মঙ্গলবার ৪ মার্চ, ২০২৫


মহর্ষি-কন্যা শরৎকুমারী।

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুই শরৎকুমারীর নাম। একজন রবীন্দ্র-অগ্ৰজা, দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরীর নবম সন্তান, চতুর্থ কন্যা। দ্বিজেন্দ্রনাথের আগে অবশ্য এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছিল। স্বল্পায়ু সেই কন্যার নামকরণেরও সুযোগ মেলেনি। জন্মের পরে পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। সৌদামিনী, সুকুমারীর পর শরৎকুমারী। সুকুমারী অকালে মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। অল্প বয়সে সন্তান প্রসব, সম্ভবত প্রসবজনিত পীড়ায় এভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। চতুর্থ কন্যা শরৎকুমারীর জন্মের আগে সারদাসুন্দরী আটবার আঁতুড়ঘরে গিয়েছেন। শরৎকুমারী নবম সন্তান।
ঠাকুরবাড়ির শরৎকুমারীর কথা নানা কারণেই উচ্চারিত হয়। এই নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আরেক শরৎকুমারীর কথা মনে পড়ে যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু অক্ষয় চৌধুরীর পত্নী তিনি। ঠাকুরবাড়িতে ছিল তাঁর নিত্য-যাতায়াত। লাহোরে বাপের বাড়ি, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতেন ‘লাহোরিণী’। রবীন্দ্রনাথ এই শরৎকুমারীর বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। বইটির নাম ‘শুভবিবাহ’।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর সাতেকের বড় ছিলেন ঠাকুরবাড়ির শরৎকুমারী। যখন অগ্রজার বিয়ে হয়, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বছর পাঁচেকের বেশি নয়। বিয়ে হয়েছিল যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কে এই যদুনাথ? লতায় পাতায় তিনি ঠাকুরবাড়ির আত্মীয় ছিলেন। গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যোগমায়া দেবীর কন্যা কুমুদিনীর স্বামী নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তিনি। ঠাকুরবাড়িতে আগে থেকেই তাঁর যাতায়াত ছিল। বিয়ের পর শরৎকুমারী তাঁকে ‘যদু ও যদু’ বলে নাম ধরে ডেকে বকুনিও খেয়েছেন। যদুনাথ ঠাকুরবাড়িতেই থাকতেন। খুব যে তাঁকে সবাই স্বীকৃতি দিতেন, মান্যতা দিতেন, তা নয়। ঠাকুরপরিবারে যদুনাথকে ঠিক মেলানো যেত না। আচার-আচরণে, রুচিবোধে একেবারেই অন্যরকম ছিলেন তিনি। মাঝপথে স্কুল ছেড়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন পড়াশোনা তো অনেক হল, এবার ছবি আঁকায় মন দেবেন। এমন ভেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে আর্ট স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন। অচিরে সে স্কুলও ছেড়েছিলেন।

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বিবাহোত্তর জীবনে যদুনাথ ও শরৎকুমারীর ছ-টি সন্তান-সন্ততি। যদুনাথ তাদের লেখাপড়া শেখানো নিয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তিত ছিলেন না। শোনা যায়, তিনি মদ্যপান করতেন। হ্যাঁ, ঠাকুরবাড়িতে বসেই করতেন। এমন একজন বেমানান লোকের সঙ্গে কেন যে শরৎকুমারীর বিয়ে হয়েছিল, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই তাঁর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় অন্যান্য কন্যাদের বিবাহ-সংবাদ মুদ্রিত হলেও শরৎকুমারীর হয়নি। এই সংবাদ মহর্ষি-অনুমোদনক্রমেই মুদ্রিত হত। তাঁর অনাগ্রহেই হয়তো সংবাদটি ছাপা হয়নি। জামাতা যদুনাথের অনাচার-কদাচার মহর্ষিকে কতখানি বিব্রত করেছিল, তার একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে তাঁর চিঠিপত্রে। তিনি তখন হিমালয়ে। সেখানেও যদুনাথ সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। বার্তাটি ছিল যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। মনের ক্ষোভ-যন্ত্রণা জানিয়ে হিমালয় থেকে ভ্রাতুষ্পুত্র গণেন্দ্রনাথকে মহর্ষি চিঠিতে লিখেছিলেন,’আমার নিকটে বাটীর এই একটি মন্দ সংবাদ আসিয়াছে যে যদু কতকগুলাণ ছোঁড়া জুটাইয়া আমাদের বাটীতে মাতলামি করে।’
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৫: সরজমিনে

