রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


চুনিলাল বসু ও স্বামী বিবেকানন্দ।

রসায়নাচার্য চুনিলাল বসু ছিলেন এক রঙিন ব্যক্তিত্বের মানুষ। সহৃদয় এই মানুষটি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, গবেষক, রসায়নবিদ ও সুলেখক। ১৮৬১ সালে ১৩ মার্চ, তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৪ পরগনার বিখ্যাত ‘মাহিনগর বসু পরিবার’-এ। পিতা দিননাথ বসু ও মাতা ভগবতী দেবীর কোল আলো করে এই পৃথিবীতে আসেন চুনিলাল। ওই একই বছরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু চঞ্চল এই চুনিলাল সাত বছর বয়সে ভর্তি হন শ্যামবাজারের অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুলে। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ১৮৭৮ সালে।
১৮৮০ সালে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন থেকে এফএ পরীক্ষায় সুনামের সঙ্গে পাশ করেন। এখানে বন্ধু হিসাবে পেলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন। এই বন্ধুই তাঁর জীবনের বিরাট পরিবর্তন করেন এবং বিজ্ঞানকে মানব সেবার কাজে লাগাতে সাহায্য করেন। এরপর ডাক্তারি পরীক্ষায় বা এমবি পরীক্ষায় মেডিকেল কলেজ থেকে ১৮৮৪ এবং ১৮৮৬ সালে যথাক্রমে প্রথম ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। ডাক্তারি পড়বার সময় তিনি অনেক কৃতিত্ব স্থাপন করেন। বটানি প্যাথলজি, মেডিসিন পরীক্ষায় স্বর্ণপদক, অ্যানাটমি, সার্জারি ও হাইজিন পরীক্ষায় প্রশংসাপত্র পান। ক্লিনিক্যাল সার্জারি ও ক্লিনিক্যাল মেডিসিন পরীক্ষায় পারিতোষিক পান।
আরও পড়ুন:

বীরভূমের ছোট্ট নদী হিংলো

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

ছাত্র জীবনের মতো কর্মজীবনও তাঁর উজ্জ্বল। প্রথমে মেডিকেল কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন পদে চাকরি পান। পরে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট মেডিকেল এক্সামিনার ও মেডিকেল কলেজের রসায়নশাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৮৭ সালে বার্মার ম্যাগওয়ের সিভিল ডিসপেনসারি ও জেলের ভার গ্রহণ করেন। এরপর ফিরে এসে ১৮৮৮ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট কেমিক্যাল একজামিনার পদে উন্নীত হন। পরে ফাস্ট ক্লাস অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হয়েছিলেন।

চুনিলাল বসুই প্রথম ভারতীয় যিনি প্রধান রসায়ন পরীক্ষক পদে উন্নীত হন। ১৯২০ সালে এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর কাজের জন্য তিনি অসংখ্য সম্মান, পদ ও পদবী পান, যথা— মেডিকেল কাউন্সিল এর সদস্য, লন্ডনের মেডিকেল সোসাইটির ফেলো (এফসিএস-১৮৯৪), ক্যালকাটা মেডিকেল জার্নালের সম্পাদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ইত্যাদি। ইংলিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর ও সিআইই উপাধি দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে কলকাতার ‘শেরিফ’ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী চিকিৎসক। সম্পৃক্ত লবণের দ্রবণে মৃত মানুষের পাকস্থলী ও অন্ত্র সংরক্ষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা পরবর্তীকালে সমগ্র ভারতব্যাপী প্রচলিত হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

১৯০১ সালে করবী ফুলের কয়েকটি অজ্ঞাতপরিচয় রাসায়নিক দ্রব্যের সন্ধান পান। এই গবেষণা ‘করবিন’ নামে চিহ্নিত। এই আবিষ্কারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘কোটস্ মেমোরিয়াল প্রাইজ’ দেন ডক্টর বসুকে। তিনি ছিলেন সহজ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান লেখক। তিনি মোট ২৫টি বই লিখেন, তার মধ্যে ২১টি বিজ্ঞান বই। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর ওপর তিনি ইংরেজিতে একটি বই লিখেছিলেন। তার লেখা বিখ্যাত বইগুলি হল— জল, বায়ু, কাগজ, খাদ্য, শরীর, স্বাস্থ্যবিধান, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন সূত্র ইত্যাদি। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের উপর তাঁর লেখা- ‘কম্বাশন’, ‘এ পিঞ্চ অফ কমন সল্ট’, ‘এ লাম্প অফ কোল’ খুবই বিখ্যাত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

মানুষ চুনিলাল ছিলেন দেশ ও দশের সেবায় নিয়োজিত প্রাণ। ১৯২৪ সাল নাগাদ চুনিলাল বেঙ্গল কেমিক্যাল এর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি মূক ও বধির বিদ্যালয়, অনাথ আশ্রম, অন্ধদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিঃশব্দে দান ও সেবা করতে পছন্দ করতেন। ১৯৩০ সালে মাত্র ৬৯ বছর বয়সে চুনিলাল প্রয়াত হন। ১৯৪৪ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ‘চুনিলাল বসু স্মৃতি পদক ও পুরস্কার’ দেওয়া হয়। তিনি চির অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁর কীর্তির মধ্যে, তাঁর কর্মের মধ্যে। এই বিখ্যাত বাঙালি, মানবহিতৈষী ও ডাক্তার বিজ্ঞানীকে যেন কখনও ভুলে না যাই।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content