বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


বেদের মায়া ও তন্ত্রের মহামায়া সমার্থক না হলেও ব্রহ্ম ও মহামায়া মূলত এক। ঈশ্বর ও প্রকৃতি শক্তি যেমন অভেদ। সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মই একমাত্র ছিল। শক্তিকে আশ্রয় করে সৃষ্টি শুরু হলে এই জীবজগৎ প্রকাশ করে তার মধ্যে চৈতন্য রূপে প্রকাশিত হতে থাকল। বেদ ও তন্ত্রের পার্থক্য এই যে, বেদ সিদ্ধান্ত শাস্ত্র আর তন্ত্র সাধন শাস্ত্র। বেদ প্রাচীন অপৌরুষেয় হলেও শক্তিপুজোর উল্লেখ রয়েছে। অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবী সুক্তের ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভৃনের কন্যা ব্রহ্ম বিদূষী বাক্। তিনি ব্রহ্ম উপলব্ধি করে বলেন, ‘আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যা দেবী ও বিশ্বেশ্বরী।’

ঋগ্বেদের অন্তর্গত রাত্রী সূক্তের দেবী ঋষি কুশিক। কেন উপনিষদে, দেব-অসুর সংগ্রামে দেবতারা বিজয় উল্লাসে অহংকার প্রকাশ করছিলেন, তখন দেবী হৈমবতী আগমন করেন ও বলেন ব্রহ্মশক্তির দ্বারায় দেবতার বিজয় হয়। (কেঃ উঃ ৩।১২-৪।১) শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকা দেবীকে রুদ্রের ভগ্নি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দুর্গাসূক্তমে “তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্। দূর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।”
আমি সেই বৈরোচিনী অর্থাৎ পরমাত্মা কর্তৃক দৃষ্ট অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তাপে শত্রু দহনকারিনী, কর্মফল দাত্রী দুর্গাদেবী শরণাগত হই। সে সুতারিণি, হে সংসার ত্রাণকারিণি দেবি, তোমাকে প্রণাম করি। শ্রীশ্রী চণ্ডী বেদমূলা। প্রথম চরিত্র ঋগ্বেদ স্বরূপা, মধ্যম চরিত্র যজুর্বেদ স্বরূপা ও উত্তর চরিত্র সামবেদ স্বরূপা। ছন্দ যথাক্রমে গায়ত্রী, উষ্ণিক ও অনুষ্ঠুপ। চণ্ডী ও গায়ত্রী উভয়েই প্রণব স্বরূপা। ঋক্ মন্ত্র দ্বারা পরমাত্মার স্তব, যজুঃ মন্ত্র দ্বারা তার পূজন ও সাম মন্ত্র দ্বারা তার ভজন করা হয়। চন্ডী পরমাত্মাময়ী। বেদ মাতায় চণ্ডী রুপে প্রকাশিত হয়েছেন।

দেবী ভাগবত অনুসারে, সর্বভূতে শক্তি আত্মারূপে বিদ্যমান এবং প্রাণী শক্তিহীন হলে শব বৎ নিষ্ক্রিয়। পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত, সচ্চিদানন্দ ও পরাশক্তি বা মায়া প্রকৃতি। কিন্তু অভিন্ন স্বয়ং শক্তি মহামায়া সচ্চিদানন্দ রুপিনী। “রূপং বির্ভত্যরূপা চ ভক্তানুগ্রহহেতবে।” সেই সচ্চিদানন্দ রূপিনী মহামায়া, পরাশক্তি। অরূপা হয়েও ভক্তগণকে কৃপা করার জন্য রূপ ধারণ করেন। বৃহৎ নারদীয় পুরাণে আছে সর্বশক্তিমতী বিশ্ব প্রসবিনী রূপে বর্ণনা করে, সেই দেবী যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছেন তা বলা হয়েছে। শক্তি, উমা, লক্ষ্মী, ভারতী, গিরিজা, অম্বিকা, দূর্গা, ভদ্রকালী, চন্ডী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি নামে অভিহিতা।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৭৭: নির্জনতা মনকে শান্ত করে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

