শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

যশোর-কন্যা জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুরবাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিলেন নিতান্তই বালিকা বয়েসে। সে-বয়েসে পুতুল-খেলাই স্বাভাবিক, খেলাঘরের আনন্দ-জগৎ ছেড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন‌। বালিকা-বধূটি জোড়াসাঁকোয় নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। স্নেহ-ভালোবাসায় পরিবারের সকলে তাঁকে আপন করেও নিয়েছিলেন। শাশুড়িমাতা দাসীদের দিয়ে রূপটান মাখাতেন তাঁকে। সেসব মেখেটেখে যদি একটু গৌরবর্ণ হয়!

বাড়িতে পাড়াতুতো এক বধূ এসেছিল। বধূটিকে দেখে সারদাসুন্দরীর মনে‌ হয়েছিল, ‘কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখো দেখি!’ নিজের পুত্রবধূকে এমনই ‘হৃষ্টপুষ্ট’ দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে ‘সুন্দর চাঁপার কলির মতো হাত’ দিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীকে ভাত খাইয়ে দিতেন সারদাসুন্দরী।

জ্ঞানদানন্দিনী নিজের জীবনকথা কন্যা ইন্দিরাকে শুনিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী তা লিখে রেখেছিলেন। পরে ছাপা হয়েছে। সে লেখা থেকে জানা যায়, শ্বশুরবাড়িতে এসে তাঁর দুধের দাঁত পড়েছিল! শ্বশুরবাড়িতেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখাপড়া শেখা। তিনি বধূ হয়ে আসার আগেই ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখায় আছে, ‘মাতা ঠাকুরাণী তো কাজকর্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন।’ চাণক্যশ্লোক সারদাসুন্দরীর কণ্ঠস্থ ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর থেকে ন’ বছরের বড় মহর্যিদেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী দেবীর স্মৃতিচর্চা থেকে জানা যায়, বাড়িতে‌ এক বৈষ্ণবী আসতেন, তাঁর কাছে তাঁদের শৈশবের প্রথম পাঠ হয়েছিল। এমনকী রামায়ণ-পাঠও তাঁর কাছে। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার পর সৌদামিনী ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্ঞানদানন্দিনীর স্বামী তখন বিলেতে। বিলেত থেকে সেজভাই হেমেন্দ্রনাথকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর বউঠানকে ইংরেজি শেখাতে! ইংরেজি শেখা অবশ্য বেশি দূর এগোয়নি। সেজঠাকুরপোর কাছে জ্ঞানদানন্দিনীর বাংলা শিক্ষা অবশ্য ধীরে ধীরে এগিয়েছিল। মাইকেল মধুসূদনের বই আপাতভাবে যতই শক্ত হোক না কেন, জ্ঞানদানন্দিনীর পড়তে খুব ভালো লাগত। মনের আনন্দে পড়তেন। পড়ানোর জন্য ঘরে হেমেন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, বাইরে থেকে আসতেন অযোধ্যানাথ পাকড়াশী। ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। শুধুমাত্র শাড়ি পরে, অনাত্মীয় এক পুরুষের সামনে বসে পাঠ নেওয়া বেশ অসুবিধা‌জনক। তাই ঠাকুরবাড়িতে অন্তঃপুরিকাদের বেশবাসের সংস্কার হয়। শাড়ির পরিবর্তে আসে ওস্তাগরের তৈরি পেশোয়াজ জাতীয় পোশাক। হিরণ্ময়ী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, সে-পোশাকের পরিকল্পক ছিলেন স্বয়ং মহর্ষিদেব।‌

জ্ঞানদানন্দিনী বয়েসে যতই ছোট হোক না কেন, পরিবারের সকলের সঙ্গে খুব ভালো মিশে গিয়েছিলেন। কোনও কাজে তাঁর মুখে ‘না’ ছিল না। গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকতেই ভালোবাসতেন। জমিদারির আয় সে-সময় কমে গিয়েছিল। মহর্যিদেব বলে পাঠিয়েছিলেন, বউদের রাঁধতে শেখাও।

