সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আমরা সকলেই জানি বসন্তের রং হলুদ। আর এই হলুদ রঙের উৎস হল হরিদ্রা বা হলুদ। এই রং জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতীক। শুধু তাই নয়, এটি ধনবৃদ্ধি, ঐশ্বর্য ও পবিত্রতার চিহ্নস্বরূপ হয়ে হিন্দুদের সংস্কৃতির সঙ্গে বহুকাল ধরে মিলে মিশে আছে। তাই ‘গাত্রহরিদ্রা’, ‘পাটিপত্র’, ‘দেবীর বরণপাত্র’, পোঙ্গল, সরস্বতী পুজোর সকালে তেল-হলুদ মেখে স্নানের মতো লোকাচার ছাড়াও আমাদের প্রতিদিনের রোজনামচায় হলুদের ব্যবহার অনস্বীকার্য। হলুদের বিজ্ঞানসম্মত নাম: কারকিউমা লঙ্গা।
 

গাছের প্রকৃতি

হলুদ গুপ্তবীজী, একবীজপত্রী, বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছের কাণ্ড রাইজোম প্রকৃতির। এই রাইজোম-ই হলুদ হিসাবে ব্যবহার হয়।
 

উৎপত্তি ও বিকাশ

হলুদ গাছ ভারতের বিভিন্ন অংশেই পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, কর্ণাটক, গুজরাত, মেঘালয-সহ একাধিক রাজ্যে হলুদ চাষ হয়। তবে এই গাছটির প্রাচীন উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ ভারত ও ইন্দোনেশিয়া।

আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: বাড়তি রক্তচাপ চিন্তা বাড়াচ্ছে? উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী করবেন, কী করবেন না

উত্তম কথাচিত্র: পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি: পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

 

যে সব উপাদানে ভরপুর

কারকিউমিনয়েড, কারকিউমিন, ক্যাফিক অ্যাসিড, লিমোনিন, বিটাপিনিন, অ্যাজিউলিন, সিনিওলি, সাইক্লোঅক্সিজিনেস-২ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে হলুদে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, নিয়াসিন, সোলেনিয়াম থাকে। হলুদে উপস্থিত তিনটি প্রধান উপাদানের পরিমাণ হল— কারকিউমিন ৭৭ শতাংশ, ডি মিথক্সি কারকিউমিন ১৭ শতাংশ এবং বিস ডি মিথক্সি কারকিউমিন ৩ থেকে ৬ শতাংশ।
হলুদে শক্তির পরিমাণ ২৯ ক্যালরি। পুষ্টিগুণ বিচার করলে হলুদে উপস্থিত কার্বহাইড্রেটের পরিমাণ ৬৯ শতাংশ, প্রোটিন ৬ শতাংশ, ফ্যাট ৫ শতাংশ, মিনেরাল ত শতাংশ এবং জলীয় অংশ রয়েছে ১২ শতাংশ। এছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, পটাশিয়াম আছে ৫ শতাংশ। হলুদ কিন্তু ভিটামিন-সি এরও একটি ভালো উৎস।

আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল: পর্ব-৬: খলনায়ক থেকে নায়ক

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে হলুদের ব্যবহার

 

যকৃতরস ক্ষরণে সাহায্য করে

কাঁচা হলুদের মধ্যে উপস্থিত বিশেষ উপাদান যকৃত থেকে যকৃতরস ক্ষরণে সাহায্য করে যকৃতকে রক্ষা করে। এছাড়াও যকৃত থেকে উৎসেচক নিঃসরণ ক্ষমতা বাড়িয়ে টক্সিন বিপাকে সাহায্য করে।
 

অ্যালার্জি-চুলকানি

অ্যালার্জিজনিত কারণে চুলকানি বা শরীরে চাকা চাকা দাগ হলে একভাগ নিমপাতা গুঁড়ো, দুই ভাগ শুকনো হলুদগুঁড়ো এবং তিনভাগ আমলকীগুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে রোজ সকালে এক গ্রাম করে খালি পেটে খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
 

