহেই ঘুরে বেড়ায়!

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

ঈশ্বর একটা অদ্ভুত ম্যাজিক করেন। যার চাহিদা যত বেশি তিনি তার সঙ্গে ততো কৃপণতা করেন। ছোটবেলার বিস্কুট বা জিলিপি রেসের মত সুতোয় বাঁধা প্রাপ্তিটা সামনে ঝুলতে থাকে। নাকের পাশ দিয়ে মুখের পাশ দিয়ে সরে যেতে থাকে। কামড়ে ধরা যায় না। যার এসবের তেমন কোনও উৎসাহ আকাঙ্ক্ষা নেই। তাকে তিনি প্রয়োজনের বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দেন। আভেরির বাবা প্রায়ই বলতো কলেজে পড়িয়ে ওরলির মতো এরকম জায়গায় বাড়ি নিয়ে থাকার ক্ষমতা আমার কোনওদিনই ছিল না। ভাগ্যিস বাবা থাকতে দিল। আভেরি একমাত্র মেয়ে। বাবা আর্থিকভাবে মধ্যবিত্ত হলে হোক কিন্তু কাকা জ্যাঠারা তো উচ্চবিত্ত বটেই। তারপরে দাদু-নাতনির বিয়েতে একটা মোটা টাকা রেখে গিয়েছেন। যদিও সে সময় ইন্টার কমিউনিটি বিয়েটা খুব একটা চালু নয় কিন্তু আভেরির বাবার দিক থেকে কোনওরকম আপত্তি ছিল না। ফলে অন্য আত্মীয়দেরও খুব একটা কিছু বলার ছিল না। আভেরির কাছে তারা শুনেছেন পাত্র গৌরব অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মামারবাড়িতে মানুষ। তার মামারবাড়ি কলকাতার ডাকসাইটে বনেদি বড়লোক ব্যবসায়ী ফ্যামিলি। সুতরাং দেওয়া-থোওয়া এসব বিষয়ে ভাইয়েরা বসে শলাপরামর্শ শুরু করল। কিন্তু তাদের সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম অ্যাজেন্ডায় জল ঢেলে দিল পাত্র নিজে।—চলবে
ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৯

“সৌরভ যেভাবে চেয়েছিল বিয়ের ব্যবস্থা সেভাবেই হয়েছে। মাকে আর সেজো মামা অমলকান্তি সেজমামিমা সুরঙ্গমাকে বিয়ের দুদিন আগে কলকাতা থেকে বম্বে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল বম্বের তাজ হোটেলে। তাজমহল টাওয়ার নয়। তাজমহল প্যালেসে।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content