বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

দ্রুপদ রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায়, রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, সমবেত রাজাদের জানিয়ে দিলেন, তাঁর ভগিনীকে জয় করবার শর্তাবলি। বিশেষভাবে নির্মিত ধনুকে গুণ আরোপ করে, শূন্যে অবস্থিত, একটি কৃত্রিম যন্ত্রে স্থিত লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধ করতে পারবেন যিনি, তিনিই দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করবেন।

শুরু হল প্রতিযোগিতা। কর্ণ, দুর্যোধন, শাল্ব, শল্য, দ্রৌণায়নি, ক্রাথ, সুনীথ, বক্র প্রভৃতি রাজারা, শক্তির গর্বিত পদক্ষেপে, প্রতিযোগিতার মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন। কলিঙ্গরাজ, বঙ্গাধিপ, পাণ্ড্য ও পৌণ্ড্র দেশের রাজারা, বিদেহরাজ, যবনাধিপতি এবং অন্যান্য নানা দেশের রাজা, রাজপুত্র, রাজপৌত্ররা পদ্মপাতার মতো যাঁদের চোখ, দীর্ঘবাহু, শৌর্যশালী, সেই সব রাজপুরুষেরা, মুকুট, হার, অঙ্গদ, বলয় প্রভৃতিতে সজ্জিত হয়ে, ক্রমানুসারে বল ও দর্পের আস্ফালনসহ, অত্যন্ত কাঠিন্যযুক্ত বিশালাকারের ধনুকটিতে গুণ আরোপ করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু মনোনিবশ করতেই পারলেন না। তাঁরা, শিক্ষালব্ধ গুণ আরোপের পূর্বাপর পর্যায়ক্রম আয়ত্ত করেছেন। নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ধনুকের টানে ছিটকে পড়লেন মাটিতে, রাজাদের তেজ নিঃশেষিত। মুকুট, হার সব অলঙ্কার হারিয়ে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন তাঁরা। অবশেষে ব্যর্থ, হতাশ রাজারা, দ্রৌপদীলাভের ইচ্ছা বিসর্জন দিলেন। সমবেত অন্যান্য দর্শক রাজারা, তাঁদের দুরবস্থা দেখে হাহাকার করে উঠলেন।
রাজাদের এই অবস্থা দেখে, ধনুর্দ্ধরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কর্ণ, এগিয়ে এলেন। তিনি ধনুকটি তুলে ধরে, গুণ আরোপ করে শর যুক্ত করলেন।কর্ণকে দেখে,পাণ্ডবরা মনে করলেন, এই পৃথিবীতে একমাত্র ইনি, মুখ্য লক্ষ্য, স্ত্রীরত্ন দ্রৌপদীকে, প্রায় জয় করে ফেলেছেন। অন্য ধনুর্দ্ধারী বীরেরা ভাবলেন, দ্রৌপদীর প্রতি অনুরাগবশত লক্ষ্যবেধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কর্ণ যেন অগ্নি,চন্দ্র,সূর্যকে অতিক্রম করেছেন।এই দৃশ্য দেখে উচ্চ কণ্ঠে, চিৎকার করে উঠলেন, দ্রৌপদী। নাহং বরয়ামি সূতম্। আমি সূতকে বরণ করি না। রাগে কৌতুকের হাসি হাসলেন কর্ণ। তিনি, সূর্যের দিকে তাকিয়ে কম্পমান ধনুক ত্যাগ করলেন।

চারিদিকের ক্ষত্রিয়রা আশা ছেড়ে দিলেন। এগিয়ে এলেন বলশালী, যমের সঙ্গে তুলনীয় যাঁর বীরবত্তা, এমন, দমঘোষ পুত্র ধীরস্বভাব,মহাবুদ্ধিমান চেদিরাজ শিশুপাল। তিনি যেইমাত্র, ধনুকটির শক্তি পরীক্ষা করতে গেলেন, ধনুকের আঘাতে দুই হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেলেন মাটিতে। এ বার মহাশৌর্যশালী, অত্যন্ত সাহসী জরাসন্ধ ধনুকটির কাছে উপস্থিত হলেন, মনে হল তিনি পর্বততুল্য অচল। ধনুকের আঘাতে হাঁটু নিয়ে বসে পড়লেন মাটিতে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

