শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

সকলের সঙ্গে পূষণও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। তারও পিছনে ফেলে আসা পথে সন্ধ্যার অন্ধকার মেহফিল সাজিয়ে বসার উদযোগ করছে। চারপাশের আকাশচুম্বি গাছের পাতায় নেমেছে ঘুম। কুয়াশার মিহিন আস্তরণ জঙ্গলের নীচের জমি ঢেকে দিচ্ছে দ্রুত। চারপাশ যেন থমথম করছে। পূষণের মনে হল, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। কী যেন থাকার কথা ছিল এই দৃশ্যপটে, কিন্তু নেই। সে মনে করার চেষ্টা করল, কিসের অভাবে সমস্ত প্রেক্ষাপট তার মনে একটা আনক্যানি ফিলিংস, বিজাতীয় একটা অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু তার মনে পড়ল না। তবে এতকিছুর মধ্যে ঈশ্বরীপ্রসাদ বা আর-কেউ যে চেঁচিয়ে উঠে কাউকে দেখার কথা বলেছিল, তেমন কোন চিহ্ন তার চোখে পড়ল না। বাসের ড্রাইভার, মঙ্গল মাহাতো, ঈশ্বরীপ্রসাদ, সে, রিমিতা এবং বাসের অন্যান্য যাত্রীরা ছাড়া আর কেউই নেই। রিমিতা অবশ্য বাসেই বসেছিল। নামেনি। এত দীর্ঘ পথের ক্লান্তি তাকে নিশ্চয়ই গভীরভাবে গ্রাস করেছিল। এদিকে হইচই বাড়ছিল। অনেকেই উত্তেজিত হয়ে নানা কথা বলছিল। পূষণ একবুক অস্বস্তি নিয়ে সেই দিকে মন দিল।
অচেনা একজন বলছিল, “উটা লিশ্চয়ই কালাদেও ছিল। ইটোকে সাবাড় করছিল বট্যে, আমরা এতগুলান লোক এস্যে পড়ায় জঙ্গলে ঢুকেছে!”

“খানিক বাদে আবার আসবে। ও ডেরাইভার সাহেব, তু জলদি বাস ছাড় ক্যেনে! চল, চল, ইখান থেকে তাড়াতাড়ি পলাইন চল!” আর এজকজন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল।

পূষণ পাশের একজনকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, কালাদেওটা কে? কোন দেবতা?”
লোকটা স্থানীয়, কিন্তু পোশাক-আশাক বাকিদের মতো নয়। পরিষ্কার ট্রাউজার-শার্ট পরা, পায়ে সস্তা লেদারের জুতো। হাতে একখানা পুরানো মডেলের ঘড়ি। তার চেয়েও বড় কথা বুক পকেটে একখানা মোবাইল উঁকি দিচ্ছে, যদিও অনেক আগের মডেল। পূষণের প্রশ্ন শুনে তিনি তাকালেন তার দিকে। তারপর বললেন, “আপনি বোধহয় এ-অঞ্চলে সদ্য এসেছেন?” মানুষটির মুখের ভাষা শুনে বোঝা গেল সে যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। ভদ্রলোক শিক্ষিত এবং কথা বলেন স্থানীয় ভাষার টান ছাড়াই।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৭: শ্যামসুন্দর হয়তো স্বর্গের কোনও অভিশপ্ত পুরুষ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

পূষণ বলল, “আমি ট্যুরিস্ট। বন্ধুর সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছি। আজকেই ট্রেন থেকে নেমেছি দুপুরে। এখনও যে রিসর্টে থাকবো, সেখানে পৌঁছতে পারিনি। অতএব বলতে পারেন, এ-অঞ্চল সম্পর্কে কিছুই জানি না!”

লোকটি হাতজোড় করে নমস্কার করলেন, তারপর বললেন, “নমস্কার। আমার নাম ভবানীপ্রসাদ রায়। আমি স্থানীয় একটি স্কুলে ইতিহাস পড়াই। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?”

পূষণ প্রতিনমস্কার করে নিজের নাম বলে জিজ্ঞাসা করল, “কলকাতা। গিয়েছেন?”
“বার-চারেক গিয়েছি। তার মধ্যে এক-দুবার ওই গিন্নি আর ছেলেমেয়ের বায়নায় কলকাতা ঘুরতে। কালীঘাট, চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়ার বাগান—এইসব দেখতে আর কী!”

“আচ্ছা। তা বললেন না, কালাদেও কে ? কোন দেবতার নাম?”

“আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন বলছেন, এ-জায়গার সন্ধান কে দিল আপনাকে?”
“আজকাল প্রযুক্তি মানুষকে অনেক ঝুটঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দেয় ভবানীবাবু। নানারকম ব্লগ, ট্র্যাভেল গ্রুপ ইত্যাদি আছে, সেখান থেকেই সব ইনফো পাওয়া যায়। ‘সময় আপডেটস’ বলে একটা ই-ম্যাগ আছে, সেখান থেকেও অনেক নতুন নতুন ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশানের খোঁজ মেলে। ধরে নিন, তেমনই কোনও একটা জায়গা থেকে পেয়েছি। কিন্তু কেন?”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৮: সপ্তপদী: মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার মধ্যে মিলন রাখেননি তারাশঙ্কর

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

ভবানীবাবু হাসলেন। বললেন, “আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন বুঝতে পারছি। আসলে আমি বলতে চাইছিলাম, আপনি যেখান থেকে সংবাদ পেয়ে এই প্রায় পাণ্ডববর্জিত জায়গায় বেড়াতে এসেছেন, সেখানে কি পিচাশপাহাড়ের কথা পাননি?”

“পিচাশপাহাড়? পিশাচপাহাড় বলে একটা ডেস্টিনেশানের কথা পেয়েছি, কিন্তু পিচাশপাহাড় না কি নামটা?”

“হ্যাঁ। আসলে নাম পিশাচপাহাড়, কিন্তু স্থানীয়দের মুখে হয়ে দাঁড়িয়েছে পিচাশপাহাড়। তা কালাদেও সেই পিচাশপাহাড়ের দেবতা।”

“ওহ। আচ্ছা! বুঝলাম। মন্দির আছে তবে, পূজা-টুজাও দেয় নিশ্চয়ই স্থানীয়রা?”

“স্থানীয়রা পিচাশপাহাড়কে এড়িয়ে চলে পূষণবাবু। পিচাশপাহাড়ে কোনও মন্দির নেই। পিচাশপাহাড় স্বয়ং কালাদেও। গোটা পাহাড়টাকেই ওরা দেও মনে করে। বছরে নির্দিষ্ট একদিন, কার্তিক মাসের কৃষ্ণা-চতুর্দ্দশীতে কালাদেওকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য বিশেষ পূজা দেয় স্থানীয়রা। একটা গরু বা মোষ ওইদিন পাহাড়ের পাদদেশে একটা গুহা আছে, সেখানে রেখে দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক গুহা। জানেনই তো এ-সব পাহাড়ের রেঞ্জ হিমালয়ের চেয়েও বয়সে অনেক অনেক পুরানো। সেই রকম পুরানো একটা গুহা। তার সামনেই সন্ধ্যে থেকে পূজা হয়। রাত ঠিক বারোটা বাজলে গরু বা মোষ—যা থাকবে, তার পিঠে একখানা সাদা কাপড় বিছিয়ে সেখানে পূজারী এবং আরও যারা ইচ্ছুক তাদের হাতের আঙুল থেকে রক্ত বার করে কালাদেওর নামের মন্ত্র লিখে একবারের জন্যও পিছনে না ফিরে সকলে চলে আসে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১০: আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন, ইতিহাস এবং কিছু প্রশ্ন

পরদিন একটু বেলায় আবার যাওয়া হয়। তখন যদি গরু বা মোষ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় দেখে তখন ধামসা-মাদল সহযোগে সবাই আনন্দ করে, মিষ্টিমুখ করে। ওইদিন দুপুরে উপস্থিত সকলের জন্য কালাদেওর প্রসাদ স্বরূপ মুরগীর মাংস-ভাত খাওয়া হয়। আগে শুনেছি, জীবন্ত একজন মানুষকে উৎসর্গ করা হতো। পরদিন তার ছিন্নভিন্ন, আধখাওয়া দেহাবশেষ দেখতে পেলে স্থানীয়রা নিশ্চিন্ত হতো এই ভেবে যে, কালাদেও প্রসাদ পেয়ে খুশি হয়েছেন। আবার এক বছরের জন্য তিনি নিদ্রা যাবেন।”

পূষণ বলল, “এই ট্যুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছেও আপনারা এই সব কথা বিশ্বাস করেন? এ-সব তো মিথ, গাঁজায় দম দিয়ে কেউ কখনও বলেছিল, তারপর সেটাই লোকের মুখে মুখে ‘সত্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে!”

ঈশ্বরীপ্রসাদ বলল, “আরে ছ্যার, যা জানেন না তা নিয়ে বুলতি আসবেন না তো! কালাদেও মিথ্যা? তাহলে সত্য কী?”—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content