রান্নাঘরে নানা উৎপাত লেগেইছিল! বামুনঠাকুররা নিত্যি চুরি করত। বাড়ির সরকারমশায় ছিলেন কৈলাস মুখুজ্জে। তিনি চোর ধরার জন্য এক মতলব বের করলেন। বামালসহ চোর ধরার মতলবে রান্নাঘরে বসে প্রায়শই আহার করতেন। বামুনঠাকুররাও কম যায় না। তিনি এলেই তারা ফন্দি এঁটে কাঁচা কয়লা দিত উনুনে। একটাই উদ্দেশ্য, কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় যেন সরকারমশায় দেখতে না পান!

এসব করেও কিছু হয়নি।একদিন সরকারমশায় ‘ক্যাঁক’ করে এক চোরকে চেপে ধরে ফেলেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বাড়ির বধূমাতাদের দিয়ে রান্নাবান্নার করানোর কথা ভাবলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। পৌষপার্বণে ঠাকুরবাড়িতে রাশিকৃত পিঠে তৈরি হত। সে-কাজে মেয়ে-বউদের ডাক পড়ত। জ্ঞানদানন্দিনীও হাত লাগাতেন। মহানন্দে পিঠে তৈরি করতেন।

মহিলাদের বেশবাস নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীর ভাবনার অন্ত ছিল না। যে পোশাক পরে অনাত্মীয় পুরুষের সামনে পড়তে বসতেন, সে-পোশাক তাঁর কাছে কখনওই জুতসই মনে হয়নি। পোশাক নিয়ে মনের কোণে ভাবনা রয়েই গিয়েছিল। শুধু শাড়িটুকু যে যথেষ্ট নয়, তা বারবারই মনে হয়েছে জ্ঞানদানন্দিনীর। অন্তঃপুরিকারা অন্তঃপুরে না হয় চিরাচরিত ভঙ্গিতে শাড়ি পরেই রইলেন, বাইরে যাওয়ার জন্য তাঁদেরই তো শোভন-সুন্দর দৃষ্টি-সুখকর বেশবাসের প্রয়োজন!

জ্ঞানদানন্দিনী : বেলা শেষে

তখনও মুম্বইয়ের সঙ্গে ট্রেন-যোগাযোগ চালু হয়নি।যেতে হত জাহাজে। জ্ঞানদানন্দিনীকে জাহাজে চড়িয়ে সত্যেন্দ্রনাথ কর্মস্থল মুম্বইতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুম্বইয়ে বসবাসকালে এই বেশবাস-সমস্যা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ঘরোয়া আটপৌরে ভঙ্গিতে শাড়ি পরে ইতিউতি যাওয়া, মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা দায় হয়ে পড়ে! মনের কোণে যে ভাবনা অনেকদিন ধরে ছিল, তা যেন ডালপালা মেলে ধরে। এই মুম্বই-বাসকালেই তাঁর বেশবাস-ভাবনা বাস্তব রূপ পায়। চিরাচরিত শাড়ি—এই চেনা পরিচ্ছেদটিই পরার ধরনধারণ পালটে যায়। সঙ্গে যুক্ত হয় পারসি পোশাকের আদলে ব্লাউজ। গুজরাটি মেয়েরা যে স্টাইলে শাড়ি পরে, সেই ধরনটিকে কিঞ্চিৎ বদলে কুচিয়ে শাড়ি জ্ঞানদানন্দিনী পরতে শুরু করেন। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ সমাজজীবনেও পড়ে। কালক্রমে এমনভাবে শাড়ি পরাই সার্বজনীন-রূপ পায়।