সত্বর স্বদেশে ফিরে গেলেন রাজা জরাসন্ধ। মহাবীর, মহাবলী মদ্ররাজ শল্যের একই দশা হল। সমাগত জননায়কেরা লক্ষ্যভেদের আশা ছেড়ে দিয়েছেন—সভায়, এই মর্মে আলোচনায় ব্যস্ত যখন বিস্ময়ে সচকিত জনমণ্ডলী, তখন, কুন্তীপুত্র অর্জুন গুণসজ্জিত ধনুতে শর সংযোগ করতে আগ্রহী হলেন। ধনুতে গুণ সজ্জিতকরণে নিশ্চেষ্ট হলেন রাজারা। পরিষ্কার বুদ্ধি যাঁর সেই অর্জুন ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অথোদতিষ্ঠদ্বিপ্রাণাং মধ্যাজ্জিষ্ণুরুদারধীঃ।

ইন্দ্রের পতাকার তুল্য উন্নত, দীপ্ত, ধনুরুত্তোলনে প্রস্থানরত, অর্জুনকে দেখে, প্রধান ব্রাহ্মণরা ‘ফিরে এস’ বলতে বলতে অজিন ওড়াতে লাগলেন। বিপ্রদের কেউ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন, কেউ হলেন আনন্দিত। তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিজীবীরা পরস্পর আলোচনায় ব্যস্ত হলেন। ধনুর্বেদবিদ্যায় সুশিক্ষিত, শল্য প্রভৃতি পৃথিবীখ্যাত বলশালী ক্ষত্রিয়রা যে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, শস্ত্রবিদ্যাবিহীন, শক্তিতে দুর্বল, অশিক্ষিত, নামে মাত্র ব্রাহ্মণ, ইনি, কী ভাবে এই ধনুকটিতে গুণ আরোপ করবেন? এনার লক্ষ্যবেধের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। চাঞ্চল্যহেতু, কাজটি তুচ্ছ মনে করে, তিনি যদি অসফল হন। তবে ব্রাহ্মণরা রাজাদের পরিহাসের পাত্র হয়ে উঠবেন যে। উনি যদি গর্ববশত, কাজটি লঘু মনে করে, ব্রাহ্মণসুলভ চপলতা-সহ, ধনুকটিকে আনত করতে অগ্রসর হয়ে থাকেন তাহলে ওঁকে বাধা দিন সাধু মা গমৎ। ভালোয় ভালোয় ও যেন না যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

ব্রাহ্মণদের মত হল— তাঁরা হাস্যাস্পদ হবেন না, লঘুভাবে তাঁরা গ্রাহ্য নন, এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণরা মহীপতিদের বিদ্বেষের পাত্র হয়ে থাকবেন না। নাবহাস্যা ভবিষ্যামো ন চ লাঘবমাস্থিতাঃ। ন চ বিদ্বিষ্টতাং গমিষ্যামো মহীক্ষিতাম্।। কেউ কেউ অর্জুনের সুগঠিত শরীরটির প্রতি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এই লক্ষ্মীমন্ত পুরুষটির গজশ্রেষ্ঠর শুঁড়ের মতো দীর্ঘ আকৃতি, দৃঢ় কাঁধ, ঊরু ও বাহুদুটি। তাঁর ধৈর্য হিমালয়তুল্য। সিংহসম লীলাময় গতি, বলিষ্ঠদেহের অধিকারী তাই তিনি সুশ্রী। প্রমত্ত গজশ্রেষ্ঠতুল্য শৌর্যশালী, এনার, কার্যোদ্ধারের সম্ভাবনা আছে। উৎসাহ দেখে,সেটাই অনুমান করা যায়। এর শক্তিই হল ভীষণ উৎসাহ। অসমর্থ হলে কী নিজে এগিয়ে যেত? এই পৃথিবীতে এমন কিছুনেই যা অসাধ্য। এই স্থলভূমিতে বিচরণকারী মানুষের মধ্যে জল, বায়ু ও ফলাহারী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্রাহ্মণদের অসাধ্য এমন কিছু নেই। ব্রাহ্মণরা দুর্বল হলেও নিজস্ব তেজোবলে বলীয়ান। কাজটি, সঠিক বা বেঠিক, বিরাট না ছোট—এই বিবেচনাবোধের বশবর্তী হয়ে, ব্রাহ্মণদের অসম্মান করা উচিত নয়।

