ছবি: প্রতীকী।
নহুষনন্দন যযাতি রাক্ষসগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে জরাগ্রস্ত হলেন। তাঁর ত্রুটি হল—তিনি আচার্য শুক্রাচার্যের আদেশ অমান্য করে শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানীর দাসী, রাক্ষসরাজ বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিনটি পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বিবাহিতা স্ত্রী দেবযানী, রাজা যযাতির ঔরসে দুটি পুত্রের জন্মদান করেন। দেবযানীর ক্ষোভের কারণ, শর্মিষ্ঠার পুত্রসংখ্যার আধিক্য এবং যযাতিকৃত পিতা শুক্রাচার্যের অনুরোধের অবজ্ঞা।
শুক্রাচার্য রাজা যযাতিকে বলেছিলেন, নেয়মাহ্বয়িতব্যা তে শয়নে বার্ষপার্ব্বণী “বৃষপর্ব্বার কন্যাকে শয্যায় আহ্বান করবেনা” সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন জামাতা যযাতি। রাজা যযাতি তাঁর নিজের এই আচরণের সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি সাজালেন, কোনওটাই ধোপে টিকল না। ক্রুদ্ধ শুক্রাচার্যের বিচারে ধর্মের বিরোধিতা করে যযাতি চৌর্যবৃত্তির সমতুল্য পাপ করেছেন। এর শাস্তিস্বরূপ, যৌবন হারিয়ে বার্দ্ধক্য প্রাপ্ত হলেন রাজা। অভিশাপমুক্তির উপায়—অপরের শরীরে জরা সঞ্চারিত করে আবার যৌবনলাভ। শুক্রাচার্যের অনুমোদনক্রমে স্থির হল রাজা যযাতির পাঁচপুত্রের মধ্যে যে পিতার জরা গ্রহণ করবে সে হবে পুণ্যবান, যশস্বী এবং রাজ্যাধিকারী।
রাজধানীতে ফিরেই রাজা ডেকে পাঠালেন, দেবযানীর গর্ভজাত জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে। লোলচর্ম, পলিতকেশ যযাতি শুক্রাচার্যের অভিশাপের বৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁর অতৃপ্ত কামনার কথা ব্যক্ত করলেন। জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছে পিতার অনুরোধ ত্বং যদো! প্রতিপদ্যস্ব পাপ্মানং জরয়া সহ। যৌবনেন ত্বদীয়েন চরেয়ং বিষয়ানহম্।। যদু, তুমি জরা ও পাপ গ্রহণ করো। তোমার যৌবন, আমায় বিষয়ভোগে সক্ষম করে তুলবে। তিনি অঙ্গীকার করলেন, এক হাজার বছর পরে, জরা ফিরিয়ে নিয়ে, পুত্রকে তিনি যৌবনদান করবেন। যদু আপত্তি করল। বার্দ্ধক্যের অনেক কষ্টগুলির মধ্যে অন্যতম, পানভোজনজনিত বহুকষ্ট। তস্মাজ্জরাং ন তে রাজন্! গ্রহীষ্য ইতি মে মতিঃ। তাই, হে রাজন্, আমি আপনার জরাগ্রহণে অক্ষম।
