পিশুটপের পথে।
বাইরে কনকনে ঠান্ডা। গতকাল জম্মু থেকে পহেলগাঁও দীর্ঘ যাত্রার পর একটু দোলাচলে ছিলাম, আজ আদৌ রওনা দিতে পারব কি না! ঘুম ভাঙার পর মনে হল— পারব, নিশ্চয়ই পারব। ভোরের আবছা আলোয় গাড়িতে রওনা দিলাম চন্দন বাড়ি। পহেলগাঁও ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। সাধারণ পর্যটক পহেলগাঁওয়ে এলে আশপাশে বেড়াতে গিয়ে চন্দনবাড়ি যায়। আর আমাদের হাঁটা শুরু হবে সেই চন্দনবাড়ি থেকে। পথে ড্রাইভার দূর থেকে ছবির মতো সুন্দর বেতাব ভ্যালি দেখাল। এ পথে অনেক আখরোট গাছ। আমাদের মন অবশ্য অনেক দূরের পথে। চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল পাহাড়ের বাঁকে। সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটবড় অনেক গাড়ি। বুঝতে পারলাম, জওয়ানদের প্রহরার মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছি। এক এক করে পরীক্ষার পর ছাড়া হবে গাড়িগুলো। জঙ্গিহানার ভয়ে এমন কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা।
পথে যেতে যেতে।
অবশেষে পহেলগাঁও থেকে ১৬ কিমি দূরে চন্দনবাড়ি পৌঁছলাম। সেখানে তখন হই হই রব। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকের দল বিশাল বিশাল ভাণ্ডারার ব্যবস্থা করেছে। নানাবিধ সুস্বাদু ভোজনের ব্যবস্থা। আর সঙ্গে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবকদের চকোলেট-সহ রাজকীয় অভ্যর্থনা। নিজেদের বরপক্ষ বলে বোধ হচ্ছিল। তাঁরা সমস্ত যাত্রীকে মুঠো ভরে চকোলেটও দিচ্ছিলেন। পথে জল কষ্ট হলে তাঁদের মুঠো ভরে দেওয়া চকোলেট সাময়িক প্রশান্তি দেবে। চেকপোস্টে পরিচয়পত্র দেখানোর পর এগিয়ে চলার পালা। আজকের গন্তব্য ১৪ কিমি দূরের শেষনাগ।
বরফঢাকা নদী
যাত্রাপথের ভয়ঙ্করতা কল্পনা করে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করি। কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে হল— ওই অবলা প্রাণীর হাতে এতটা চড়াই উতরাই পথে নিজেকে সমর্পণ করার চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো। পিঠের স্যাক দুটো পিট্টুর (মালবাহকের) হাতে দিয়ে হেঁটে চললাম। সঙ্গে রইল শুধু ক্যামেরা আর জলের বোতল। পথে হঠাৎ বাংলায় কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে দেখি এক জওয়ান। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করতে বলল, হাওড়ার বাগনানে বাড়ি, দূর দেশে বাঙালির দেখা পেয়ে তিনিও খুব খুশি হলেন। কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ল লিডার নদীর বুকে প্রকৃতির হাতে গড়া সুপ্রশস্ত তুষার সেতু। হিমবাহটি দেখে মনে হল— এই তবে সেই জায়গা, যেখানে ১৯৯৬ সালে যাত্রার সময় বরফ গলে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়েছিল। সে ঘটনা মনে করে শিউরে উঠলাম।
পথ দুর্গমতর।
অসংখ্য যাত্রী, নানা ভাষাভাষী ধনী গরীব নির্বিশেষে চলেছে এ পথে। কেউ চলেছে ঘোড়ায় চেপে, কেউ আবার ডান্ডিতে, মুখে ধ্বনি… জয় ভোলে কি। অতি বৃদ্ধা যেমন চলেছে অমৃতের সন্ধানে, তেমনি শিশুও বাবার হাত ধরে কচি পায়ে হেঁটে চলেছে। জয় ভোলে কি… বলে এগিয়ে চলেছে সকলে, কেবল যাত্রীরা নয়, মুসলমান ঘোড়ার মালিক, ডাণ্ডি কান্ডিওয়ালারাও বলছেন… ভোলে ভোলে। সে এক পরম আশ্চর্য ব্যাপার। ওই শব্দ বুঝি চলার শক্তি জোগাচ্ছে মনে!
শেষনাগ হ্রদ।
পৌঁছে গিয়েছি ১২,৫০০ ফুট উচ্চতার পিশুটপে। চারপাশে পাইন বাদাম আখরোট গাছে ঘেরা বনরাজি এতটা চড়াই পথের ক্লান্তি যেন ভুলিয়ে দিল। পিশুটপেও রয়েছে ভাণ্ডারা, যাত্রীদের সেবার জন্য অঢেল আয়োজন। কচুরি, হালুয়া, সিঙ্গাড়া, চপ, শোনা, গোলাপজাম, হরেক রকমের পোলাও, এমনকি চা, কফি, দুধ আরও কত কি! কোনওরকম অর্থের বিনিময়ে নয়, শুধু সেবার জন্য এমন আয়োজন স্বেচ্ছাসেবকদের।
সামনে চড়াই।
আরও কিছু দূর চলার পর পৌঁছলাম যোযিবল। বরফের রাজ্যে সেও এক অপূর্ব জায়গা। জওয়ানরা তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও যাত্রীদের জন্য লেবু-নুনজল নিয়ে অপেক্ষা করছেন। যাত্রীরা দীর্ঘ পথের ক্লান্তি দূর করছেন, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে। ভাণ্ডারাগুলো থেকে শোনা যাচ্ছে, হিন্দি গানের সুরে শিবের স্তুতি। কোথাও আবার যাত্রীদের বিনোদনের জন্য শিব-পার্বতী সেজে নাচও পরিবেশিত হচ্ছে।
শেষনাগ হ্রদ।
যাত্রীদের পাশাপাশি এ পথে চলেছে মালবাহী ঘোড়ার দল। কম্বল, রেশন, মায় গ্যাস সিলিন্ডার অবধি বয়ে নিয়ে চলেছে ঘোড়াগুলি। ওদের সহনশীলতা দেখলে অবাক হতে হয়। চলেছি নাগাকোটি হয়ে শেষনাগের দিকে। এ পথে শেষ তিন কিমি কিছুটা চড়াই। অবশেষে বেলা তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছলাম এক বিশাল স্বচ্ছ হ্রদের সামনে। পাহাড়ের প্রাচীর ঘেরা শান্ত স্বচ্ছ হ্রদ। প্রাচীরের মাথায় বরফের মুকুট, তাতে যেন কত কারুকাজ। সুপ্রশস্ত হিমবাহ, ঠিক যেন সাতটি ফণা প্রসারিত করে রয়েছে বাসুকী নাগ। শেষনাগ হিমবাহের সামনে রয়েছে শেষনাগ হ্রদ, লিডার নদীর উৎস। দেখে যেন আর চোখ ফেরাতে পারি না। পথের ক্লান্তি যেন এক লহমায় উধাও হয়ে গেছে। আজ এখানেই রাত্রিবাস।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com