শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রাজস্থানের অখ্যাত গ্রাম বারমের। চারিদিকে ধু-ধু মরুভূমি, কাঁটা তার দিয়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা করা আছে এই গ্রামকে। দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রামীণ বাড়ি। এই গ্রামেরই এক অস্বচ্ছল পরিবারে ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে রুমা দেবী জন্মগ্রহণ করেন। বয়স তখন মাত্র চার, সেই সময়ে ছোট্ট রুমা বাবা-মাকে হারিয়ে ঠাকুমার কাছে থাকতে শুরু করেন। তাঁর ঠাকুমা রাজস্থানের ওই প্রদেশের এমব্রয়ডারির কাজ খুব ভালো জানতেন। ঠাকুমার কাছেই তাঁর ওই কারিগরি শিক্ষার শুরু।

বাড়ির কাজ আর স্কুলের পাশাপাশি এমব্রয়ডারি শেখা তাঁর চলতে থাকে। ঠাকুমা ভয় পেতেন নাতনির হাতে না সূচ বিঁধে যায়! কিন্তু বুদ্ধিমতি রুমা তাঁর ভালোলাগার কাজ থেকে সরতেন না। এমন চলতে চলতে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, উচ্চ বিদ্যালয় ছিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। আর তারপরেই অবধারিত ভাবে বাড়ি থেকে দেখা পাত্রের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বয়স তখন মাত্র সতেরো। এরপর প্রথম সন্তান জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রুমা হারান তাকে। এই ঘটনা তাঁর জীবন বদলে দেয়।
সন্তান শোক, হোক না সে ৪৮ ঘণ্টার, তাকে ভোলাতে তিনি ছোট থেকে শেখা এমব্রয়ডারির আশ্রয় নেন। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে একপ্রকার বিরোধিতা করেই গ্রামের আরও দশজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৬ সালে ব্যাগ, কুশন কভার তৈরি করতে থাকেন। অপূর্ব রাজস্থানী কারিগরির সেই সব ব্যাগ বানাতে সেবার তাদের দশজনের প্রত্যেকে একশো করে টাকা দিয়ে একটা পুরোনো সেলাই মেশিন কেনেন। শুরু হয় নতুন যাত্রার।

ব্যাগ তো বানালেন কিন্তু বিক্রি করবেন কাকে? ঠিক এই সময়ে তিনি বারমেরের গ্রামীণ বিকাশ এবং চেতনা সংস্থানের খবর পান। সেখানকার ডাইরেক্টর বিক্রম সিংয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। নিজেদের কাজ তাঁকে দেখান। বিক্রমজি তঁদের অনেকটা অর্ডার দেন এই বলে যে তিন দিনের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করে আনতে হবে। কিন্তু তাঁকে আশ্চর্য করে তাঁরা এক রাতের মধ্যে সমস্ত কাজ করে জমা দেন। রুমা দেবী ও তাঁর দলের হাতে আস্তে আস্তে পরিশ্রমের মূল্য আসতে শুরু করে।
২০১০ সালে তিনি এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। উৎসাহিত তাঁরা সেই সময় দিল্লির রফি মার্গে প্রথম নিজেদের হাতে তৈরি জিনিসের প্রদর্শনী করেন। সেই প্রথম রুমার বারমেরের বাইরে যাওয়া। সেবার দশ থেকে এগারো হাজার টাকার বিক্রি তাঁদের এত উৎসাহিত করে যে, পরের বছর তাঁরা আবার ওই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। অপূর্ব সেই সব কারুকাজ সর্বমোট এগারো লাখ টাকায় বিক্রি হয়ে যায়। দিল্লির মানুষজনের উৎসাহ সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁরা। এই সময় তাঁর স্বাভাবিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রুমা নিজের গ্রাম বারমের আর আশেপাশের গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত করতে শুরু করেন আরও বেশি কাজ ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে।
আরও পড়ুন:

তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-২: তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার

ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু

বাইরে দূরেঃ দ্রোণস্থলীর দেবতা টপকেশ্বর মহাদেব

রাস্তা খুব সহজ ছিল না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু তিনি ছাড়বার পাত্রী নন, যে বিশেষ কারিগরি রাজস্থানের ওই সব অঞ্চলের স্বাভাবিক শিল্প তাকে তিনি নিজের জীবনের এবং আরও অনেক মহিলার জীবনের আশার আলো হিসেবে দেখাতে প্রথম থেকেই তৎপর ছিলেন। তাঁর সেই তৎপরতা অন্য অনেক মহিলাকে তাদের সংস্থার সঙ্গে যুক্ত করায়। শুরু হয় ব্যাগ, কুশন কভার, বেড কভারের পাশাপাশি শাড়ি, জামাকাপড়, ওড়নার ওপর কাজ।
ফ্যাশন শো! ফ্যাশন শো বলতে রুমা বুঝতেন স্বল্পবাসের নারী পুরুষদের স্টেজে উঠে যাতায়াত। কিন্তু ২০১৬ সালে তাঁর সেই ধারণা বদলে যায়। সাহস আর সততাকে সম্বল করে তিনি রাজস্থান হেরিটেজ উইকে ফর্ম ভরে দেন। বাকিটা ইতিহাস। তাঁদের কাজ দেখে উপস্থিত বিখ্যাত মানুষজন থেকে ডিজাইনাররা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে অভিবাদন জানান। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তদশ অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সে প্যানেলিস্ট হিসেবে যোগদান। খলিজ টাইমস দুবাই থেকে তাঁর ছবি, ২০১৮-তে ইন্ডিয়া টুডের অ্যানিভারসারি এডিশনে তাঁর ছবি, ২০১৯ সালে টিএফআই ডিজাইনার অব দ্য ইয়ার সম্মান, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধান ডিজাইনার, জয়পুরের মহাত্মা জ্যোতি রাও ফুলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট ও টেক্সটাইলে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন, শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছ থেকে শিল্প অভিমানী অ্যাওয়ার্ড, নেদারল্যান্ডস থেকে সম্মান, ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পাওয়া নারী শক্তি সম্মান সবই তাঁর ঝুলিতে আছে।

কিন্তু ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তিনি নিজের মুখের হাসি কখনও ম্লান হতে দেননি। একলা চলো রে নীতি তিনি জানেন না, ভারতবর্ষের সব মহিলার স্বনির্ভরতার স্বপ্ন তাঁর চোখে। ৩৪ বছরের জীবনে তিনি তেত্রিশ হাজারেরও বেশি মহিলার জীবন বদলে দিয়েছেন। তাই তো তিনি সত্যিকারের দশভুজা।

Skip to content