বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


মেন উইল বি মেন…
তাই বলে এই নয় যে, আজ একটু সহানুভূতির মাত্রা বাড়াবো না। যদিও আমাদের ওই শিবরাত্রির পূজন-সাধন আছে, তবুও আজ বিশ্বের দরবারে পুরুষ-শ্রেষ্ঠর নামে বিশেষ দিনটি বরাদ্দ। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, বাসে তোমার পাশে বসা মহিলাটি উঠে দাঁড়িয়ে তোমায় বসতে দেবে। আজও তোমাকেই কিন্তু উঠতেই হবে বারো মাসের মতো। সিটটা ছেড়ে দিতে হবে কচি বাচ্চার মাকে, বয়স্ক মহিলাকে, সুন্দরী ছিপছিপে যুবতীকে। নইলে ‘পুরুষ’ তোমার কদর নাই। রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে তোমরা যেন হাত-পা-চোখ যতটা সম্ভব গুটিয়ে রেখো, পারলে সেঁদিয়ে থেকো এককোণে অথবা আমরা যতই চেঁচাই না কেন “ধর্ষক একটা জাত, এব্যুজারের নারী-পুরুষ ভেদ হয় না” তবুও আমরা মন থেকে মানবো না এসব, আজকের মতো আরও অনেক দিনেই। সত্যি বলতে কি, জানি কিন্তু মেনে নিতে পারি না। বিশেষ মুহুর্তগুলোতে বলতে হয় তাই বলি।

বাতাসে আমার শাড়ি উড়লে আমি পাশ দিয়ে যাওয়া তোমাদেরই দোষী করি পুরুষ। আর করবো না-ই বা কেন? ‘মুড সুইং’ যে আমাদের বিশেষ ব্যাধি। পুরুষমাত্রই দোষী আমাদের ভাবনার অভ্যেসে। এগুলো আমাদের জন্মগত ব্যামো। বিগতদিনে তবু নারী হতে বছর ১২/১৫ লাগতো। এখন ৬মাসের শিশুও পূর্ণ নারী, জন্মটাই আমাদের ‘নারী’ যোনিতে, ‘অসহায়’ রাশিতে এবং ‘অবলা’ নক্ষত্রে। শরীরের কতগুলো মাংসপিণ্ডই আমার পরিচয়। বেড়ে ওঠায় সঙ্গে সঙ্গে সেই মাংসপিণ্ড আমাদের মন মস্তিষ্কের থেকেও দামী হতে থাকে। তাই তো বিটপীলতার মতো মাথা ফুঁড়ে ওঠা পেলব মশৃণ নারীকূলের সম্বর্ধনায় নারীদিবসের সপ্তাহ ব্যাপি হইহুল্লোড়, অথচ বটবৃক্ষসম ছায়াদানকারী পুরুষজাতীর জন্য বিশেষ দিবস যে স্বীকৃত তা কতজন জানে? মনে না করালে বলতে পারে ১৯ নভেম্বর বিশ্বপুরুষ দিবস?
মানুষের মধ্যে থেকে নারীকে ভিন্ন করা হয়, বিকলাঙ্গ মানুষকে ভিন্ন করা হয়, পুরুষকে নয়। পুরুষ তোমরা কেন তবে ভিন্ন হবে না? তোমাদের সুরক্ষায় ভিন্ন আইন হোক, তোমাদের জন্য ট্রেনেবাসে ভিন্ন কামরার দাবি কেন রাখো না তোমরা? নারীকে বিছানায় ভোগ্য ভাবে না, সেক্সটয় ভাবে না এমন অনেক পুরুষ আছে জানি না কিন্তু মানি। তবু সমাজ তোমাদের নারীমাংস লোভী ভাবতে দ্বিধা তো করে না। সকল নারীর পুরুষ বিদ্বেষ প্রায় একচেটিয়া। নারী জন্মস্বাধীন, নারী কোনওদিন অবলা নয়, এই কথা নারীসমাজ কত টুকু বোঝে? যারা বোঝে তারা ভালোবাসে পুরুষকে। আমার শ্রমের রান্নার ভাগ খেতে আমার বাড়ির পুরুষটার কুণ্ঠাবোধ নেই। তার অধিকার সে মানে বলেই রান্না ঘরে পুড়তে হয় একজন মহিলাকে। তবে বলতো পুরুষ তোমার শ্রমের টাকায় ভাগ বসাতে আমাদের কোথায় মর্যাদাহানী হয়? তবু তোমাদের মর্যাদা দিতে গিয়ে সমাজ সংস্কারক – সমাজের দণ্ড মুণ্ডের কর্তা, নিয়ন্তা হিসেবে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা নিজের চাহিদা, পিপাসা সব-সহ গুটিয়ে যেতে থাকি ক্রমশ, যদি পারতাম মায়ের জরায়ুতেই সেঁদিয়ে যেতাম। তারপরেও কিন্তু তোমরা রাজার রাজা তাই ৩৬৪ দিনের পরেও আরও একটা তোমাদের জন্য দিন আঁকা হয়েছে পাঁজিতে।

