বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


 

সিন্নি: পর্ব-১২

ঘরের মেঝেতে ছবি আর নেগেটিভগুলো তখন জ্বলতে জ্বলতে প্রায় ছাই হয়ে এসেছে। সেই আগুন থেকে ভয়ংকর রোষ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে রীনা বলেছিল—
—কী বললি? বিয়ে করবি? আমাকে?
—হ্যাঁ! আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি রীনা। তোকে কখনও বলতে
পারিনি।
—তবে আজ বললি কেন?
—আমি জানি তুইও আমাকে খুব ভালোবাসিস। এই দেখ আমাদের আজ সন্ধেবেলার পুরী যাওয়ার রেল টিকিট টু টায়ার এসি। বিশ্বাস কর তোর কোনও কষ্ট হবে না। নিজে না খেলেও রাজরানীর মতো রাখবো তোকে।
—রীণা চিৎকার করে উঠেছিল—
—এনাফ! জাস্ট স্টপ ইট অ্যান্ড গেট আউট। কখনও বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি? কোন দুঃখে তোর মতো স্কুল না টপকানো ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে আমি বিয়ে করবো? আমার এমবিশন সম্বন্ধে
কোনও ধারণা আছে তোর? পচাপচা ছবিগুলো দেখে ডায়লগ মারছিস। নিজের ঘর সংসার চালাতে পারিস না? এর ওর বাড়িতে ইলেকট্রিকের দুটো ওয়ারিং করে আমাকে কেন একটা সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করলেও খাওয়াতে পারবি না। সাহস কত, পুরীতে যাবে? টু টায়ার এসি? বিয়ে করবে? স্কাউন্ড্রেল কোথাকার!
রাগে কাঁপতে কাঁপতে টিকিটগুলো ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল রীনা। আচমকা এই ভয়ংকর অপমান। তার নিখাদ প্রেমের এই প্রত্যাখ্যান প্রায় সহ্য করতে পারেনি সে। ‘মিথ্যেবাদী’ বলে প্রলয় রীনাকে সজোরে ধাক্কা দিলে রীনা পড়ে যায়। মাথার পিছনটা সজোরে গিয়ে মার্বেলের মেঝেতে ঢুকে গিয়ে রীনা জ্ঞান হারায়। মাথায় তখন আগুন জ্বলছে প্রলয়ের। সে বুঝতেও পারেনি যে রীনা জ্ঞান হারিয়েছে। সেই ঘরেই একটা থলের মধ্যে প্রলয়ের ইলেকট্রিকের সাজসরঞ্জাম ছিল। এক ঝটকায় সেখান থেকে নতুন পাইপকাটা হ্যাক-শ রীনার গলায় চালিয়ে দেবার পর সে বুঝতে পারে কী ঘটে গিয়েছে। তাই হলঘরে গিয়ে পাগলের মতো বাকিদের গলার নলি কেটে দেয় প্রলয়। অ্যালুমিনিয়াম মোটা প্লাস্টিকের ইলেক্ট্রিক্যাল পাইপ কাটা হাত-নলি কাটতে কয়েক মূহূর্ত লেগেছে। তারপর নেগেটিভ আর ফোটো পোড়া ছাই নিয়ে গিয়ে হোমের ছাইয়ে মিশিয়ে দিয়েছে। মেঝে মুছে দিয়েছে। রীনাকে টেনে এনে হলে তৃণার পাশে রেখেছে। ঘরের রক্ত সাফ করেছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩৩: রীনাকে নিয়ে পালিয়ে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বিয়ের পরিকল্পনা ছিল প্রলয়ের

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

সিন্নি মাখা গামলা ধুয়েছে। সিন্নির খালি বাটি গুছিয়ে নিয়েছে। হ্যাক-শ থেকে রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ করেছে। হল ঘরের মেঝে ঘরের মেঝে দরজার হ্যান্ডেল সাবান জল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছেছে। মুখ হাত পা ধুয়ে হঠাৎ কি মনে হতে রহস্যগল্পের ধারায় তদন্তকে বিভ্রান্ত করতে আলমারি দুটোর দরজা লোহার ছেনি দিয়ে ভেঙ্গে খুলেছে। লকার ভেঙ্গেছে। কিন্তু কিচ্ছু নেয়নি। নিজের ব্যাগটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে যাবার সময় কানের ওপরে হাত দিতে একটু চটচটে ঠেকল, কাঁচা রক্তের ড্যালা। কারও একটা হবে! কিন্তু ওপরে গিয়ে ধুতে গেলে আবার পায়ের ছাপ পড়বে। পায়ে প্লাস্টিকের ঠোঙ্গা বেঁধে সিঁড়িটা টপকে গেল। হাতের চটচটে আঙ্গুল সিঁড়ির কাঠের হাতলে ঘষে দিল, তাতে একটু সিঁড়ির জমা ধুলো ঘষে দিল। কল্যাণ ভট্টাচার্য যাবার পর বাইরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধই ছিল। একতলার বাথরুমের পিছনের খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সেই দরজায় অটোমেটিক ল্যাচকি লাগিয়েছিলেন ঘোষবাবু। বাগড়ি মার্কেট থেকে প্রলয় এনে লাগিয়ে ছিল। একবার ভিতর থেকে খুলে বাইরে গিয়ে টেনে দিলে দরজা বন্ধ। বাইরের দরজা দিয়ে বেরোয়নি প্রলয়। কেউ তাকে বের হতে দেখেওনি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

