মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ।

১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে লিওনার্ড ভার্জিনিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তখন মাস ছয়েক তিনি ভার্জিনিয়ার বোনের বাড়ির ওপর তলায় থাকতেন। প্রেমের তীব্র আকর্ষণে সে সময় তিনি ভার্জিনিয়াকে ছেড়ে শ্রীলঙ্কায় চাকরিতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছিলেন না। ছুটি চাইলেন চাকরি স্থল থেকে। ছুটি নামঞ্জুর হল। ভালো চাকরিটি ছেড়ে দিলেন। ওদিকে ভার্জিনিয়ার মনে তোলপাড় বিয়ের প্রস্তাবে। তিনি চিঠি লিখলেন, “আমার দুরন্ত সব চাওয়া। ভালোবাসা, শিশু, কাজ, অ্যাডভেঞ্চার…সব, সব চাই। কিন্তু আমি তো কোনও আকর্ষণ অনুভব করি না তোমার প্রতি। তুমি সামনে এলে আমার অনুভূতিগুলো প্রস্তরিভুত হয়ে ওঠে। কঠিন হয়ে যায় শরীর। আবার তোমার প্রেম, আমার জন্য উৎকণ্ঠা আমায় অভিভূত করে। আমার সব দিয়ে যদি তোমায় গ্রহণ করতে না পারি তবে সে বিয়ে কেন করব?”
এ চিঠিতে হতাশ হলেন না লিওনার্ড। অপেক্ষা করলেন। কারণ তার মনে তখন ভার্জিনিয়ার প্রতি দুরন্ত প্রেম ও আকর্ষণ। ভার্জিনিয়ার মনে বিবাহিত এবং অবিবাহিত দুই জীবন নিয়েই ছিল নানা বিরক্তিকর ও হতাশ ধারণা। বন্ধুর সঙ্গে চিঠিতে এ বিষয়ে অনেক আলোচনার পর তার মনে হলো তিনি এমন এক পুরুষের সাহচর্য চান, যার মাঝে এক দুর্দান্ত শক্তি ও বুদ্ধির চমৎকার মেলবন্ধন থাকবে, যে তাকে প্রবলভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অফুরান জীবনীশক্তি দিয়ে। অবশেষে,প্রস্তাব আসার পাঁচ মাস বাদে লিওনার্ড এর মাঝে সেই ভালোবাসার পুরুষকে আবিষ্কার করলেন তিনি।মত দিলেন। জীবনীকার কুয়েন্টিন বেল লিখলেন, ভার্জিনিয়ার এটি “the wisest decision of her life.”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৯: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /১

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

বিয়ে করলেন ভালোবেসে, কিন্তু বিবাহিত যৌন জীবনের প্রতি ভার্জিনিয়ার ছিল এক তীব্র অনীহা। হয়তো শৈশবের স্মৃতি এক ট্রমা হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। বৈপরীত্যে ভরা তার মানসিকতা। শিশু পছন্দ করতেন, মাতৃত্ব পছন্দ করতেন, কিন্তু নিজে মা হতে ভয় পেতেন। ডাক্তার দেখালে তিনিও উপদেশ দেন মা না হতে। ভার্জিনিয়া যখনই তার বিষণ্ণতার কারণ বিশ্লেষণ করতেন তখনই তার সন্তানহীনতার কথা বলতেন। শেষ পর্যন্ত লিওনার্ড এর সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন পিতপুত্রীর স্নেহের সম্পর্কে পর্যবসিত হয়ে উঠেছিল। আর তার লেখাগুলো হয়ে উঠেছিল তার সন্তানবত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের যে তীব্র অনীহা ও ভয়ের বীজ শৈশবে ভার্জিনিয়ার মনে বোনা হয়েছিল তার আরেকটি অস্বাভাবিক স্ফুরণ হল মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ। ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডের প্রতি তার আকর্ষণ প্রায় সমকামিতার পর্যায়ে পড়ে। এছাড়াও তিনি আকৃষ্ট ছিলেন ভিটা স্যাকভিল, ভায়োলেট ডিকিনসন, ম্যাজ ভনের প্রতি। লিওনার্ড ভার্জিনিয়া এবং ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডের সম্পর্কের মধ্যে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যর কথা বলেছেন। দু’জন যখন দূরে থাকতেন তখন একে অপরের প্রতি প্রচণ্ড বৈরীভাব পোষণ করতেন। ক্যাথেরিন খুব সন্দেহের চোখে দেখতেন বন্ধুকে। আবার ভার্জিনিয়া এবং ক্যাথেরিনের সাজ পোশাক, অভিমান, সবের ওপরই চটে থাকতেন। কিন্তু কোথাও একটা গভীর ভালোবাসা ছিল দু’জনের মধ্যে। যখন একসঙ্গে হতেন তখন খসে পড়তো সব মান অভিমান, রাগ, বৈরীভাব। অদ্ভুত আবেগে সহমর্মিতায় একে অপরকে জড়িয়ে থাকতেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