কিন্তু সমাজ আমাদের কোণঠাসা করেছে, মস্তিষ্ক সংকুচিত করেছে আর আমরা নাগালের মধ্যে পাই তোমাকে, তোমাদের। তার দায় ভার তুলে দিই তোমাদের কাঁধে। পুরুষ আমাদের অনেকের কাছে ‘মানুষ’ নয়, বাড়ির পুরুষটিও নয়, প্রেমিক পুরুষটিও নয়। সে হয় কব্জায় নয় নালিশে। তাই বলি একটু বুঝে নিও আমাদের, বুঝতে তোমাদের হবেই। এই ধরো, দিনগত শ্রমের পর বাড়ি ফিরছ ছুটতে ছুটতে, তোমায় চা জল খাবার দেবো, তুমি তারপর বাচ্চার সঙ্গে সময় দেবে, ঘরের কাজে মন দেবে, দিতেই হবে। টিভির রিমোট তুমি পাবে না, সন্ধ্যের টিভি তোমার নয়, ছুটিও তোমার নাই। তুমি ‘পুরুষ’ যত ত্যাগ করবে ততই আদর পাবে। মুঠোয় রাখতে কে চায় ছেলে? যাওনা তুমি ফেসবুকে, যা খুশি কর, কিন্তু আমার নজরে থেকেই সেসব করতে হবে। আর যা খুশি তুমি করতেই পারো, কেবল অন্যের ছবিতে লাভ বা কেয়ার ইমোজি দেবে না। আরও তো আছে কত… ওয়াও দাও, বুড়ো আঙ্গুল দাও যা খুশি দাও।
আরও পড়ুন:

হে চিরনূতন…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর

খাই খাই: ভোজবাজি এ বার বাড়িতেই, রইল লোভনীয় স্বাদের নবাবি ফিরনি-র রেসিপি

আমাদের সমরেশবাবু কিন্তু বলে গিয়েছেন, “পুরুষ মানুষ চিতায় উঠেও যদি একবার চোখ মেলার সুযোগ পায় তবুও সেটা মেলবে মেয়েদের দিকে”—একথা আমরা প্রতিনয়ত স্মরণে রেখেছি।

তবুও বলি, পুরুষ তুমি ভালো থাক হাসিখুশি থাক, শুধু রাত জেগো না, আমি অফ লাইন থাকলে অন লাইন যেন থেকো না। আমি তোমার জীবন জুড়ে সাময়িক থাকলেও তুমি আমার স্মৃতি নিয়ে আজীবন কাটিয়ো। এই সামান্য টুকু করো পুরুষ। আর হ্যাঁ, আমি ঝগড়া করতে ভালোবাসি না, তবু করতে হয়, ঝগড়া করে “আর ফোন করো না” বল্লেই বুঝে নিও ফোনটা আমি কাটলে তোমাকেই করতে হবে, বার বার করতেই হবে। “গুড নাইট” বললে কিন্তু ভুলেও চলে যেও না, তখন তোমায় আরো একটু চাই বুঝে নিও। তোমাকে অনুরোধ করতে হবে, “আরেকটু থাকবে না?” তাই বলে আবার বাড়াবাড়ি করে দাবি-টাবি দেখিয়ে বসো না যেন, “থাকাই উচিত, যাওয়া চলবে না” ইত্যাদি বলে টাইম-ফাইম বেঁধে দিয়োনা। কোনও ভাবেই যেন না প্রকাশ পায়, তুমি ডোমিনেট করছ। আমাকে রাখো আদরে, আবদারে, অনুনয়ে, বিনয়ে। নইলে কিন্তু ফেবুর ওয়াল আছে, ফ্রেন্ডলিস্টে নারীবাদীরা আছেন, উকিল টুকিল দু’ চারজনও আছেন, কোর্ট কাচারির রাস্তাও চিনি। যতই মাথা ঠান্ডা রেখে বলিনা কেন, “শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে গো”, তা কেবল কবি বলতে বলেন বলেই বলা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