যেমন, জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, একা ক্ষত্রিয়দের নিঃশেষে জয় করেছিলেন। ব্রহ্মতেজোবলে অগস্ত্যমুনি অগাধ সমুদ্র পান করেছিলেন। তাই ব্রাহ্মণরা বলাবলি করতে লাগলেন, অত্র বটুরেষ ধনুর্মহান্। এখানের এই ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণটি মহানই বটে। ইনি দ্রুত ধনুকে গুণ আরোপ করবেন— তথেত্যূচুর্দ্বিজর্ষভাঃ।

ব্রহ্মর্ষিগণ বললেন—’তাই হোক’। সমবেত ব্রাহ্মণদের, এমন নানা মত বিনিময় চলতে থাকল। অর্জুন, ধনুকের নিকটবর্তী হয়ে পর্বতের মতো অনড় হলেন। ধনুকটিকে ঘিরে পরিক্রমা শুরু করলেন। অর্জুন জগদীশ্বর, বরপ্রদানকারী, প্রভু কৃষ্ণকে মনে মনে স্মরণ করে ধনুকটি তুলে ধরলেন। অনেক চেষ্টা করেও রুক্মী, সুনীথ, বক্র, রাধেয়, দুর্যোধন, শল্য, শাল্ব প্রভৃতি ধনুর্বেদবিদ্যায় পারঙ্গম পুরুষসিংহরা যে ধনুকটি গুণসজ্জিত করতে পারেননি, প্রখ্যাত বীরদের উপস্থিতিতে, এক নিমেষে, ইন্দ্রপুত্র, বিষ্ণুতুল্য প্রভাবশালী অর্জুন, সদর্পে, সেই ধনুকটিতে গুণ আরোপ করলেন। তুলে নিলেন পাঁচ পাঁচটি বাণ। পরক্ষণেই উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বিদ্ধ করলেন। বিদ্ধ লক্ষ্যবস্তু, সহসা ছিদ্রপথে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। অন্তরীক্ষে মহা কোলাহল সৃষ্টি হল, সেই মহা কলরোল ছড়িয়ে পরল সভামধ্যে। দেবতারা, শত্রুজয়ী অর্জুনের মাথায় দিব্য কুসুমরাজি বর্ষণ করতে লাগলেন। হাজার হাজার ব্রাহ্মণ বিজয়পতাকার মতো উত্তরীয়ের প্রান্তভাগ, দোলাতে লাগলেন। নিজেদের অক্ষমতায় লজ্জিত, বিষমদৃষ্টি লক্ষ্যভ্রষ্ট, রাজারা, সর্বত্র হাহাকার করে উঠলেন। আকাশের সব দিক থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঝরে পরল, বাজনদারেরা শতাঙ্গ ও তূর্য বাজাতে থাকলেন, সূত ও মাগধগণ সেখানে সুমধুর স্বরে স্তুতি পাঠ করতে লাগলেন। লক্ষ্যবেধকারীকে দেখে শত্রুহন্তা রাজা দ্রুপদ আনন্দিত হলেন। তিনি পার্থ অর্জুনের সাহায্যার্থে সসৈন্যে এগিয়ে এলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