দেবীর অভিন্নতা সত্ত্বেও ভক্তের মানসে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকটিত। এক থেকেই বহু রূপ ধারণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘আমি অজ অর্থাৎ জন্ম রহিত হয়েও অব্যয়াত্মা অক্ষীণ-জ্ঞান শক্তি স্বভাব হয়েও এবং ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত ভূত সকলের ঈশ্বর অর্থাৎ নিয়ামক হয়েও স্বীয়া প্রকৃতি অর্থাৎ আমার ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, যাঁর বশে সমস্ত জগৎ বর্তমান, যাঁর দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন দেহ ধারণ করে জন্ম জন্মগ্রহণ করি, কিন্তু পরমার্থতঃ নয়।” (গীতা অধ্যায়: ৪|৬ শ্লোকের শঙ্করভাষ্য)
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

অনির্বাচনীয় মহামায়ায় ব্রহ্মাশ্রয়ে সব করেন। পরন্তু ব্রহ্মা ত্রিকালে অচ্যুত ভাবেই অবস্থান করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “বেদে যাকে ব্রহ্ম বলে, আমি তাকেই মা বলে উপাসনা করি।” সাধক রামপ্রসাদের গানে আছে, “কালি ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছে।”

শ্রীশ্রী চণ্ডীর অর্ন্তগত দেবীকবচে, মার্কন্ডেয় ব্রহ্মার কথোপকথনে ব্যক্ত হয় দেবীর বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি। শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মাণ্ড, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রী, মহাগৌরী,ও সিদ্ধিদাত্রী। এই নবদুর্গার রূপে দেখতে পাই দেবীর বাল্যাবস্থা থেকে পৌঢ়াবস্থা পর্যন্ত। চামুণ্ডা থেকে ব্রাহ্মী একাদশ দেবীর কোন বাহন ও কী অস্ত্র ধারণ করেছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা। দেব শরীরের কোন কোন স্থানে অবস্থান করেন বিভিন্ন রূপে রক্ষা করেন ও দেবীর কোন বাহন, অলংকার ধারণ করেছেন তার সবিস্তারে বর্ণনা পাই পরবর্তী অংশে। দশদিক পাল হিসেবে সেই দেবী ই দশ দিক রক্ষা করেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

সর্বত্র সর্বব্যাপী হয়ে তিনি অবস্থান করছেন। তাঁর এক রূপ থেকে অনেক রূপ ও পর্যায়ে বিন্যাস এই ক্ষণে দেখা যায়। অরূপ থেকে রুপসাগরে বিভক্ত। এর পর, ব্রহ্মা স্তব করে বলছেন, “ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্ কারঃ স্বরাত্মিকা সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।” যিনি ব্রহ্মা রূপে জগৎ সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন, শিব রূপের সংহার করেন সেই পরমেশ্বরকেই মহামায়া নিদ্রায় আবিষ্ট করেছেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সুতরাং এই সংসারে তিনিই একমাত্র স্তবনীয়। তিনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে ও রুদ্রকে শরীর ধারণ করায়াছেন। একাদশ অধ্যায়ে দেবগণ স্তুতি করেছেন, চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, অষ্টাদশ বিদ্যা, চতুঃষষ্টি কলা, অন্যান্য সকল গুণান্বিত সকল নারীই তাঁরই বিগ্রহ। তিনিই জননীরূপা ও একাকিনীই জগতের অন্তরে ও বাইরে পরিব্যপ্ত হয়ে আছেন।

কালিকাপুরাণ আছে, “অব্যক্তং ব্যক্ত রূপেণ রজঃ সত্ত্বতমো গুণৈঃ। বিভাজ্য স্বার্থং কুরুতে বিষ্ণুমায়েতি সোচ্যতে।।” যিনি অব্যক্ত কে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন ভাবে ব্যক্ত রূপে বিভক্ত করে প্রয়োজন সিদ্ধি করেন তিনি বিষ্ণু মায়া। তিনিই এক আদি থেকে অনন্ত রূপে প্রকাশিত।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content