ফেয়ারব্যাঙ্কস।
এস্থার ডোম। এটা একটা পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গা, যেখান থেকে গোটা শহরটা দেখা যায়। তবে যতগুলো জায়গার কথা বলেছিলেন তার মধ্যে সবচাইতে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাইওনিয়ার পার্ক, যেখানে কিনা এই শহরের বহু বিখ্যাত লোকের বাড়ি ঘরগুলোকে তুলে নিয়ে এসে সংরক্ষণ করে রাখা আছে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও পরে গিয়ে দেখলাম যে সত্যিই তাই। লোকজনের বাড়িকে সমূলে তুলে নিয়ে এসে আবার স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে মাঠের ধারে ধারে। আর তার চারিপাশে লোকজন মেতে উঠেছে গ্রীষ্মের আনন্দে। কেউ কেউ গান করছে, কেউ রেস্তরাঁয় বসে বসে খাবার খাচ্ছে আবার কেউ কেউ নিছকই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে হরেক রকমের দোকান। যেন গ্রামের মাঠে মেলা বসেছে।
সেখানে গিয়ে একজনের থেকে শুনলাম যে এখানে গ্রীষ্ম অয়তান্ত বা সামার সল্সটাইসের দিন বিরাট বড় জমায়েত হয়। গ্রীষ্ম অয়তান্ত হলো জুন মাসের ২০ বা ২১ তারিখ যেদিন কিনা দিনের পরিমাণ সবচাইতে বেশি থাকে বা বলা ভালো যে সুয্যিমামা বেশিক্ষণ আকাশে থাকেন। তার পরের দিন থেকেই ধীরে ধীরে দিন ছোট হতে থাকে। ছোট হতে হতে শীত কালে আর সূর্যের দেখাই পাওয়া যায় না। পুরোটাই তখন রাত। এমন হতে হতে শীত অয়তান্ত অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের ২০ বা ২১ তারিখ দিন সবচেয়ে ছোট হয়। সেদিন সুয্যিমামার সবথেকে কম সময়ের জন্য আকাশে থাকেন। আবার তারপরে যাত্রা শুরু হয় বড় দিনের উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৭: আলাস্কায় লোকে বিমানের পাশে গাড়িও দাঁড় করিয়ে রাখে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল
তো এই পাইওনিয়ার পার্ক সহ ডিনের সুপারিশ করা সমস্ত কটা জায়গাই ঘুরে দেখলাম আমি এক এক করে। তারপরে আবার সেই চেনা নদীর ধারে একটা রেস্তরাঁয় বসে সারলাম মধ্যাহ্ন ভোজ। সুন্দর কাঠের পাটাতনের ওপর খোলা আকাশের তলায় বসার জায়গা করা রয়েছে। আমি বুঁদ হয়ে আছি গত পরশু থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছুর মধ্যে। চাকরি নিয়ে মনের মধ্যে তখন আশা আশঙ্কা, দুইয়েরই দোলাচল; ঠিক যেমন ভাবে নদীর ওপর দিয়ে সেই মুহূর্তে দুলতে দুলতে ভেসে চলেছে ছোট্ট বৈঠা-টানা নৌকোটা। আমি সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি যত কখন না সেটা একদম দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। আবার কবে এসব এখানে নাকি এখানেই এসে থাকতে পারবো পাকাপাকি ভাবে? কে জানে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী
তবে এ বারের মতো ফিরে যাওয়ার পালা। চেনা নদীর উপর দিয়ে ঠিক তখনই উড়ে গেল একটা সী-প্লেন অর্থাৎ আকাশে এবং জলে দু জায়গাতেই চলতে পারে এমনই একটা ছোট মতো বিমান। যেন জানান দিয়ে গেলো আমার ফেরার সময় এসে গেছে। আর কিছুক্ষণ বসে আমি উঠে পড়লাম। এগোলাম বিমান বন্দরের দিকে। বিমান বন্দরে আমার ওই সহকর্মীও এলেন তাঁর নিজের গাড়িটা মানে যেটা আমি ব্যবহার করছিলাম সেটা ফেরত নিতে। আমি আবার করে তাঁকে জানালাম আমার এখানে আসার তীব্র ইচ্ছার কথা, অবশ্যই একটু পোশাকি ভঙ্গিমায়। তিনিও আমাকে প্রত্যুত্তরে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেলেন। নিরাপত্তা জনিত সবরকম কাজকর্ম সেরে আমি বিমানে উঠে বসলাম। রওনা দিলাম শিকাগোর উদ্যেশ্যে। ফিরে চললাম আমার চেনা পৃথিবীর উদ্যেশ্যে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’
মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী
বিমান উড়তেই যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি। যেন স্থান-কালের একটা বিস্ময়কর জায়গা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুত, কি বিস্ময়কর, তাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সত্যিই স্থান-কালের এক অদ্ভুত জায়গায় এই ফেয়ারব্যাঙ্কস। প্রাগৈতিহাসিক থেকে অত্যাধুনিক, অন্ধকার থেকে আলো, শীত থেকে গ্রীষ্ম সবটাই যেন চরমভাবাপন্ন। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া স্টিফেন হকিংয়ের বইটার কথা, ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বা ‘সংক্ষিপ্ত কালের ইতিবৃত্ত’।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর
গতকাল যেন সত্যিই একটা কৃষ্ণ গহ্বর ভেদ করে একটা অন্য ব্রহ্মাণ্ডে চলে এসেছিলাম যেখানে দিন-রাত-শীত-গ্রীষ্ম-আলো-অন্ধকার সবকিছুর হিসেব আলাদা। আমি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি এই চাকরিটা পেয়ে গিয়েছি। পাকাপাকি ভাবে এসে পৌঁছেছি ফেয়ারব্যাংকসে। ধীরে ধীরে চিনে নিচ্ছি চেনা নদীর ধারে অচেনা এই শহর বা বলা ভালো এই ছোট্ট গ্রাম টাকে। আর রূপকের ভাষায় তাকে চিনিয়ে দিচ্ছেন আমার কল্পনার ঈশ্বর, আমার প্রাণের ঠাকুর।…
‘আমাদের এই গাঁয়ের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার না তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে
আমাদের সেই তাহার নাম টি রঞ্জনা…’
—চলবে।
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার না তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে
আমাদের সেই তাহার নাম টি রঞ্জনা…’
—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।