উত্তেজিত জনরোল ক্রমশ বিস্ফোরণের পর্যায়ে উন্নীত হল যখন, ধার্মিকশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে বাসস্থানের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন। হয়তো মায়ের সুরক্ষার বিষয়ে চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। আর দ্রৌপদী? তিনি লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখলেন, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলেন, লক্ষ্য বিদ্ধ করেছেন যিনি সেই ইন্দ্রতুল্য শৌর্যবান ও অপরূপ পার্থকে। দেখে শারীরিক বিভঙ্গে যেন হেসে উঠলেন, এ সুহাসিনী দ্রৌপদীর বহদৃষ্ট রূপ নয়, নবরূপা দ্রৌপদীর মুখে হাসি ফোটেনি, তবু তিনি হাস্যময়ী। আনন্দে আত্মহারা দ্রৌপদীর উচ্ছ্বাসে মত্ততার প্রকাশ নেই। ভঙ্গীতে শৃঙ্গার ফুটে উঠল যখন তিনি যেন প্রায় লুটিয়ে পড়লেন, কথা না বলেও দৃষ্টিতে বাঙ্ময়ী হয়ে উঠলেন। তাঁর চোখ, অনেক মনের ভাব প্রকাশ করল।

শুভ্র বরমাল্যখানি নিয়ে, স্মিতমুখে, কৌন্তেয় অর্জুনের অভিমুখে এগিয়ে গেলেন পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদী। অর্জুনের মুখোমুখি হয়ে, শুভদৃষ্টি বিনিময়ান্তে, নিঃসংকোচে, বীর রাজমণ্ডল ও ব্রাহ্মণদের মধ্যস্থিত অর্জুনের বুকে বরমাল্য অর্পণ করে তাঁকে পতিরূপে বরণ করলেন দ্রৌপদী। এ বরণের তুলনা করা যায় বিখ্যাত সব বরমাল্য অর্পণের সঙ্গে।এই বরণ শচীর ইন্দ্রবরণ, দেবী স্বাহার অগ্নিবরণ, লক্ষ্মীদেবীর নারায়ণবরণ, দেবী ঊষার সূর্যবরণ,রতির কন্দর্পবরণ, পার্বতীর মহাদেববরণের অনুরূপ। ব্রাহ্মণরা সেই রঙ্গমঞ্চে বিজয়ী অর্জুনকে বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করতে থাকলেন। অচিন্তনীয় কাজটি করেছেন অর্জুন। গর্বিত পদক্ষেপে, নববধূকে সঙ্গে নিয়ে সেই রঙ্গভূমি থেকে বেড়িয়ে এলেন অর্জুন। দ্রৌপদী তাঁকে অনুসরণ করলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী

যে কোনও শিক্ষার যাথার্থ যাচাই হয় পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তরণের সাফল্যে। জীবন নামের যুদ্ধক্ষেত্রটিতেও এই সাফল্য লাভ করা যায়, যদি থাকে সমস্যাসংকুল বিষয়ে স্থৈর্য, অধ্যবসায় ও গভীর মনোনিবেশের আগ্রহ। যে কোনও জটিলতার সমাধানের মধ্যে আছে, লক্ষ্যবেধের সমতুল্য সাফল্যের গরিমা। পঞ্চপাণ্ডব, রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের দর্শক হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। খাদ্যবস্ত্রবাসস্থানহীন দরিদ্র ব্রাহ্মণদের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনের মাধ্যমে সফলতা অর্জন ও রাজকন্যার বরমাল্য লাভ, দুটিই হয়তো নিতান্ত দুরাশাই ছিল। প্রতিযোগীরা ছিলেন, তাঁদের সমকক্ষ পৃথিবীবিখ্যাত ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠরা।

