শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


স্কারলেট ম্যাকাও

সে যা-ই হোক, সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে গিয়েছিল কখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেদিনের ঘুম খুব একটা গাঢ় ছিল না। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল বেশ তাড়াতাড়িই। আজ সারাদিন ঠিকভাবে চললে সন্ধের আগেই বেরিয়ে যেতে পারব জঙ্গল থেকে।

সকালে উঠে কিছু গ্রানোলা বার পেটে পুরে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। আর আজকের যাত্রাপথ তেমন বিপদসংকুল নয়। কাল রাতে তিন ঘণ্টা মতো বেশি হাঁটার ফলে আমরা ইতিমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে আছি। কাজেই তেমন তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আজকের রাস্তা বেশ একঘেয়ে। গাছগাছালির মধ্যে তেমন বৈচিত্র্যও লক্ষ করছি না। মাঝেমধ্যে আবিলো দু-একটা গাছের পাতা হাতে ঘষে গন্ধ শুঁকতে বলছে। তাই করতে গিয়ে কোনওটায় দারুচিনি বা কোনওটায় জিরের মতো গন্ধ পাচ্ছি।
এমন ভাবেই হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম ম্যাকাও পাখির উপত্যকায়। জঙ্গলের এই রাস্তায় আমাদের গন্তব্যে। ম্যাকাও সেই উপত্যকায় পৌঁছনোর আগে রাস্তাটা বেশ খাড়াই। অনেকটা পাহাড়ের মতো ওপরে উঠে গেছে। তাই হাঁটতে একটু অসুবিধাও হচ্ছিল। গত দু’দিনে পরিশ্রম তো আর কিছু কম হয়নি। বেশ খানিকটা ওঠার পরেই এদের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এত কর্কশ আর এত তীব্র আওয়াজ খুব কমই শোনা যায়। তবে শ্রুতিমধুর না হলেও পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে উপত্যকার গাছগাছালিতে তাদের রূপে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কখনও তারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে, কখনও গাছে এসে বসছে দল বেঁধে, কখনও নিজেদের মধ্যেই খুনসুটি করছে। তাদের চোখ ধাঁধানো রঙের বাহারে প্রকৃতি এখানে অপরূপা। যেন স্বর্গের নন্দনকানন। দেবদেবীরা যেন উজ্জ্বল বস্ত্রে সেজে আনন্দ বিলাসে মগ্ন সে উদ্যানে। এই জায়গা দেখে কারও বোঝার ক্ষমতা নেই আমাজানের ভয়াবহতা। এ যেন এই ধরণীর কোলেই, আমাদের চোখের সামনে দেখা দান্তে অলিঘিয়েরির ‘ডিভাইন কমেডি’। ইতালীয় কবি নরক দর্শনের পর যখন পুরগেটরি পর্বতের রাস্তা ধরে তাঁর প্রেমিকা বিয়াত্রিচের হাত ধরে স্বর্গের দিকে চলেছেন তখন তাঁর অভিজ্ঞতাও নিশ্চয় এমনই হয়েছিল।
আমরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখছি সেই রূপ। মাথার ওপরে গাছের ডালেও একটি দুটি করে ভিড় জমাচ্ছে ম্যাকাওয়ের দল। আমাজনের জঙ্গলের এই জংলি ম্যাকাওরা মূলত বলে স্কারলেট ম্যাকাও প্রজাতির। তাদের উজ্জ্বল রঙের জন্যই এই নাম। এদের প্রত্যেকের শরীরই উজ্জ্বল লাল রঙের পালকে ঢাকা। তার মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নীল বা আকাশি, আর মাঝে মাঝে একটু হলুদের ছোঁয়া। এরা প্রায় পঞ্চাশ থেকে একশো বছর পর্যন্ত বাঁচে। সেই বয়স শুনে ফ্রানজি বলল এরপর বাড়ি গিয়ে সে একখানি ম্যাকাও পাখিই পুষবে। কুকুর মারা যাওয়ার পরে তার খুব দুঃখ হয়েছিল। ম্যাকাও পুষলে আর সে সম্ভাবনা নেই। তো, তারা যা পারে করুক। আমার তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। কাজেই আমি সেই বন্য মাকাওদেরই দেখতে লাগলাম দু’চোখ ভরে। এদের ঠোঁট খুব শক্ত। এরা ঠোঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে পাহাড়ের শক্ত পাথরও ভেঙে ফেলতে পারে। ওইভাবে পাথরে গর্ত করেই তারা বাসা বানিয়ে থাকে। এদের শক্তির কথা শুনে ভাবলাম ভাগ্যিস এরা জাগুয়ারের মতো হিংস্র নয়। তাহলে আমাদের মাথার ঘিলু দিয়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণে চড়ুইভাতি শুরু করে দিত। আমরা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো দাঁড়িয়েছিলাম এখানে শুধু এই রূপ উপভোগ করার জন্য। তারপর আবিলো তাড়া দিল। তখন আবার আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।

পাহাড়ের গায়ে স্কারলেট ম্যাকাও এর বাসা

আমাদের গন্তব্য ম্যাকাও-এর এই উপত্যকাটি পেরিয়ে গিয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি (উঁচু উঁচু ঘাসের জঙ্গল) অতিক্রম করে বেনি নদীর তীর। এইখানে রাস্তা সুন্দর, যাকে বলে ট্রেইল। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হল আরও অনেক পর্যটকের সঙ্গে, যাদের অনেকেই এই বর্ষাতুর অরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন ভয়াবহতাকে দূরে রেখে। দু’একজন আবার আমাদেরই মতো; এখানে এসে পৌঁছেছেন আজ বা কাল। এখানেও ক্যাম্প করে থাকবেন দু’একদিন। মোটের ওপর বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে আমরা আবার সভ্য জগতের কাছাকাছি এসে পড়েছি।

আরও বেশ কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে। সেখান থেকে নৌকো করে সোজা রারেনবাক। আগের ওই হস্টেলেই থাকার কথা। সেখান থেকে ফাবিয়ানো ফ্রানজি ফিরে যাবে আর আমি চলে যাব জঙ্গলের অন্য প্রান্তরে।

ছবি: লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content