লিওনার্ড কিন্তু ভার্জিনিয়ার সবরকম অস্বাভাবিকতা তার বিবাহিত জীবনের যৌন উদাসীনতা, সন্তানধারনের অক্ষমতা এবং মেয়ে বন্ধুদের প্রতি আকর্ষণ, সবই সুন্দরভাবে মেনে নিয়েছেন। স্বেচ্ছায় নিজের কাজকর্ম স্থগিত রেখে ভার্জিনিয়ার মতো এক আত্মহত্যাপ্রবণ এবং সাময়িক উন্মাদনাপ্রবণ মেয়ের দেখভাল করতেন। কখনও অনুতাপ করেননি তাকে বিয়ে করেছেন বলে। ভার্জিনিয়ার প্রতিভাকে সযত্নে রক্ষা করেছেন, তার সুস্থ স্বাভাবিক বুদ্ধিকে লালন করেছেন। সদা সতর্ক থাকতেন ভার্জিনিয়ার ঘুম, খাওয়া, বেড়ানো সব যেন ঠিকমত চলে। কোনওরকম মানসিক ও শারীরিক শ্রম যেন না হয়। কারণ তবেই ভার্জিনিয়া ভালো থাকবেন। পরিবারের প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন লিওনার্ড।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এতসব করেও ভার্জিনিয়াকে মানসিক বিপর্যয়ের আক্রমন থেকে রক্ষা করতে পারেননি লিওনার্ড। পর্যায়ক্রমে আসতো এই বিপর্যয়। প্রথমে শারীরিক কষ্ট, মাথাযন্ত্রণা, পিঠে ব্যথা, ঘুম না হওয়া, মনঃসংযোগ না হওয়া, ভয়ানক উত্তেজনা…এসব হতো। এ সময় অনর্গল অসংলগ্ন কথা বলতেন, মনে মনে অদৃশ্য কারো কথা শুনতে পেতেন, চিৎকার করে উঠতেন। এ পর্যায়ের পরে আসতো প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ। কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগতেন। এরকম সময় বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। বিয়ের একবছর পরেই বেশ কিছু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টায় সে যাত্রা বেঁচে যান। ডাক্তাররা নিশ্চিত যে ভার্জিনিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন। লিওনার্ড মানতে রাজি নন।

তৃতীয়বার আত্মহত্যার চেস্টা করেন ১৯৪১ সালে। এ বারে আর বাঁচানো যায়নি তাকে। চরম অবসাদের মাঝে এক মানসিক বিপর্যয়ের পর্যায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাসেক্সের নদীতে। দিনটা ছিল মার্চের ২৮ তারিখ। সেদিন সকালে এক বেদনার্ত শেষ চিঠি লেখেন লিওনার্ডকে। তার অপরাধবোধ, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার অসহায়তা এবং ফলস্বরূপ লিওনার্ড-এর জীবন, কেরিয়ার নষ্ট হওয়া…এ সবই লিখলেন। তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন। “I can’t go on spoiling your life any longer. I don’t think two people could have been happier than we have been.”

তিন সপ্তাহ বাদে অন্য এক নদীতে ভেসে উঠেছিল ভার্জিনিয়ার দেহ।—চলবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content