শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


চলছে আন্দোলন।

সাহিত্য বাইরে থেকে কিংবা পুরোটাই কল্পনা নির্ভর থাকে না। প্রত্যেকটি রচনায় লুকিয়ে থাকে সময়ে ছাপ, সমাজের ছাপ। কল্প বিজ্ঞান কিংবা রূপকথার গল্পগুলি অনেক সময় বাস্তব পৃথিবী থেকে অনেক দূরে থাকে, আবার কখনও না। এই শিশু ভোলানো গল্প-কবিতায়ও লুকিয়ে থাকে সময়ের ছাপ। যেমন ঘুম পরানো ছড়ায় আছে, “বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে!”

বরাকের ইতিহাসে ১৯ মে’র ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ভাষা শহিদদের বলিদানের কথা তাই খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে সাহিত্যেও। কিন্তু এগারোটি তাজা প্রাণের বলিদানেও শান্ত হল না কুচক্রীদের দলভি। ফলস্বরূপ ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট করিমগঞ্জের বাচ্চু চক্রবর্তী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে শহীদ হন। শুধু তাই নয়, করিমগঞ্জের জগন্ময় দেব (জগন) এবং দিব্যেন্দু দাস (যিশু) ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। বরাকের কবিদের কবিতায় এ অঞ্চলের ভাষা আন্দোলনের স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

“দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল এই যে ঈশান কোণ
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন।
শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা-
বাংলা আমার মাতৃভাষা ঈশান বাংলা ‘মা’।
(উনিশে মে, ১৯৬১, শিলচর, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী
ভাষা মায়ের করুণ অবস্থার কথা ফুটে ওঠে কবি অনুরূপা বিশ্বাসের কবিতায়—

“এক একুশে দুই একুশে
মধ্যিখানে চর উনিশে
এমনি কত দিন তারিখের
কাঁটার মুকুট মাথায় পরো
তুমি আমার দুঃখিনী মা
গলায় ফাঁসির রক্তে ভেজা
বর্ণমালার হার।”

( দুঃখিনী মা, অনুরূপা বিশ্বাস)


ভাষা জননীর জন্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর কবিতায় তুলে ধরেন—

“আকাশ এখনো নীল ,মাটি থেকে ওঠে আজও
সজীব অঙ্কুর
মেঘে – মেঘে জেগে ওঠে শুশ্রুষার জল
কুসুম বুকে
জাগে মধু মায়ের স্নেহের মত অবিরল
মৃত্যুজীৎ শহিদেরা
উনিশের ভোর হয়ে আসে প্রতিদিন।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে যেভাবে জানে সবাই জানে তেমনি অসমের বরাকের শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনের চত্বরে যে ১৯৬১’র ১৯ মে রক্তে ভেসে গিয়েছিল সে কথা অনেকেই জানেন না। দেশভাগ হয়ে আসা স্বাধীনতার পর বঙ্গ সন্তানদের লড়াইয়ের চেহারাটাই পাল্টেছিল মাত্র থেকে যায়নি। ঈশান বাংলার কান্নার আওয়াজ বরাক, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। আর অস্তিত্বে ভীষণ লড়াইয়ের পরও যখন বহির্বিশ্বে “দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন” এর কথা পৌঁছয় না, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রান্তবাসী কবিদের কবিতায় এক অভিমান লক্ষ্য করা যায়। দিলীপকান্তি লস্কর তাই তাঁর ‘অবস্থান’ কবিতাটিতে বলেন—

“আমি কোত্থেকে এসেছি,
তার জবাবে যখন বললাম,
করিমগঞ্জ অসম,
তিনি খুশিতে ডগবগ হয়ে বললেন, বাঃ বেশ সুন্দর বাংলা বলছেন তো!