সব মেয়েরা এভাবে শাড়ি পরুক, জ্ঞানদানন্দিনী চেয়েছিলেন। তাই কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, পারসি ধরনের শাড়ি পরা তিনি শেখাতে আগ্রহী, একদম বিনামূল্যে। এ সংবাদ জানা যায়, ‌জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর লেখা ‘স্মৃতিসস্মুট’ থেকে। শেখানো হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়। প্রথম-শিক্ষার্থী হয়ে এসেছিলেন সৌদামিনী গুপ্ত। সৌদামিনী ছিলেন দ্বিতীয় ভারতীয় আই-সি-এস বিহারীলাল গুপ্তের পত্নী। ‌ বিহারীলাল ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে জোড়াসাঁকোয় অচেনা কেউ আসতে বোধহয় সাহস পায়নি। এসেছিলেন বন্ধুজনের পত্নী।

জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন স্বাধীনচেতা। নারী-প্রগতির বার্তাবহ। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিলেন। পর্দানশিন করে রাখেননি তাঁকে। জ্ঞানদানন্দিনী শিশু-সন্তানদের নিয়ে একা স্বামীর কর্মস্থলে, ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বাও। জ্ঞানদানন্দিনীর বিলেত-বাস সুখের হয়ে ওঠেনি। ঘটে যায় ঘোরতর বেদনাবহ এক ঘটনা। মারা যায় শিশুসন্তান কবীন্দ্র। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘চোবি’। সন্তান হারানোর তীব্র যন্ত্রণা, হাহাকার ওঠে মাতৃহৃদয়ে। বছর তিনেক ছিলেন বিলেতে। হঠাৎই সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল পরিবর্তিত হয়। ইংল্যান্ডের বাদলে সুরাট। সুরাটে অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনী যাননি।

ততদিনে পুত্র-কন্যা, সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা বড় হয়েছেন। তাঁদের লেখাপড়ার কথা ভেবে থেকে গিয়েছিলেন কলকাতায়।

সত্যেন্দ্রনাথের চিঠি : জ্ঞানদানন্দিনীকে

ঠাকুরবাড়ির পরিবেশটি প্রায় একক চেষ্টায় জ্ঞানদানন্দিনী পালটে দিয়েছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ- হিতেন্দ্রনাথ- বলেন্দ্রনাথ এঁরা তখন বয়েসে কিশোর। ‌‌তাঁরা ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হোক, তাঁদের জন্য একটি‌ পত্রিকার প্রয়োজন, এই সত্যটি প্রথম জ্ঞানদানন্দিনীই বুঝেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন বাড়তি গুরুত্ব। বয়েস কম, তারুণ্যে ভরপুর চব্বিশের যুবক তিনি। রবীন্দ্রনাথকে যোগ্য সহযোগী করে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রকাশ করেছিলেন ‘বালক’ পত্রিকা।

সারাক্ষণ নজর রাখতেন পরিবারের কার কোন্ শিল্পকর্মে দক্ষতা আছে! সম্ভাবনাময়দের উৎসাহিত করতেন। অবনীন্দ্রনাথকেও ছবি আঁকতে জ্ঞানদানন্দিনী‌ উৎসাহিত করেছিলেন। কীভাবে প্রিয়জনদের দিয়ে‌ তিনি লিখিয়ে নিতেন, তা আজ গল্পকথার মতো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে একবার বলেছিলেন একটি নাটক লেখার জন্য। বউঠানকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিয়েছিলেন, মাথায় কোনও প্লট নেই।

নাছোড়বান্দা জ্ঞানদানন্দিনী। নতুন নাটক তাঁর চাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে পুরে রেখেছিলেন একটি ঘরে। ঘরের বাইরে পাহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন। যতক্ষণ না নাটক লেখা হচ্ছে, ততক্ষণ মুক্তি নেই!

কী আর করা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিরুপায় হয়ে শেষে লিখতে বসেছিলেন। এক সময় লেখা হয়ে যায় ‘হিতে বিপরীত’ নাটকটি। জ্ঞানদানন্দিনী সেদিন জয়ের হাসি হেসেছিলেন।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content