শুক্রাচার্য রাজা যযাতিকে বলেছিলেন, নেয়মাহ্বয়িতব্যা তে শয়নে বার্ষপার্ব্বণী “বৃষপর্ব্বার কন্যাকে শয্যায় আহ্বান করবেনা” সেই অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন জামাতা যযাতি। রাজা যযাতি তাঁর নিজের এই আচরণের সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি সাজালেন, কোনওটাই ধোপে টিকল না। ক্রুদ্ধ শুক্রাচার্যের বিচারে ধর্মের বিরোধিতা করে যযাতি চৌর্যবৃত্তির সমতুল্য পাপ করেছেন। এর শাস্তিস্বরূপ, যৌবন হারিয়ে বার্দ্ধক্য প্রাপ্ত হলেন রাজা। অভিশাপমুক্তির উপায়—অপরের শরীরে জরা সঞ্চারিত করে আবার যৌবনলাভ। শুক্রাচার্যের অনুমোদনক্রমে স্থির হল রাজা যযাতির পাঁচপুত্রের মধ্যে যে পিতার জরা গ্রহণ করবে সে হবে পুণ্যবান, যশস্বী এবং রাজ্যাধিকারী।
রাজধানীতে ফিরেই রাজা ডেকে পাঠালেন, দেবযানীর গর্ভজাত জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে। লোলচর্ম, পলিতকেশ যযাতি শুক্রাচার্যের অভিশাপের বৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁর অতৃপ্ত কামনার কথা ব্যক্ত করলেন। জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছে পিতার অনুরোধ ত্বং যদো! প্রতিপদ্যস্ব পাপ্মানং জরয়া সহ। যৌবনেন ত্বদীয়েন চরেয়ং বিষয়ানহম্।। যদু, তুমি জরা ও পাপ গ্রহণ করো। তোমার যৌবন, আমায় বিষয়ভোগে সক্ষম করে তুলবে। তিনি অঙ্গীকার করলেন, এক হাজার বছর পরে, জরা ফিরিয়ে নিয়ে, পুত্রকে তিনি যৌবনদান করবেন। যদু আপত্তি করল। বার্দ্ধক্যের অনেক কষ্টগুলির মধ্যে অন্যতম, পানভোজনজনিত বহুকষ্ট। তস্মাজ্জরাং ন তে রাজন্! গ্রহীষ্য ইতি মে মতিঃ। তাই, হে রাজন্, আমি আপনার জরাগ্রহণে অক্ষম।
এ ছাড়াও যদু প্রৌঢ়ত্বের নানা দোষ ব্যাখ্যা করল। বৃদ্ধ হলে দাড়িগোঁফ সাদা হবে, মন হবে আনন্দহীন। চামড়া শিথিল হয়ে, মাংস হবে লুলিত। কার্যসাধনে অক্ষমতার কারণে যুবকদের অবজ্ঞার পাত্র হবে সে। তাই জরাং নাভিকাময়ে। তাই অমন জরা আমি চাই না। যদুর অভিমত হল, পিতা তার অপর পুত্রদের মধ্যে প্রিয়তম কাউকে জরা দান করুন। রাজা যযাতি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে রাজ্যাধিকার হতে বঞ্চিত করলেন। যদুর সন্তানরা রাজ্যের অংশীদার হতে পারবে না। তস্মাদরাজ্যভাক্ তাত!প্রজা তব ভবিষ্যতি।
রাজা দ্বিতীয় পুত্র তুর্ব্বসুকে, জরাগ্রহণের অনুরোধ জানালেন। তুর্ব্বসু রাজি হলেন না। তাঁর বক্তব্য হল, ন কাময়ে জরাং তাত! কামভোগপ্রণাশিনীম। বলরূপান্তকরণীং বুদ্ধিপ্রাণপ্রণাশিনীম্।। কামেচ্ছাবিনাশকারিণী জরা আমি চাই না। শক্তি ও সৌন্দর্যহরণকারিণী জরা, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দান করে যে প্রাণরূপ অধ্যবসায়, সেটিও নাশ করে। প্রত্যাখ্যাত, ক্রুদ্ধ যযাতি অভিশাপ দিলেন, যত্ত্বং মে হৃদয়াজ্জাতো বয়ঃ স্বং ন প্রযচ্ছসি। তস্মাৎ প্রজা সমুচ্ছেদং তুর্ব্বসো! তব যাস্যতি।। তুমি আমার হৃদয় হতে জাত হয়েও, তোমার বয়স আমাকে দিলেনা তাই তোমার বংশলোপ পাবে।
