মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
উপভুক্তধন সোমিলককে দেখে এবং তাঁর পরিচয় পেয়ে একেবারে উঠে এসে অভ্যর্থনা করে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। উপভুক্তধন তাঁকে যথেষ্ট সমাদর করে অনেক ভোজ্যদ্রব্য দিলেন। রাত্রে বিশ্রামের জন্য কিছু বস্ত্র এবং মনোরম একটা বিছানাও দিলেন। সোমিলক সেই ভব্যশয্যায় বেশ আরামে নিদ্রা গেল। স্বপ্নে আবার সে ওই দু’জন পুরুষকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনল। প্রথমজন বললেন, ওহে কর্তা, এ তো সোমিলককে স্বাগত জানাতে গিয়ে অনেক খরচাপাতি করে ফেললো। এখন বলো এই খরচা উঠবে কীভাবে? এ তো আপ্যায়নের সব কিছুই মহাজনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। নিজের বলে তো কিছুই নেই এর।
অপর পুরুষ বললেন, ওহে কর্ম! আমার কর্তব্য এইটুকুই ছিল। এর পর কি হবে সেটা তো তোমার অধীনে। পরদিন সকালে এক রাজপুরুষ এসে উপস্থিত হল উপভুক্তধনের বাড়িতে। জানা গেলো যে রাজামশাই উপভুক্তধনের কোনও কাজে অতি প্রসন্ন হওয়ায় সেই রাজপুরুষের হাতে অনেক টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন। সেই রাজপুরুষ রাজার পাঠানো সবটুকুই উপভুক্তধনের হাতে সমর্পণ করে দিল।
এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে সোমিলক চিন্তা করল যে, বরং সঞ্চয়হীন উপভুক্তধনের মতন হওয়াই ভালো, ওই কদর্য গুপ্তধন হওয়ার কোনও মানেই হয় না। সে কেবল ধন সঞ্চয় করে, ভোগ করে না। শুধু সঞ্চয় করলে সে ধন যদি কোনও কাজেই না লাগে তবে সে সম্পদ থাকা বা না-থাকা দু’ই সমান। বরং সম্পদ ভোগ করাই শ্রেয়। ভোগের অতিরিক্ত অর্থ থাকা আর না থাকা একই ব্যাপার। ফলে অতিরিক্ত সম্পদ থাকার অপেক্ষায় উপভুক্ত ধনের মতো যেটুকু ভোগ করার ক্ষমতা সেইটুকু সম্পদ থাকাই শ্রেয়। শাস্ত্রেও বলে, বেদ পাঠের ফল হল অগ্নিহোত্র যাগ করবার অধিকার পাওয়া। শাস্ত্রপাঠের ফল হল বিনীত ও শুদ্ধস্বভাবযুক্ত হওয়া। সুগৃহিণীর ফল হল সংযত যৌনজীবন এবং পুত্রলাভ, তেমনই সম্পদ থাকার ফল হল দান এবং ভোগ। দান এবং ভোগ না করতে পারলে সে সম্পদ থাকার কোনও মানেই হয় না। তাই সোমিলক বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলেন যে তাকে যেন তিনি উপভুক্তধনের মতো এমন একজন ধনী মানুষ বানিয়ে দেন যে সম্পদ ভোগ এবং দানের কাজে লাগে। গুপ্তধন হয়ে কেবল সম্পদ সঞ্চয় করবার কোনও মানেই হয় না।
পঞ্চম কাহিনি সমাপ্ত
কাহিনি শেষ করে কচ্ছপ মন্থরক হিরণ্যককে বলল, এই জন্যই আমি বলছিলাম ভোগ বা দান ছাড়া ওই অর্থ থাকা আর না থাকা সমান। তাই ওহে ভদ্র হিরণ্যক! ওই ধন নিয়ে আর মন খারাপ করবেন না। ধনসম্পদ থাকলেও সে সম্পদ যদি ভোগ না করা হয় তবে সে সম্পদ না থাকারই সমান। কথায় বলে, যদি ঘরে গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ধনের জন্য কেউ নিজেকে ধনী ভাবে তবে তো আমরাও সকলেই ধনী। কারণ সেই কৃপণব্যক্তি যে ধন ভোগ করে না, তার সঙ্গে একজন দরিদ্রলোকের পার্থক্যটা কোথায়? আসল কথাটা হল উপার্জিত ধন রক্ষা করার উপায় হল একমাত্র খরচ করা। যেমন একটা পুকুরের জল যদি ঠিক রাখতে হয় তাহলে সেই পুকুরে যাতে জল চলাচল করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে নতুন জল যদি সে পুকুরে ঢুকতে বা বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জল যদি বদ্ধ হয়ে যায় তাহলে সে জল পচে গিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাবে। ঠিক ধনসম্পদের ব্যাপারটাও তাই।