একটা গোটা দিন কেটে গিয়েছে পাড়ার কেউ জানতে পারেনি ঘোষ ভিলা রক্তাক্ত শ্মশান হয়ে আছে। তার মনের অনুভূতি নিয়ে রীনার তীব্র ঠাট্টা উপেক্ষা প্রলয়কে এতটুকুও ভয় পেতে দেয়নি। যত সময় গিয়েছে সে ততো বুঝতে পেরেছে যে রীনা আসলে তার কাছ থেকে ওই ছবির নেগেটিভ আর ছবিগুলো ফেরত নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিল। যে রীনাকে সে প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসতো সে আসলে তাকে ঠকিয়েছে। সে রীনাকে যোগ্য শাস্তি দিয়েছে। ব্যস। প্রলয় নিশ্চিন্ত। সব সূত্র খুঁজে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আসবে সেটা আন্দাজ করেনি প্রলয়। তাই খানিকটা বেপরোয়া হয়ে বসেছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

শ্রেয়া বাসুর মাথাগরম নিয়ে যে ডিপার্টমেন্টে কথাবার্তা হয়। সন্দেহভাজন আসামিকে জেরা করতে যাওয়ার আগে যে চক্রবর্তী সাহেব তাকে ডেকে বারবার আইন-কানুন ভালো করে মনে করিয়ে দেন। সেদিন সবাই অবাক হয়ে দেখলেন শ্রেয়ার যেন প্রলয়কে জেরা করতে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে নেই। সে বারবার বলছিল—
—রীনা মেয়েটা সাংঘাতিক কানিং। একে ইন্টালিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা বলে না। এটা মানুষ ঠকানো ধূর্ততা।

শ্রেয়ার অনুমান সত্যি হল। সত্যি মেয়েরা কমবয়সে ফেসরিডিং করতে পারে। প্রথম ১০-১৫ মিনিট একটানা শ্রেয়ার প্রশ্নের উত্তরে কোনও জবাব দেয়নি প্রলয়। দাঁতে দাঁত দিয়ে চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল।
—দেখো প্রলয় আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই?

এই একটা কথাই যেন এতক্ষণ ধরে দাঁত চেপে মুখে তালা দিয়ে থাকা প্রলয়ের ভেতরের সমস্ত বাঁধ ভেঙে দিল। সে চিৎকার করে বলে উঠল—
—দয়া করে আমাকে সাহায্য করার কথা বলবেন না। কারও সহানুভূতির দরকার নেই আমার! মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা পুরুষ মানুষকে ঠকায়। রীনা একটা মিথ্যুক। সে ঠগ। জোচ্চর। এই বলে সেহাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৯: আবার সত্যব্রত

কাচের জানলার বাইরে থেকে আমি, বড়কর্তা ভৈরব চক্রবর্তী বা ডিপার্টমেন্টের কনস্টেবল ভৈরব দত্ত অবাক হয়ে দেখলাম শ্রেয়া বাসু চোখ মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ওয়াশ রুম থেকে মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসার পর আমার মুখোমুখি হলেন শ্রেয়া।
—একটা ধূর্ত মেয়ের জন্য প্রলয়ের সারাটা জীবন এ ভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই বড্ড খারাপ লাগছে। কোনও উপায় থাকলে আমি ওকে ছেড়ে দিতাম। প্রলয়কে দেখে বারবার আমার ছোটভাইয়ের কথা মনে হচ্ছে। জুভেনাইল আওতা থেকেও বেরিয়ে এসেছে!

শ্রেয়া আবার ইন্টারোগেশন রুমে ঢুকে প্রলয়ের জবানবন্দি নিতে বসলেন। আমি শ্রেয়াকে কিছুতেই বলতে পারলাম না, নিখিল সেন হত্যারহস্যের সমাধান আজও হয়নি। কারণ আমি মৃত নিরঞ্জন দেবের স্বপ্ন সফল করতে তাঁর মেয়ে মেডিকেল কলেজের কৃতীছাত্রী সংযুক্তা দেবের কোনও ক্ষতিহতে দিইনি। ‘উইকেন্ড এসকর্টস’ সেজে সংযুক্তা নিখিল সেনের ওপর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। সাহায্যকারী ছিলেন নিখিল সেনের স্ত্রী শ্রুতি সেন। তাকেও ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ তাদের বিরুদ্ধের প্রমাণগুলো জমা করিনি।

প্রলয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। সে শ্রেয়াকে বলেছিল তার সংসারটা শেষ হয়ে যাবে। মা তো আর ব্যবসাটা চালাতে পারবে না!

শ্রেয়া কথা রেখেছিলেন। নিজের ইনফ্লুয়েনস খাটিয়ে প্রলয়ের ব্যবসাটা অন্য একজনকে বিক্রি করিয়ে একটা মোটা টাকা প্রলয়ের মাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আর এক মহিলা এনজিওতে তাঁর কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন শ্রেয়া।—চলবে।

 

পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২০/০৬/২৪ নতুন গল্প ‘অডিও ক্লিপ’

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content