বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


কবিতা গাড়ি থেকে নামে। সিদ্ধার্থ বলে, “এটা প্রিয়াদের বাড়ি,মা।” খুব অবাক হয় কবিতা। এ বাড়ি তো তার চেনা! অনেক কিছু বদলেছে ঠিকই, কিন্তু তার এতো চেনা বাড়িটা একেবারে অচেনা হয়ে যাবে কেমন করে! আগের মোড়টা ঘোরার পরেই তার মনে হয়েছিল, এ রাস্তা যেন তার চেনা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। পা তার সরে না। সিদ্ধার্থ বলে ওঠে, “কী হল মা, চলো….।” দৌড়ে আসে প্রিয়া। জড়িয়ে ধরে কবিতাকে। “এসো মা, কখন থেকে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।” এই সব কথাবার্তার মধ্যেই সুমিতা আর কমলেশ নামে তাদের গাড়ি থেকে।

সুমিতাকে দেখে আর একবার চমকায় কবিতা। “তুমি সুমিতা না?” জিজ্ঞেস করেই ফেলে। “হ্যাঁ কবিতা দি, আমি সুমিতা।” জড়িয়ে ধরে সুমিতা কবিতাকে। দু’ জনেরই দু’ চোখ ভরে জল। “চলো মা, ভেতরে চলো।” কবিতার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায় প্রিয়া। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কবিতা এগিয়ে যায়। সুমিতাই পরিচয় করিয়ে দেয় কমলেশের সঙ্গে। কবিতা যেন বুঝে উঠতে পারে না কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে।
প্রতিমুহূর্তে আরও ভীষণ একটা চমকের জন্য যেন অপেক্ষা করে থাকে। কবিতাকে নিয়ে প্রিয়া বাবার ঘরে ঢোকে। দেওয়ালে মায়ের ছবি টাঙানো। বাবার ছবিও একটা ছিল টেবিলের উপর। একটু আগেই প্রিয়া সরিয়ে দিয়েছে। ওর মনে হয়েছে, ছবি নয়, একেবারে সরাসরি দেখা হোক দু’জনের। অজন্তার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কবিতা। প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তোর মা?” “হ্যাঁ” উত্তর দেয় প্রিয়া।

কবিতার চোখ সারা ঘরে আরেকজনের ছবি খুঁজে ফেরে। কিন্তু না। কোত্থাও তার ছবি নেই। প্রিয়া, সিদ্ধার্থ, সুমিতা, কমলেশ নিজেদের মধ্যে কত কথা বলে চলে। কিছুই কানে পৌঁছোয় না তার। শেষে সুমিতার কথায় ঘোর কাটে। “এই প্রিয়া, দাদা কোথায়? দাদাকে ডাক। এতদিন পরে কবিতাদি আমাদের বাড়ি এল!”

“কী বলছে কী সুমিতা! এতদিন পরে এল…!” কবিতা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। এখুনি তো ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করবে! ওরা তো জানতে চাইবে আগেও সে এ বাড়িতে আসত কিনা! কী বলবে তখন? কিন্তু ওরা তো কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না! ওদের দেখে মনে হচ্ছে, ওরা যেন জানতই যে এ বাড়িতে কবিতা আগেও বহুবার এসেছে। হঠাৎ দরজার কাছে হই-চই শুনে সে দিকে তাকায় কবিতা।
আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৩৯: বিজয়া দশমী

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৪

প্রিয়া ওর বাবাকে হাত ধরে নিয়ে আসতে আসতে বলছে, “আরে এসো না, দেখই না, কে এসেছে।” থমকে দাঁড়ায় সুবিনয়। কবিতাও উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার ছেড়ে। কত… কতদিন পরে দুটো মানুষের দেখা! সেই দুটো মানুষ, যারা একে অন্যের থেকে শত যোজন দূরে থেকেও আজও একে অন্যের ভালোবাসার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। কেউ কোনও কথা বলতে পারে না। অপলকে তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে। ঝাপসা হয়ে যায় দৃষ্টি। বাকিদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। একটা পিন পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যাবে। সবাই দেখছে এক স্বর্গীয় ভালোবাসা। কথা বলল প্রিয়াই। “বাবা, চিনতে পারছো?” উত্তর দিতে পারে না সুবিনয়। এই মানুষটা যে তার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে মিশে আছে! তাকে ভুলেছে কবে, যে নতুন করে চিনতে হবে! মুখে বলে, “পারছি”।

সুবিনয় বা কবিতা দু’জনই বোঝে ছেলেমেয়েরা অনেকটাই জানে। কতটা জানে, বা কী করে জানল, তা তারা জানে না। সুমিতা বলল, “দাদা, অনেক কষ্ট পেয়েছ তোমরা দু’জনেই। এতদিন বুকে পাথর চাপা দিয়ে সব কর্তব্য করে গেছ। এবার অন্তত একটু শান্তি পাও।” সুবিনয় বুঝতে পারে না, সুমিতা কী বলতে চাইছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ওর দিকে। প্রিয়া বলে, “আমাদের যদি সুখী হওয়ার অধিকার থাকে, তোমাদের কেন নেই বাবা?” কবিতা বলে, “তা আর হয় না রে মা। এই বিকেলবেলা কি আর ভোরের আকাশকে ফিরিয়ে আনা যায়! যে দিন গেছে তা আর ফিরে আসার নয়।” “কেন নয় মা?” প্রতিবাদ করে ওঠে সিদ্ধার্থ।