***


ওঁকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়েদিতে গিয়ে বললাম,
বাংলা ভাষার পঞ্চদশ শহিদে ভূমিতে আমার বাস
তিনি তখন এক্কেবারেই আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভিমরি খাইয়ে বললেন—
ও, বাংলাদশ? তা-ই বলুন।”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

ভারতের সংবিধান প্রত্যেক ভাষাভাষীর লোককে তার মাতৃ ভাষায় প্রাথমিক বিদ্যা অর্জন করার অধিকার দিয়েছে (Act 1956, article 350 A & B)। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছেলে-মেয়েরা সেই অধিকার থেকে দীর্ঘ দিন বঞ্চিত ছিল। কারণ ভারতের সংবিধানে মণিপুরি ভাষার উল্লেখ থাকলেও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির উল্লেখ নেই। মণিপুরি ভাষার দুটি ভাগ রয়েছে— মিথেই মণিপুরি, আর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। সুতরাং আবার শুরু হল অধিকারের লড়াই। এগিয়ে এল বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি সাহিত্য পরিষদ। গঠিত হল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি অন্দোলন পরিষদ। শুরু হল সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজনে আবার রেল এবং সাধারণ যানবাহনের রাস্তা অবরোধ চলল। একটানা ৫০১ ঘণ্টা ধরে অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল, আবার সত্যাগ্রহীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাল পুলিশ। বরাক ভূমি এ বারও তার এক আদরের মেয়েকে হারাল। সুদেষ্ণা সিং (বুলু) শহিদ হন ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ। শহিদ সুদেষ্ণাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার কবি শরৎ চন্দ্র সিংহ লিখেন—

“হে শহিদ, জরম অসত কচুবাড়িত
মনুষ্য রূপে ইমা , বিষ্ণুপ্রিয়া সুদেষ্ণা।

***


যত দিন যাই তই চন্দ্র-সূর্য এ পৃথিবীর মা
অমর তি, ইতিহাস লিখিয়া লিখিয়া।’’


অর্থাৎ কচুবাড়ি নামক জায়গায় শদিহ সুদেস্না জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি যেন, সমস্ত বিষ্ণুপ্রিয়াদের ইমা অর্থাৎ মা। যত দিন এ পৃথিবীতে চন্দ্র সূর্য থাকবে তত দিন তাঁর অমর ইতিহাস বার বার লেখা হবে।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

অসমের বাংলা ভাষা আন্দোলন অসমে রচিত বাংলা সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, গণেশ দে, ছবি গুপ্তর মতো কবি সাহিত্যিকদেরকে স্মরণ করতে হয়। বর্তমান সময়ে অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য, দিলীপকান্তি লস্কর, রূপরাজ ভট্টাচার্য, শ্যামলী কর, চন্দ্রিমা দত্ত, দেবাশিস চক্রবর্তী, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য, রত্নদীপ দেব, দেবারতি চন্দ এবং আরও অনেকের কবিতাতেই ভাষা আন্দোলন জায়গা করে নিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে উনিশের কবিতা যেমন আত্মত্যাগের ইতিহাস কথা শুনায় তেমনি বলে ঈশান বাংলার মানুষের চির সংগ্রামের কথা।

“আমার সত্তা জুড়ে অনর্গল বয়ে যায়
রক্তস্নাতা নদী, অতীতের শোক গাঁথা খুঁড়ে দেখি,
আত্ম-মোক্ষণ লিপি সারে সারে শুয়ে আছে
সমাধির প্রশান্ত আশ্রয়ে।

***

জানি না কোথায়। আছে ধানিজমি,
আর আমার ন্যায্য ক্ষেতের ফসল।
কোন স্রোতে তবে ভেসে যাবো আজ!
কোন পারে আমার নিশ্চিত আশ্রয়?”
( ১৯-রূপরাজ ভট্টাচার্য)।

সুদেষ্ণা সিং।

নান্দনিক, দশরূপক, রূপম, ভাবিকাল, ক্যালচারাল ইউনিট ইত্যাদি নাট্য সংস্থা নিয়মিত নাট্যকর্মশালা এবং মঞ্চে নাট্য পরিবেশনও করে। বরাকের বিভিন্ন নাটকে ভাষা শহিদের জীবন্ত নাট্যরূপ দেখা গিয়েছে বিভিন্ন সময়।

‘বঙ্গাল খেদার’ নামে অসমের বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি এক সময় বড়ই দুঃখ জনক ছিল। তবে এ কথা মেনে নিতেই হয় যে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও অসমের বাঙালিরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছেন। অসমে বর্তমানে অসমীয়া, বাঙালি এবং অনেক ভাষাভাষীর লোক একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে বাস করছেন। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের মাতৃভাষা চর্চা করা আমাদের কর্তব্য। এ কর্তব্য আমাদের পালন করতে হবে আমাদের উত্তর সূরীর জন্য, তবেই তো আমরা হতে পারব উনিশের যোগ্য উত্তরঅধিকারী।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content