হাঁপানিতে উপশম

হলুদগুঁড়ো, আখেরগুড় আর খাটি সরষের তেল একসঙ্গে মিশিয়ে চেটে খেলে হাঁপানিতে উপশম হয়।
 

মচকে গেলে

কোনও জায়গায় মচকে গেলে চুন-হলুদ এবং লবণ মিশিয়ে গরম করে সেই জায়গায় লাগালে ব্যথা ও ফোলা কমে যায়।
 

কনজাংটিভাইটিস

কনজাংটিভাইটিসে হলুদ থেঁতো জলে চোখ ধুলে চোখের লালভাব তাড়াতাড়ি সেরে যায়।
 

ফোড়া হলে

পোড়া হলুদের ছাল জলে গুলে সেটা ফোড়াতে লাগালে ফোড়া পেকে ফেটে যায়। পরে ওই জায়গায় হলুদে গুঁড়ো লাগালে জায়গাটি শুকিয়েও যায়।
 

ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে

আমরা রান্নার কাজে হলুদ ব্যবহার করি কারণ হলুদে উপস্থিত কারকিউমিন নামক রঞ্জক পদার্থ জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, কাঁচা মাছ ও মাংসে থাকা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া যেমন ব্যাসিলাস, সেরিয়াস, বি সাবটাইলিস, স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস, ই কোলি ইত্যাদি ধ্বংস করতেই হলুদগুঁড়োর ব্যবহার হয়।

আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৯: দাঁতে পোকা! সত্যি, নাকি নিছক ধোঁকা?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

 

স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখে

হলুদ আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখে।
 

আর্থাইটিস ও গাউট

হলুদে উপস্থিত সাইক্লোঅক্সিজেনাস২— আর্থাইটিস ও গাউটের জন্য খুবই উপকারী। হলুদবাটা এবং চুন লাগিয়ে গরম সেঁক দিলে ব্যথার উপশম হয়।
 

ক্যানসার প্রতিরোধে

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পান পাতার সঙ্গে এক টুকরো হলুদ চিবিয়ে খেলে মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
 

ছত্রাককে ধ্বংস করে

হলুদে উপস্থিত কারকিমিন তেল বিভিন্ন ছত্রাককে ধ্বংস করে। এছাড়াও ক্যাফিক অ্যাসিড, কারকিউমিন, লিমোনিন এসেন্সিয়াল তেল সক্রিয় ভূমিকা পালন করে অ্যান্টি ক্যানসার, অ্যান্টি এইচআইভি, সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম-স্টিমুলেটার হিসাবে।
 

আরও যেসব ক্ষেত্রে কাজ করে

বিজ্ঞানীরা হলুদের মধ্যে বেশ কিছু সক্রিয় উপাদান শনাক্ত করেছেন, যা মানুষের খুবই প্রয়োজনে লাগে। যেগুলো নানান রোগব্যাধি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। যেমন—
অ্যাজিওলিন: অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টি আলসার, অ্যান্টি অ্যালার্জি হিসাবে কাজ করে।
টারমেরন: রক্তপাত বন্ধ এবং অ্যান্টিটিউমার এজেন্ট হিসাবে কাজ করে।
আলফা: পাইনিন নামক এসেনশিয়াল তেল অ্যালার্জিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল অ্যান্টি ফ্লু, অ্যান্টি ভাইরাস হিসাবে কাজ করে।
এসকরবিক অ্যাসিড ও বিটাক্যারোটিন: যথাক্রমে হাঁপানি, হৃদরোগ, ছানি, ক্যানসার, স্ট্রেস প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে।

এর থেকে অতি সহজেই বোঝা যায়, হলুদের মধ্যে উপস্থিত যৌগগুলি মানুষের রোগ নিরাময়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এসব কারণের জন্যই হয়তো হিন্দু সংস্কৃতিতে ভগবান ও অতিথিকে হলুদ, কুমকুম ইত্যাদি দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content