ধনসম্পদ শুধু বাড়িতে জমিয়ে রাখলে থাকবে না, তাকে ব্যয় করতে হবে তবেই উপার্জন হবে। ধন উপার্জন করে দান এবং ভোগই তাই করা উচিত। কখনই ধন সঞ্চয় করে রাখা উচিত নয়। না হলে মৌমাছিদের জমানো মধু যেমন অন্য লোকে হরণ করে নিয়ে যায়, তাদের নিজেদের কোনও কাজে লাগে না, ঠিক তেমনই যে কেবল ধন সঞ্চয় করে কিন্তু ভোগ করে না, তার ধনও কোনও কাজে লাগে না। তাই পণ্ডিতেরা বলেন, দান করা, ভোগ করা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া—ধনের গতি এই তিনটিই মাত্র। যে ধন দানও করে না আর ভোগও করে না তার তৃতীয় গতিটাই অবশিষ্ট থাকে। এই জন্যই বিবেকী পুরুষেরও উচিত সঞ্চয় করার জন্য কেবল ধনোপার্জনে সময় নষ্ট না করা। কারণ, সেই সঞ্চিত ধন কেবল তার দুঃখেরই কারণ হয়। সে ধন রোজগারও করতে হয় কষ্ট করে আর ব্যয় না করলে তা নষ্ট হয়ে গেলেও মনে কষ্টই হয়। কারণ পণ্ডিতেরা বলেন, যে মূর্খ লোকে ধনসম্পদ বা ভোগ্যবস্তুতে সুখের আশা করে সে গ্রীষ্মকালের উষ্ণতায় তপ্ত হয়ে শীতলতার খোঁজে অগ্নিকেই পান করে শুধু। সাপ তো কেবল বায়ুভুক্, বিশেষ কিছুই সে খায় না, তাও সে দুর্বল নয়; হাতি তো জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শুকনো ঘাসপাতা খায়, তবুও তাদের মতন বলহীন এ-দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই।
ঋষি-মুনিরাও জীবন ধারণের জন্য কন্দমূল আর ফলই খেয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সুতরাং এসবই প্রমাণ করে যে মনের শান্তিই হল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ধন-সম্পদ আসলে কিছুই নয়। সন্তোষরূপী অমৃত পান করে যে পুরুষ জীবনে তৃপ্ত হয়েছেন, সেই শান্ত হৃদয়ের পুরুষের মনে যে সুখ থাকে তা ধনোপার্জনের নেশায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো মানুষের মধ্যে কোথায়? অমৃততুল্য সন্তোষকে যে ব্যক্তি পান করেন তিনি জীবনে পরম আনন্দ লাভ করেন। কিন্তু যে ব্যক্তির মনে সন্তোষ নেই, তার জীবনে কোনও না কোনও দুঃখের কারণ আসতেই থাকে। মন যদি বশে থাকে তাহলে সকল ইন্দ্রিয়ই বশে থাকবে। যেমন মেঘ যখন সূর্যকে ঢেকে ফেলে তখন সূর্যের কিরণও মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। শান্ত স্বভাবযুক্ত মহর্ষিরা বলেন, মনের কামনা অর্থাৎ কোনও কিছু পাওয়ার ইচ্ছাকে উত্পন্ন হতে না দিলেই মন সুস্থ থাকে। যেমন ভাবে অগ্নির তাপে পিপাসা মেটে না, তেমনই ভাবে ধনসম্পদ লাভের ইচ্ছার কোনও শেষ নেই, যতো সম্পদ থাকবে ততোই আরও পেতে ইচ্ছা জাগবে। এইটাই মনুষ্য স্বভাব। মানুষ ধনলাভের জন্য শ্রদ্ধেয় মানুষকে যেমন নিন্দা করে, তেমনই নিন্দনীয় মানুষকেও স্তুতি করতে পিছপা হয় না। তাই ধনসম্পদ এমনই এক খারপ জিনিষ যে তার জন্য মানুষ সব কিছুই করতে পারে। সত্যি কথা বলতে যে ব্যক্তি ধর্মকার্য করবে বলে ধনসম্পদ উপার্জন করতে চায় বা জোগার করতে চায় তার সেই চিন্তাটাও যে খুব একটা মঙ্গলকারিণী সেটাও ভাববার কোনও কারণ নেই। কারণ, কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে তারপর ধোয়ার থেকে ময়লাকে দূরে সরিয়ে রেখে স্বচ্ছ-কাপড়টা ধুলেই পরিষ্কার বেশি হয়—
ধর্মার্থং যস্য বিত্তেহা তস্যাপি ন শুভাবহা।
প্রক্ষালনাদ্ধি পঙ্কস্য দূরাদস্পর্শনং বরম্।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৬২)
এ-সংসারে মানুষের জন্য দানের সমান ধননিধি আর দ্বিতীয়টি নেই। লোভের সমান কোনো শত্রু যেমন নেই, তেমনই সদাচারের সমান গহনাও দ্বিতীয়টি নেই। ঠিক তেমনই মনের সন্তোষের সমান উত্কৃষ্ট ধনও আর দ্বিতীয়টি নেই। আসলে দারিদ্রের অন্তিমরূপ হল যখন মানুষের সম্মনরূপী ধনটি কম পড়ে যায়। অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষের কাছে সম্মান আছে ততক্ষণ সে ধনী। মানের থেকে বড় সম্পদ এই দুনিয়ায় নেই। না হলে দেবাদিদেব মহাদেবকেই দেখুন। সামান্য একটা বুড়ো বলদ মাত্র তার সম্পদ। সেই নিয়েই সে কেমন দিব্যি মনের সুখে রয়েছে। শ্রেষ্ঠ পুরুষের যদি পতনও হয় তার পতন কন্দুক বা বলের মতো হয়। বল যেমন একবার মাটিতে পড়েই আবার লাফিয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ পুরুষও তেমনই। একবার অন্যায় করলেও সে নিজেকে সংশোধন করে নেয়, কিন্তু মূর্খলোক মাটির ঢেলার মতো। একবার মাটিতে এসে পড়লে আর সে উঠতে পারে না—নিজেকে সে সংশোধন করতে পারে না। তাই ওহে ভদ্র হিরণ্যক! তুমি একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তোমার কিন্তু মন খারপ করা উচিত নয়। মনে সন্তোষ আনো। —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।