ছবি: প্রতীকী।
আগস্টের দশে আন্তর্জাতিক সিংহ দিবসের পরেই বারোই আগস্ট বিশ্ব হস্তী দিবস। ব্যাপারটা হল এই যে, হাতি আর সিংহের যুদ্ধে কে বিজয়ী হবে তা আগে থেকে বলে রাখা খুব মুশকিল। সিংহ যেমন মানুষের জীবন-যৌবন আর আকাঙ্ক্ষার কোণে কোণে রাজকীয় ছায়া রেখেছে, হাতি-ও সেদিক থেকে কিছুমাত্র পিছিয়ে নেই। তবে, দু’জনের চলা দু’রকমের। এই যেমন, গায়ে হাতির মতো বল থাকা বেশ প্রশংসার। কিন্তু মাথায় হাতির মতো বুদ্ধি তার উল্টো। সে হাতি যতোই বুদ্ধি ধরুক না কেন! সিংহের অবশ্য এসব সমস্যা নেই। রাজার জন্য ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা জমানো থাকে। তাকে অবমাননা করা ভয়াবহ।
আচার্য মনু রাজার সেই ভীতিপ্রদ ঐশ্বরিক রূপটি এঁকেছিলেন। কালিদাস অবশ্য বজ্রকঠিন-কুসুমকোমল ভারি বিচক্ষণ রাজার মহান মানবিক রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন, যাঁরা শক্তিতে অজেয়, বুদ্ধিতে অমেয়, শাসনে অনিন্দ্য, ব্যক্তিত্বে অলঙ্ঘ্য। এঁরা যেন সেই প্রসিদ্ধ নারকেলের মতো, বাইরে কাঠিন্য, অন্তরে স্বাদু। সিংহকে এমন রাজা ভাবতে চাইলে ভাবাই যায়, কিন্তু তার ভয়াল হিংস্রতাই শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে। মনুষ্যত্বের আরোপেও তা বুঝি যাবার নয়, কিংবা মানুষের আসল চেহারাটাই বুঝি ওইরকম।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৫: মহাভারতের অন্তর্লোকে কি শুধুই হিংসা ও প্রতিহিংসার ঘৃণা বিদ্বেষ?
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা
তাছাড়া, নারকেল হাতির প্রিয় খাদ্য। মানুষ হাতিকে কেমন ভাবতে চাইছে, হাতির ঠিক কোন ক্ষমতাটা তার পছন্দের সেটাই এখানে আসল ব্যাপার। হাতির মতো খাওয়া, হাতির মতো চেহারা বা চলাফেরা মনুষ্যসমাজে অনুমোদিত নয় বললেই চলে, এমনকী হাতির স্মৃতি, বুদ্ধি, আয়ু নিয়েও তাদের মাথাব্যথা ততো নয়। গণেশের হাতির মাথা নিয়ে চলাফেরায় তার ধীশক্তি ইত্যাদি নিয়ে কী কী পৌরাণিক-সামাজিক-দার্শনিক ব্যঞ্জনা থাকে তা নিয়ে ভাবার লোকের চেয়ে শুঁড়, কান, পেট আর কলা বৌ নিয়ে চিন্তাশীল জনগণ মাত্রাতিরিক্ত। হাতি কলাটা মুলোটা পছন্দ করে, শেখালে ক্রিকেট ফুটবল খেলে, চোখে চশমা আর মাথায় ছাতা দিয়ে বই পড়ে আর সাইকেল চড়ে, গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে পেন্নাম করে, আবার, রেগে গেলে তুলে আছাড় মারে, না পেলে বঙ্কিমের বিড়ালের ভাবনামতো কেড়ে খায়। তাতে দোষের কিছু নেই। চলার পথে বাধা পেলে জীব তাকে কাটিয়ে চলতে চায়, রেলগাড়ি থাকলে অন্য কথা।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ
হাতিদের রেলগাড়ি চড়ার ইচ্ছে হয় কীনা বলা মুশকিল, তবে হাতি চড়ে চলাফেরায় বেশ একটা রাজকীয় ব্যাপার থাকে। এদিক দিয়ে হাতি আর সিংহের বেশ একাত্মতা আছে বটে। রাজারা হাতি চড়তেন। যার যতো বেশি হাতি, যুদ্ধে জয় তার ততো নিশ্চিত। হাতি সম্পদ বলেই গণ্য হতো। দাবার চালে যেমন গজের ঘোরাফেরা, তেমনই কবিদের মগজেও। আকাশে মেঘ করলে সেই পুরাকাল থেকে যাদের কবিতা ‘পেতো’, তারা মেঘকে হাতির দল ভেবেই কবিতা লিখতো, কেউ কালিদাস হতো, তো কেউ হরিদাস, কিন্তু হাতি সকলকেই বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে এমন শুঁড়বিশিষ্ট জানোয়ার পৃথিবীতে দুটি নেই। ইন্দ্র থেকে হালের বিশ্বকর্মা, হাতিকে বাহন করেছেন। আকাশগঙ্গা কিংবা মন্দাকিনীর জলে হাতিরা নেমে মজা করে স্নান করছে, এসব তো গল্পের অলিতে গলিতে। “হস্তী” হাতির “হস্ত” ঐ শুঁড়, সেটা দুলিয়েই আবালবৃদ্ধবনিতাকে মুগ্ধ করেছে সে যুগে যুগে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ
সব মিলিয়ে দেখা যায়, সিংহের মধ্যে একটা লাফ অ্যাণ্ড টাফ ব্যাপার থাকলেও হাতি ভারে, হয়তো বা ধারেও অনেক এগিয়ে। কী এক অদ্ভুত গুণ তাকে সর্বগ্রাহ্য করেছে, সে শিশুর নরম খেলনা হয়ে নিশ্চিন্ত করে, কার্টুন হয়ে আনন্দ দেয়, দেবতা হয়ে নারকেল ভেঙে পুজো নেয়, শুঁড় নেড়ে হ্যান্ডশেক করে, মানুষের পালস বোঝে, মানুষকে ছাড়িয়ে যায়, দিনের শেষে নিজের খাবারটা নিজেই সংগ্রহ করে, বয়ে নিয়ে চলে, মানুষকেই মনিব মেনে ধরা দেয়, তাকেই বিশ্বাস করে প্রাণ দেয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?
এমনটা সিংহের ক্ষেত্রে হওয়া মুশকিল। সিংহ হিংস্র আর হাতি অহিংস বলেই যে এমনটা হয় তা নয়, মানুষ জগতে “শক্তের ভক্ত নরমের যম” বলতে ঠিক কী বুঝতে চায় তার ওপর অনেকটাই এটা নির্ভর করছে বুঝি। শিশু সর্বদমন ভরত সিংহশিশু নিয়ে খেলছিল, কালিদাস দেখেছেন। তার এই শৌর্য তাকে কালজয়ী করেছিল। তবে একালের ভরতদের শৈশবে হাতির উঁকিঝুঁকি বেশী, তার মিষ্টি মুখ, মন ভালো করা চলন-বলন, কাজকর্ম, চেহারা আর বিশ্বাসযোগ্যতা তাকে সর্বজনগ্রাহ্য করেছে। এতে মনে হয় যে, শুধু বনের রাজা হলেই হয় না বুঝি, মনের রাজাদের মাথা থেকেই মুকুটটা খোলা যায় না।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।