সাধারণ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে পাণ্ডবদের কোন পার্থক্য ছিল না। তাঁরা অন্যদের মতোই রাজাদের প্রদত্ত ধনপ্রার্থী হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কথিত রাজকন্যার বরমাল্যলাভের শর্তাবলি শুনেও তাঁদের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের প্রিয় বিষয়, ধনুর্বিদ্যার কৌশল প্রদর্শনের অপূর্ব সুযোগের সদ্ব্যবহার করবার আগ্রহ কোথায় ছিল তখন? পিতামহ বেদব্যাসের স্তোকবাক্য কী তাঁদের নিশ্চেষ্ট করে তুলেছিল? বোধ হয় অনায়াসলভ্য বিষয়ে সামর্থ্য প্রদর্শনের আগ্রহ থাকে না। অথবা আলোকসামান্যা অনবদ্যা যাজ্ঞসেনী কামনার ঝড় তুলেছিলেন মনে, যার দাপট এবং সমবেত প্রতিযোগী রাজাদের দম্ভ, হয়তো পাণ্ডবদের সুপ্ত পৌরুষ জাগিয়ে তুলেছিল। পাঁচ ভাই দর্শক। উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বেধ করতে অগ্রণী হলেন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির নন, নন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন, তিনি তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। তাঁর প্রিয় বিষয় ধনুর্বাণের কৌশল প্রদর্শন। অসফল রাজাদের হতাশা যেন অর্জুনের নিজেকে প্রমাণের সুযোগ এনে দিল। অর্জুনের sport spirit তাঁর সেরা মূলধন। যুগ যুগান্তরের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ অর্জুন, যাঁর নামাঙ্কিত ভরতবংশীয়দের শ্রেষ্ঠ খেলোয়ারের তকমা।

ছবি: প্রতীকী।

প্রিয় বিষয়ের প্রতিযোগিতায় অর্জুনের অংশগ্রহণ কী শুধু নিজেকে সফল প্রতিপন্ন করবার প্রয়াস?না কামজ প্রণয়ে আগ্রহ? কোনটি? বিখ্যাত অস্ত্রগুরুর প্রশংসাধন্য শিষ্যের একদা শিক্ষাজীবনে রাতের নিশ্ছিদ্র আঁধারে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেধের অনুশীলন ব্যর্থ হয়নি। অধীত বিদ্যা, অর্জিত জ্ঞান, অসফল হয় না—অর্জুন প্রমাণ করলেন। দ্রৌপদীর বরমাল্যলাভ অনুষঙ্গমাত্র। অর্জুনের লক্ষ্যবেধ, সফলতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। শৈশবে গুরু দ্রোণাচার্যের জহুরীর চোখ আবিষ্কার করেছিল এক সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ বিরল প্রতিভাকে। পাখির চোখ একমাত্র লক্ষ্য, চারিদিকে অজস্র প্রতিভাধরদের ছড়াছড়ি, সেই ভিড়ে সাফল্য ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে চাই নিরন্তর মেধা শাণিত রাখার জন্যে অনুশীলন। কোনও জ্ঞানার্জন বৃথা নয়। একাগ্রতা, আত্মোৎসর্গ, মেধা, পথনির্দেশের জন্যে যোগ্য প্রশিক্ষক—এই সবকটির একযোগে সমন্বয়ক্রমে হয় প্রতিভার বিনির্মাণ। লক্ষ্য বেধের মানসিকতার প্রস্তুতি।

স্বয়ংবর সভায় রাজকীয় গর্বোদ্ধত উন্নাসিকতা নিয়ে নয়, পাণ্ডবদের বিনম্র উপস্থিতি ছিল সাধারণের বেশে। আভিজাত্যকে পরাজিত করেছে সাধারণ হয়েও অসাধারণ মেধাবী প্রতিভাধর অর্জুন। প্রতিভাধরদের কোন শ্রেণিভেদ হয় না, হয় না অভিজাত আভাজন বিভাগ। মেধার স্বীকৃতি,সাফল্য এমন এক নিটোল ঔজ্জ্বল্য যার কোন বিকল্প হয় না। তাই রামায়ণের রামের ‘ধনুক ভাঙা পণ’, অর্জুনের বিদ্ধ ‘পাখির/মাছের চোখ’ যুগজয়ী প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে সমাজকে ঋদ্ধ করে আজও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content