“দু’জনেই এত কষ্ট পাচ্ছ!” “কষ্ট পেতে পেতে কষ্ট পাওয়াটাই যে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে বাবা” ম্লান কন্ঠে বলে সুবিনয়। “আর তাছাড়া সমাজ আছে, প্রতিবেশীরা আছে। তারা কী বলবে!”
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প: গৌরী এল দেখে যা লো /১

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

“রাখুন আপনার প্রতিবেশী।” রেগে ওঠে সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থকে এমন ভাবে মেজাজ হারাতে আগে কেউ দেখেনি। কবিতাও অবাক হয়। তার শান্ত ছেলেটা এত রেগে যেতে পারে, সে ভাবতে পারেনি। সিদ্ধার্থ আবার বলে ওঠে, “যখন প্রতিদিন আমার মদ্যপ বাবা আমার মাকে অপমান করত, মায়ের গায়ে হাত তুলত, তখন কী করেছে প্রতিবেশীরা? কী করেছে সমাজ? যখন সামান্য অর্থনৈতিক কারণে দু’জনের ভালোবাসাকে বলি দিতে হয়, তখন কী করেছে প্রতিবেশীরা? যে সমাজ দু’জন মানুষের ভালোবাসাকে গলা টিপে হত্যা করতে বাধ্য করে, সেই সমাজের কোনো অধিকার নেই সমালোচনা করার।”

এতগুলো কথা একটানা বলে হাঁফায় সিদ্ধার্থ। ভীষণ উত্তেজিত সে। প্রিয়া বলে, “যেখানে আমরা চাইছি, সেখানে সমাজ কী বলল, তাতে কী যায় আসে বাবা?” এতক্ষণ চুপ করেছিল কমলেশ। এবার আস্তে আস্তে বলল, “ওরা তো কিছু ভুল বলছে না দাদা। আমি সব শুনেছি। সুমিতার কাছ থেকে আগেই ওনার কথা শুনেছিলাম।” কবিতার দিকে তাকায় কমলেশ। কবিতার চোখ থেকে তখন অঝোর ধারায় জল ঝরছে। সুমিতা এতক্ষণ চুপ করেছিল।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

এ বার আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সুবিনয়ের দিকে। “আমি তো সব জানি দাদা। আমি তো সেই সময় তোমাদের দেখেছি। এত ভালোবাসা… এত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ! আমি তো সেসব জানি। চোখের সামনে দেখেছি তোমাকে কষ্ট পেতে। রাতের অন্ধকারে একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে গান গাইতে। আর তোমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। কোনো গানই শেষ করতে পারতে না। আমি তো দেখেছি সেসব। কেন তবে আজ ছেলেমেয়েদের কথায় রাজি হচ্ছে না তোমরা?”

” ঠিক আছে, তোমরা কথা বলো। আমরা অপেক্ষা করছি তোমাদের সিদ্ধান্ত শোনার জন্য।” কবিতার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে প্রিয়া। কমলেশ আর সুমিতা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সিদ্ধার্থ বলে, ” আপনারা কথা বলুন, অনেক বছরের অনেক কথা জমে আছে, আমরা অপেক্ষা করছি।” আস্তে আস্তে সবাই বেরিয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৪: অরাজকতার ফল ও একটি দুঃস্বপ্ন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ঘরে সুবিনয় আর কবিতা। কারো মুখে কথা নেই। শুধু বারেবারে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারটি চোখ। এতদিন মনে মনে দু’জন দু’জনাকে কত কথাই বলেছে। কত অভিমান… কত ভালোবাসা… কিন্তু এখন সামনাসামনি একটা কথাও সরছে না কারো মুখ থেকে। মন চাইছে আঁকড়ে ধরে এতদিনের সব যন্ত্রণাকে বাঁধভাঙা মুক্তি দিতে। কিন্তু পা দুটোকে কে যেন শক্ত করে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে রেখেছে। কিছুতেই এগোতে পারছে না। সুবিনয়ই একটা সময় এগিয়ে আসে। নিজের দু’হাতের মুঠোয় কবিতার একটা হাত তুলে নেয়। দুটো হাতের স্পর্শে আর দু’জনের চোখের জলে এত বছরের জমে থাকা কষ্ট, অভিমান, ভালোবাসা একটু একটু করে ঝরে পড়তে থাকে। ঘরের বাইরে তখন বাকিদের উদগ্রীব অপেক্ষা।—শেষ।
* শম্পা দত্ত সঞ্চালিকা ও আবৃত্তি শিল্পী।

Skip to content