শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।

বহুদিন আগের কথা। প্রায় পঞ্চাশ বছর তো হবেই। আমার শ্বশুরমশাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তিনি বেডরুমে বসে আছেন। বেডরুমটি একেবারে ঠাকুরঘরের মতো। অনেক ঠাকুর দিয়ে চারদিক সাজানো। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সরস্বতী, সারদা মা, সিদ্ধিদাতা গণেশ, স্বামী বিবেকানন্দ আরও কত দেব-দেবীর ছবি চারদিকে। ধূপকাঠির ধোঁয়ায় ঘর ম ম করছে। সুরসম্রাজ্ঞী খোলা চুলে বুটি বুটি নকশা করা সাদা শাড়ি পরে বসেছিলেন। হাতে ছিল ওঁর তানপুরা। তখনই আমার মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ মা সরস্বতী বসে আছেন। সেই আমার প্রথম জীবন্ত সরস্বতী-দর্শন। আজ উনি চলে গেলেন! মনে হল, দেবী সরস্বতীই যেন ওঁর হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন তাঁর সুরলোকে। লতাজিকে নিয়ে এই মুহূর্তে অনেক কথাই আমার মনে পড়ছে। তখন আমার আশীর্বাদ হয়ে গিয়েছে। উনি আমার শ্বশুরমশাইকে বললেন, ‘দাদা, তোমার পুত্রবধূ কেমন হবে তা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে’। তারপর আমার শ্বশুরমশাই আমাকে একদিন ওঁর কাছে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে উনি আশীর্বাদ করলেন। এখানেই শেষ নয়, উনি ওঁর পা থেকে সোনার পায়েল খুলে আমার পায়ে হাত দিয়ে পরিয়ে দিলেন। আমি তো লজ্জায় মরি, ওই পায়েল পরানোর দৃশ্য আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। এ আমার কাছে বড় আশীর্বাদ। উনি সিদ্ধিদাতা গণেশের ভক্ত ছিলেন। ওঁর বাড়িতে গণেশ পুজো হত। আমি অনেকবার গিয়েছি।

মুম্বইয়ের খার জিমখানায় আমার বিয়ের রিসেপশন হয়েছিল। আমার শ্বশুরমশাই লতাজিকে বলেছিলেন, ‘তুমি ও আশা মৌসুমীকে সাজিয়েগুছিয়ে তৈরি করে রিসেপশনে নিয়ে আসবে। আমি তোমাদের দু’জনের ওপর দায়িত্ব দিচ্ছি।’ হেমন্তবাবুর অনুরোধ শিরোধার্য করে লতাজি ও আশাজি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরেই আমাকে নিয়ে রিসেপশনে পৌঁছে যান।

লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে বা ওঁদের পরিবার এত খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ওঁরা কখনও তা ভাষায় প্রকাশ করতেন না, আচরণেও বোঝা যেত না। আমার মেয়ে মেঘার তখন বছর তিনেক বয়স। সে সময় লতাজি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ‘শর্মিলী’ ছবিতে একটি গান ছিল, ‘মেঘা ছায়ে আধিরাত বৈরন বন গয়ে’—এই গানটি আমার মেয়ের কণ্ঠে শুনে বললেন, এ তো দারুণ গায়। তোমার মেয়েকে গান শেখাও, ও ভবিষ্যতে নামকরা গায়িকা হবে। উনি নিজেই সংগীতের একজন গুরুজিকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। মেঘা গান শিখতে শুরু করল। তারপর যা হয় আর কী, ও শেষ পর্যন্ত গানের ট্রেনিং শেষ করতে পারেনি। তাই মেঘারও আর গান গাওয়া হল না।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

লতাজি ও আমি দু’জনই আচার খেতে ভালোবাসতাম। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে অনেক গল্পও হতো। আমার এক বন্ধু থাকেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। তিনি সেখানকার একটি রেডিওতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেন। ওই বন্ধু একদিন আমাকে বললেন, তিনি লতাজিকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রোগ্রাম করতে চান, যেটি কানাডায় সম্প্রচারিত হবে। আমি বললাম, আর উনিও রাজি হয়ে গেলেন। সেই লতাজি আমার বন্ধুকে বলেছেন —’আমার ঘরের বউ বলেছে, আর আমি যাব না।’ দু’ ঘণ্টা সময় চাওয়া হয়েছিল আর উনি সেদিন ৫ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। এ আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না।
আমার প্রথম ছবি ‘অনুরাগ’। সেই ছবিতে উনি ‘সুনরি পবন পবন পুরবইয়া’ গানটি গেয়েছিলেন, এরকম একটি অসাধারণ গানে লিপ দিতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি। ‘মঞ্জিল’ ছবিতে ‘রিমঝিম গিরে সাওয়ান’ বিখ্যাত এই গানটিও উনি গেয়েছিলেন, আর আমি লিপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়া আরও অনেক ছবিতে আমার লিপে তিনি গান গেয়েছিলেন।

যাইহোক, মানুষ তো চিরদিন থাকে না, তাই উনিও চলে গেলেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। সংগীতের জন্য তাঁর যে অবদান তা চিরকাল মানুষের মনের মণিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি তাঁর গান দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন এবং ভারতীয় সংগীতকে তিনি বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন।

Skip to content