রাজা দ্বিতীয় পুত্র তুর্ব্বসুকে, জরাগ্রহণের অনুরোধ জানালেন। তুর্ব্বসু রাজি হলেন না। তাঁর বক্তব্য হল, ন কাময়ে জরাং তাত! কামভোগপ্রণাশিনীম। বলরূপান্তকরণীং বুদ্ধিপ্রাণপ্রণাশিনীম্।। কামেচ্ছাবিনাশকারিণী জরা আমি চাই না। শক্তি ও সৌন্দর্যহরণকারিণী জরা, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দান করে যে প্রাণরূপ অধ্যবসায়, সেটিও নাশ করে। প্রত্যাখ্যাত, ক্রুদ্ধ যযাতি অভিশাপ দিলেন, যত্ত্বং মে হৃদয়াজ্জাতো বয়ঃ স্বং ন প্রযচ্ছসি। তস্মাৎ প্রজা সমুচ্ছেদং তুর্ব্বসো! তব যাস্যতি।। তুমি আমার হৃদয় হতে জাত হয়েও, তোমার বয়স আমাকে দিলেনা তাই তোমার বংশলোপ পাবে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল
রাজা যযাতি আরও বললেন,বর্ণাশ্রমধর্মরহিত, প্রতিলোমজাত সঙ্কর, কাঁচা মাংসভোজী অন্ত্যজজাতির রাজা হবে সে। তুর্ব্বসুর প্রজারা হবেন, নীচ প্রাণীগামী, পশুসম পাপে লিপ্ত, ম্লেচ্ছগণ। যদু ও তুর্ব্বসু শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানীর গর্ভজাত। রাক্ষসরাজ বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার পুত্রদের পালা এ বার। রাজ যযাতি, শর্মিষ্ঠাপুত্র দ্রুহ্যুকে, বর্ণরূপবিনাশিনী জরার মর্মান্তিক অব্যর্থ পরিণতি মনে করিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে জরার বিনিময়ে দ্রুহ্যুর যৌবন কামনা করলেন। এই যৌবনকাল উপভোগের সময় হাজার বছর এবং সেই প্রদত্ত সময়, বর্ষসহস্র পরে ফেরতযোগ্য —এ কথাও জানালেন। দ্রুহ্যুর আপত্তি হল, জরাজীর্ণ প্রৌঢ় ব্যক্তি রথ, হাতি, ঘোড়ায় আরোহণে অক্ষম। স্ত্রীসম্ভোগ উপভোগের ক্ষমতাও তাঁর নেই। তাঁর বাগভঙ্গীও বিকৃত। তাই সেই জরা আমি চাই না। তাং জরাং নাভিকাময়ে। পিতার রোষহেতু দ্রুহ্যু অভিশাপগ্রস্ত হলেন। পিতার অভিলাষ পূরণ না করায় দ্রুহ্যুর মনোবাসনা কখনও পূর্ণ হবে না। যযাতির অভিশাপে, মানুষের বহনযোগ্য ঘোড়া, রথ, প্রভৃতি চলাচলের অযোগ্য যে দেশ, যেখানে শুধুমাত্র ভেলা ও ডিঙ্গীনৌকার সাহায্যে যাতায়াত সম্ভব, এমন দেশের রাজা হবে দ্রুহ্যু। রাজা উপাধি নয়, তার উপাধি হবে ‘ভোজ’।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