হেলদি ডায়েট: পেট ফাঁপা ও বদহজমের সমস্যায় ভুগছেন? এই ঘরোয়া উপায়গুলি ম্যাজিকের মতো কাজ করবে

তাই বলি পুরুষ, ভালোবাসি তোমায়, আদর শুধু তোমারই জন্য। তুমি শুধু বুঝে চল আমায়, মুঠো বন্ধ করে রেখো না, উদার হাতে ছেড়ে দিও। আমি তোমায় কিছুটা মুঠো বন্ধ করলেও করতে পারি, নাক কান মুলে দিলেও দিতে পারি, তোমার দোষ ধরা, তোমাদের নিয়ে মস্করা করা আমাদের ওই শীত দুপুরের কমলা লেবুর খোসা ছাড়ানোর মতোই, গরমের দুপুরে আচার চাটার মতই সৌখিনতা — আমরা ভালোবাসি কিনা! তোমাকে আদরে সম্মানে রাখতে চাই কিনা! সেই কারণেই। একটু ভাজা মাছটা উল্টে খেতে না জানলেই হয়, একটু ভালোমানুষী শিখে নিলেই হয়, একটু তেল-তুল দিতে পারলেই হয়, একটু সোহাগী আমি সেটা মেনে নিলেই হয়, সামান্য একটু জায়গা ছেড়ে চেপে বসলেই হয়, মাত্র তো দুদিনের জার্নি, “নারী শক্তির জয়” অনায়াসে মেনে নিলেই হয়। ব্যাস, এইটুকুতেই মাথায় তুলে রাখবো তোমায় দেখো। “পুরুষ সিংহ” বলব কেমন দেখো, ‘ধ্রুবতারা’ও বলবো তোমায় আমার আকাশের। শুধু ভিজে বেড়ালটি হয়ে থেকে যেও, হুংকার করে নিজে নিজেকে সিংহ বলো না তাহলেই তুমি “আদরনীয় পুরুষ”।

তবে দিনের শেষে মনের ঘরে উঁকি দিলে দেখি আমার চোখে আমার জন্মদাতার বাইরে আর কোনও পুরুষের দেখা আজও পাইনি। তাঁর শাসনে আমি নত থেকেছি, তার ভুল শাসনের পর আদরের বাঁধ ভঙেছে যখন তখন পেয়েছি হিসেবহীন স্নেহ। তার প্রতিবাদে প্রতিহিংসা আসেনি। তার শাসনে পেয়েছি সুদূর প্রয়াকসী শুভেচ্ছা বার্তা। সে আদর করলে পালটা আদর আসেনি, বরং মনে গড়ে উঠেছে পরমবিশ্বাস ও কনফিডেন্সে। মনে হয়েছে আমিও গড়ব আমার সন্তানদের এই মনবলেই।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৫: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র— বইয়ের জন্য ভালোবাসা

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪০: কীর্তনখোলা নদীর তীরে সন্ধ্যার বরিশালের অন্য আকর্ষণ

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

আমার ভিতরে যে আত্মগর্ব, আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মানের পূর্ণ বিকাশ, তা শুধু মাত্র সেই পুরুষের স্নেহছায়ায় যার বদলে সে কিছুই চায় না। দেওয়া-নেওয়ার হিসেব কষে ভালোবাসে না কোনও পিতা, কারণ তার দানের প্রতিদান দেওয়ার পরিমাণটাই আমাদের জেনে ওঠা হয় না। সে শাসক হলে আমরা শুভত্ব পাই, প্রেমিক পুরুষ শাসক হলে আমরা পাই মানসিক অত্যাচার, প্রেমিক পুরুষ নরম হলে ছড়ি ঘোরাই আমরাই, বাবা নরম হলে আমরা সন্তানস্নেহ খুঁজে পাই তার মধ্যে। বাবা গড়তে চাইলে ভরসা পাই, প্রেমিক গড়তে চাইলে ধান্ধাবাজির গন্ধ শুঁকি। কারণ, আমৃত্যু বাবা শুধু ত্যাগ করে আমাদের গড়তে। প্রেমিক পুরুষ ভান করে যেন গড়ার অথচ ভেঙে দিতে হবেই একদিন সমূলে এই লক্ষ্যেই। সেহেতুই প্রতিজন নারীর প্রথম ও উত্তম পুরুষ তার প্রথম দেখা সেই শ্রদ্ধেয় পিতাই।

সকলকে বিশ্বপুরুষ দিবসের শুভকামনা, আর যাই হোক না কেন সে যেন তার সন্তানের আদর্শ পুরুষ হয়েই থেকে যায়।

প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Skip to content