যদুনাথ ও শরৎকুমারীর সন্তান-সন্ততিরা কেমন হয়েছিল, তা সরলা দেবীর স্মৃতিচর্চায় ধরা আছে। তাঁর মনে হয়েছে, ‘সেকালের চারুপাঠের উপরে আর উঠেছিলেন কিনা সন্দেহ।’ যদুনাথের সবই খারাপ এমন নয়, ‘নবনাটক’-এ, ‘অলীকবাবু’তে তিনি ভালো অভিনয়ও করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঠাকুরবাড়িতে গুণবান-রূপবান মানুষজনের অভাব ছিল না। তাঁদের পাশে যদুনাথ যে মানানসই নন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শরৎকুমারী নিজেও হয়তো যদুনাথের ব্যাপারস্যাপার মেনে নিতে পারেননি। নিজেকে অন্যমনস্ক রাখার জন্য ভিন্নতর পথ বেছে নিয়েছিলেন। রূপচর্চায় ডুব দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। রন্ধনকর্মেও তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। রূপচর্চার যে ফিরিস্তি পাওয়া যায়, তা সত্যিই বাড়াবাড়ি রকমের। ইন্দিরা দেবীর মনে হয়েছিল ‘রূপসাধনায় একটি একনিষ্ঠ সাধিকা’ তিনি। ‘স্মৃতিসম্পুট’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে আছে তাঁর রূপচর্চার এক অভাবনীয় বর্ণনা।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৬: আকাশ এখনও মেঘলা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

অন্য কোনও দিকে শরৎকুমারীর নজর ছিল না। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ততা, কী করে সকলের চোখে আরও সুন্দরী হয়ে ওঠা যায়, চলত সেই চেষ্টা। এ বিষয়ে তাঁর তৎপরতা ছিল ক্লান্তিহীন। জোড়াসাঁকোয় বাড়ির ভেতরের একটা মহলের একতলায় স্নানাগার ছিল। সেই স্নানেগারে বড়সড় সাইজের একটা চৌবাচ্চাও ছিল। সেই স্নানেগারের প্রবেশপথের মুখে একটা বাঁধানো বেঞ্চে শরৎকুমারী বসে বসে প্রসাধন করতেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলত এই নিজেকে সাজিয়ে তোলা। ইন্দিরা তাঁর ‘সেজপিসিমা’ সম্পর্কে একটু কৌতুক করেই লিখেছেন, ‘তা যে প্রথমে যেত সেও দেখত আর যে শেষ স্নান করে বেরোত সেও দেখত —তখনো তিনি সেখানে বসে ঘষামাজা করতেন। তেল, বেসন, সরময়দা কতরকম যে তখনকার প্রসাধনদ্রব্য ছিল তার সেবনবিধি জানলে ও কাজে লাগালে হয়তো আমাদের আধুনিকাদের আর একটু রঙের জলুষ হত।’

নীলকমল মুখোপাধ্যায় ও‌ যদুনাথ মুখোপাধ্যায়।

ইন্দিরা শুধু এই তথ্যটুকুই দেননি, জানিয়েছেন, শরৎকুমারী সাঁতারও জানতেন। সেই সাঁতার তিনি শিখেছিলেন স্নানাগারের চৌবাচ্চায়। সহজেই অনুমেয়, স্নানাগারটি কত বড়ো, আর চৌবাচ্চাটিই বা কত বড়। ইন্দিরার লেখাতেই আছে শরৎকুমারীর সন্তরণ-শিক্ষার বিস্ময়-সংবাদ। তিনি লিখেছেন, ‘ওই চৌবাচ্চায় ভেসে ভেসে নাকি সেজপিসিমা সাঁতার শিখেছিলেন, এও শুনেছি।’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৩: নির্বাসিত অর্জুনের দাম্পত্যজীবনে নতুন সম্পর্কের বিচিত্র সংযোজন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

রন্ধনকর্মে রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের কন্যারা কেউ কেউ পটিয়সী ছিলেন। কবিপত্নী মৃণালিনীও ভালো রান্না করতেন। শরৎকুমারী রান্না নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। নতুন, নতুনতর ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। তাঁর এই রন্ধন-দক্ষতার কথাও আছে ইন্দিরা দেবীর লেখায়। ইন্দিরার লেখা থেকে জানা যায়, তিনি ‘পেঁয়াজের নির্গন্ধ পরমান্ন’-এর মতো বিস্ময়কর সব ব্যঞ্জন প্রস্তুত করতেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।

শরৎকুমারীর জীবনে প্রাপ্তির ভাঁড়ার ছিল শূন্য। সন্তান-সন্ততিদের মানুষ করতে পারেননি তিনি। স্বামীর মতিগতি, কাণ্ডকারখানা প্রায়শই তাঁকে অশ্রুসিক্ত করেছে। হয়তো গোপনেই চোখের জল বিসর্জন দিয়েছেন। মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্যই হয়তো সারাক্ষণ রূপচর্চা করতেন, রান্নাবান্না করতেন। এইভাবেই মহর্ষিদেবের কন্যা নিজের বেদনাদীর্ণ মনের ক্ষতস্থানে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে চেয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও বছর দশেক তিনি বেঁচেছিলেন। ততদিনে রূপচর্চায় ভাটা পড়েছে। সন্তান-সন্ততিরাও বড়ো হয়েছে। ফলে শরৎকুমারীর মনোবেদনা বেড়েছে বই কমেনি। এই দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা ছিল একটাই, পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে কখনো ভুল বোঝেননি। পিতৃদেব তাঁর সন্তান-সন্ততিদের বিবাহকালে যৌতুকও দিয়েছেন, সরকারি খরচেই হয়েছে তাঁদের বিয়ে-শাদি। মহর্ষি শরৎকুমারীকে দশ হাজার টাকা দিয়ে কলকাতার বেনেপুকুরে একটি বাড়িও কিনে দিয়েছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content