শর্মিষ্ঠার দ্বিতীয় পুত্র অনুর কাছেও একই প্রস্তাব রাখলেন যযাতি। জরাগ্রহণের বিপক্ষে অনুর যুক্তি হল,জরায় আক্রান্ত ব্যক্তি, সময়জ্ঞান হারিয়ে, শিশুবৎ অসময়ে অশুচিবৎ অন্নগ্রহণ করে থাকেন। তাঁরা যথাসময়ে অগ্নিতে হোম পর্যন্ত করেন না। তাই সেই জরাগ্রহণকরায় সম্মতি নেই আমার। তাং জরাং নাভিকাময়ে। রুষ্ট পিতা অভিশাপ দিলেন, জরাদোষস্ত্বয়া প্রোক্তস্তস্মাত্ত্বং প্রতিলপ্স্যসে। যে জরার দোষ তুমি বলেছ সেই জরাগ্রস্ত হও তুমি। আরও কঠোর অভিশাপবাণী উচ্চারণ করলেন যযাতি। ওহে অনু, যৌবনে উপনীত হয়ে তোমার সন্তানের মৃত্যু হবে। তুমি হবে বেদ ও ধর্মশাস্ত্রোক্ত বিধান অনুসারে অগ্নিসাধ্যকর্মহীন। প্রজাশ্চ যৌবনপ্রাপ্তা বিনশিষ্যন্ত্যনো! তব। অগ্নিপ্রস্কন্দনপরস্ত্বঞ্চাপ্যেবং ভবিষ্যতি।।
নহুষপুত্র যযাতির শেষ আশ্রয় কনিষ্ঠ পুত্র পূরু। সে নিশ্চয়ই পিতার অনুরোধ অগ্রাহ্য করবে না, এই মনে করে পূরুর কাছে গেলেন রাজা। প্রথমেই ঘোষণা করলেন, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলে সেই হবে পুত্রদের মধ্যে প্রধান। জরাগ্রস্ত যযাতি জানালেন, শুক্রাচার্যের অভিশাপে তাঁর যৌবনের সম্ভোগবাসনা অতৃপ্ত রয়ে গিয়েছে। তাঁর সেই একই অনুরোধ, পূরো! ত্বং প্রতিপদ্যস্ব পাপ্মানং জরয়া সহ। তুমি আমার পাপসহ জরা গ্রহণ কর। কঞ্চিৎ কালং চরেয়ং বৈ বিষয়ান্ বয়সা তব। কিছুকাল তোমার যৌবনকাল দিয়ে বিষয়োপভোগে করি। শর্তগুলোও জানিয়ে দিলেন। রাজা যযাতি, হাজার বছর পরে,পূরুর হৃতযৌবন ফিরিয়ে দেবেন। দ্বিধাহীন পূরু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, যদাত্থ মাং মহারাজ! তৎ করিষ্যামি তে বচঃ। মহারাজ, আপনি যেমন বললেন তেমনই হবে। আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করব। গৃহাণ যৌবনং মত্তশ্চর কামান্ যথেপ্সিতান্। গ্রহণ করুন আমার যৌবন, যথেচ্ছভাবে কামনা পূরণ করুন আপনি।
নহুষপুত্র যযাতির শেষ আশ্রয় কনিষ্ঠ পুত্র পূরু। সে নিশ্চয়ই পিতার অনুরোধ অগ্রাহ্য করবে না, এই মনে করে পূরুর কাছে গেলেন রাজা। প্রথমেই ঘোষণা করলেন, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলে সেই হবে পুত্রদের মধ্যে প্রধান। জরাগ্রস্ত যযাতি জানালেন, শুক্রাচার্যের অভিশাপে তাঁর যৌবনের সম্ভোগবাসনা অতৃপ্ত রয়ে গিয়েছে। তাঁর সেই একই অনুরোধ, পূরো! ত্বং প্রতিপদ্যস্ব পাপ্মানং জরয়া সহ। তুমি আমার পাপসহ জরা গ্রহণ কর। কঞ্চিৎ কালং চরেয়ং বৈ বিষয়ান্ বয়সা তব। কিছুকাল তোমার যৌবনকাল দিয়ে বিষয়োপভোগে করি। শর্তগুলোও