রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


নৃপেন চক্রবর্তী ও ইন্দিরা গান্ধী।

বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসলেও বামফ্রন্টের পক্ষে প্রথম দিকে রাজ্য চালানো কিন্তু মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কারণ একদিকে মানুষের প্রত্যাশার চাপ এবং অপরদিকে জাতি কেন্দ্রিক রাজনীতির বিস্তৃতি। উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেমন উপজাতি যুব সমিতি, তেমনই ত্রিপুরার অনুপজাতি এলাকায় আমরা বাঙালি দলের তৎপরতা বাড়ছিল। দুই জাতি গোষ্ঠীর স্পর্শকাতর দাবি সমূহ ঘিরে দিনে দিনে রাজ্যের পরিস্হিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। অবশ্য নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন প্রথম বামফ্রন্ট সরকার শুরু থেকেই রাজ্যের কল্যাণে পরিকল্পিত ভাবে হাতে নিয়েছিল বিভিন্ন কর্মসূচি।
প্রথম বামফ্রন্ট সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি মতো রাজ্যের উপজাতিদের স্বশাসনের অধিকার সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগী হলে আমরা বাঙালি তার তীব্র বিরোধিতা করে। এ ভাবেই ত্রিপুরায় জাতি বিদ্বেষ তীব্র হতে থাকে। উপজাতিদের স্বশাসনের অধিকার সুনিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন করে রাজ্যে ৬ষ্ঠ তপশিল চালু করার জন্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে দাবি জানায়। কিন্তু কেন্দ্র তখন এই দাবি না মানায় রাজ্য বিকল্প ব্যবস্থা করে। রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে উপজাতি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠনের জন্য ১৯৭৯ সালে ত্রিপুরা বিধানসভায় একটি সরকারি বিল পাশ হয়। কিন্তু আমরা বাঙালি দল প্রবল ভাবে এর বিরোধিতা করতে থাকে। শুরু হয় তাদের মিছিল মিটিং। ত্রিপুরায় বাঙালিদের বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়বে এমন প্রচারও চলতে থাকে। আবার এর বিপরীতে উপজাতি যুব সমিতির জাতি কেন্দ্রিক রাজনীতির পারদও চড়তে থাকে তখন। সে সময় পার্শ্ববর্তী অসমের পরিস্হিতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সেখানে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৩: ত্রিপুরাতে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে ত্রিপুরায়ও। যুব সমিতিও আসামের ধাঁচে ত্রিপুরাতেও এ ধরণের আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করে। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে ত্রিপুরার তৈদুতে উপজাতি যুব সমিতির যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে আসামের ‘বিদেশী বিতাড়ন’ ধাঁচে আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর অর্থাৎ ত্রিপুরার ভারতভুক্তির দিনের পর থেকে যে সব বাঙালি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ত্রিপুরায় এসেছে তাদের বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যখন জেলা পরিষদের নির্বাচনের কাজে রাজ্য সরকার ব্যস্ত ছিল তখন যুব সমিতির এ ধরণের বিদেশী বিতাড়নের দাবি ত্রিপুরায় তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আমরা বাঙালি দলও তখন যুব সমিতির এই দাবির বিরোধিতা করে এবং প্রস্তাবিত জেলা পরিষদের বিরোধিতা করে রাজ্যে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এই সব ঘটনা প্রবাহ ত্রিপুরায় সেদিন জাতি বিদ্বেষকেই প্রকট করে তুলেছিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

বিদেশী বিতাড়নের দাবিতে উপজাতি যুব সমিতি ১৯৮০ সালের জুন মাসের শুরুতে বাজার বয়কটের ডাক দেয়। আর এই বাজার বয়কট আন্দোলন ঘিরেই ত্রিপুরায় দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠে। প্রায় সারা ত্রিপুরা তখন যেন বারুদের স্তুপে অবস্থান করছিল। লেম্বুছড়া বাজারের একটি ঘটনার মাধ্যমে সেই বারুদের স্তুপে জ্বলে উঠে দেশলাই’র কাঠি। পশ্চিম ত্রিপুরা ও দক্ষিণ ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন। বিভিন্ন এলাকা থেকে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধ্বংস আর মৃত্যুর খবরাখবর আসতে থাকে রাজধানী আগরতলায়। মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী সে সময় সরকারি কাজে রাজ্যের বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে দ্রুত তিনি আগরতলায় ফিরে আসেন। রাজ্যের সীমিত সংখ্যক পুলিশ বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবেলা দুরূহ হয়ে পড়ে। সাহায্য চাওয়া হয় আধা সামরিক বাহিনীর।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

রাজধানী আগরতলা শহরেও উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে। শহরে শান্তি সম্প্রীতির মিছিল আক্রান্ত হয়। রাজধানী আগরতলা সহ রাজ্যের দাঙ্গা কবলিত অঞ্চলে কার্ফু জারি হয়। জাতি-উপজাতি উভয় অংশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়।আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল হাজার হাজার ঘরবাড়ি। ত্রাণ শিবির সমূহে তিন লক্ষাধিক দাঙ্গাদুর্গত মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সেদিন দাঙ্গার মোকাবিলা সহ দুর্গত মানুষের ত্রাণ পুনর্বাসন ছিল বামফ্রন্ট সরকারের এক দুরূহ কাজ। আরও দুরূহ ছিল দুই জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক আস্হা ফেরানোর কাজ। নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার অবশ্য দক্ষতার সঙ্গেই সেদিন এই সব কাজ করছিল। মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তা বাহিনীকে এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, একটি বুলেটও খরচ না করে যেন শান্তি ফিরিয়ে আনা হয়। দাঙ্গার প্রথম কয়েকটি দিন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেনবাবু দিনরাত সারাক্ষণ তাঁর অফিস কক্ষেই ছিলেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?

দেশের অন্যান্য অংশের সাংবাদিকরা ত্রিপুরার ঘটনা কভার করতে এসেছিলেন সেদিন। নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনের তৎপরতায় অবশ্য দাঙ্গার আগুন কয়েকদিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। রাজ্যের সাধারণ শান্তপ্রিয় মানুষও ছিলেন উভয় গোষ্ঠীর মানুষের সম্প্রীতির পক্ষে। সবাই শান্তি সম্প্রীতির মধ্যেই বসবাস করতে চান। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পক্ষে নিঃসন্দেহে সহায়ক ছিল। যাইহোক, প্রশাসনের পক্ষে তখন বড় কাজ ছিল দুর্গতদের ত্রাণ পুনর্বাসন ও জাতি-উপজাতি উভয় অংশের মানুষের কাছে আস্হা ফেরানো।

ইন্দিরা গান্ধী।

এদিকে দাঙ্গা শুরু হবার পর থেকেই কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধীদল রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিকে মোটেই আমল দেননি তখন। হয়তো নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের ত্রাণ পুনর্বাসনের কাজে তাঁর আস্হা ছিল। ইন্দিরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, যে কাজটা নৃপেনবাবুরা করছেন তা একটা আমলা নির্ভর প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া মাত্র দেড় বছর আগে ত্রিপুরায় বামেরা ক্ষমতাসীন হয়েছে এক নজিরবিহীন নির্বাচনী সাফল্যের মাধ্যমে। এ অবস্থায় ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার অর্থ হবে ইন্দিরা নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার সম্পর্কে সারা দেশে এক নেতিবাচক সংকেত দেওয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ, ১৯৮০ সালে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্দিরা কিন্তু অনেক সতর্ক, অনেক সাবধানী!—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content