জানিয়ে দিলেন। রাজা যযাতি, হাজার বছর পরে,পূরুর হৃতযৌবন ফিরিয়ে দেবেন। দ্বিধাহীন পূরু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, যদাত্থ মাং মহারাজ! তৎ করিষ্যামি তে বচঃ। মহারাজ, আপনি যেমন বললেন তেমনই হবে। আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করব। গৃহাণ যৌবনং মত্তশ্চর কামান্ যথেপ্সিতান্। গ্রহণ করুন আমার যৌবন, যথেচ্ছভাবে কামনা পূরণ করুন আপনি।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
পূরু কথা দিলেন পিতাকে, জরয়াহং প্রতিচ্ছন্নো বয়োরূপধরস্তব। যৌবনং ভবতে দত্ত্বা চরিষ্যামি যথাত্থ মাম্।। আপনাকে যৌবন দান করে, আপনার জরা শরীরে ধারণ করে, বয়সোচিত রূপে আমি আপনার কথানুসারেই ঘুরে বেড়াব। সন্তুষ্ট হলেন পিতা যযাতি। পুত্র পূরুকে বর দিলেন তিনি। সর্বকামসমৃদ্ধা তে প্রজা রাজ্যে ভবিষ্যতি। তোমার রাজ্যে প্রজাদের সব কামনা পূর্ণ হবে। তার ফলে, তারা সমৃদ্ধি লাভ করবে। যযাতি মনে মনে শুক্রাচার্যকে স্মরণ করে মহান পূরুর দেহে জরা সঞ্চারিত করলেন। পরমানন্দে রাজা যযাতি বিষয় ভোগে প্রবৃত্ত হলেন। যযাতির ধর্মসঙ্গত বিষয়সম্ভোগে ছিল, ইচ্ছা এবং উৎসাহ। কর্তব্যপালনে তাঁর কোন বিরাম নেই। যজ্ঞ করে দেবতাদের, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে পিতৃপুরুষদের এবং দরিদ্রদের অনুগ্রহদানে, ঈপ্সিত ধনদান করে ব্রাহ্মণদের, তৃপ্ত করলেন। অন্ন ও পানীয় দিয়ে অতিথিদের সেবা করে, বৈশ্যদের প্রতিপালনের মাধ্যমে, দয়া দিয়ে শূদ্রদের, ন্যায়দণ্ড দান করে ধর্মানুসারে প্রজাদের মনোরঞ্জন করে, সাক্ষাৎ ইন্দ্রের মতো প্রজাপালন করতে লাগলেন। ধর্মের বিরোধিতা করে নয়, সিংহবিক্রমে, পরম সুখে, বিষয় উপভোগে রত হলেন যুবক রাজা যযাতি। রাজার এই সুখানুভবেও ছিল বিষণ্ণতাবোধ। স সম্প্রাপ্য শুভান্ কামাংস্তৃপ্তঃ খিন্নশ্চ পার্থিবঃ। হয়তো জরাগ্রস্ত পুত্র পূরুই ছিলেন এর কারণ।
কেটে গেল হাজার বছর। কাল বিষয়ে অভিজ্ঞ, রাজর্ষি যযাতি হিসেব করে চলেছেন তাঁর নির্ধারিত যৌবনের সময় —শেষসীমা, কাল, মুহূর্ত পর্যন্ত। শেষে স্বর্গের অপ্সরা বিশ্বাচীর সঙ্গে নন্দনবনে, অলকাপুরীতে, উত্তর মেরুশিখরের শোভা হয়ে, ভ্রমণ করে বেড়ালেন। গুণে দেখলেন, সময় শেষ হয়েছে। পুত্র পূরুর কাছে স্বীকার করলেন, পুত্রের যৌবন গ্রহণ করে যথেষ্ট উৎসাহে, যথেচ্ছভাবে যৌবনকাল উপভোগ করেছেন। এত সব কামনা উপভোগ করেও কামনা কিন্তু প্রশমিত হয় না। বরং বৃদ্ধি পায়। আগুনে ঘি ঢাললে যেমন আগুন বেড়েই চলে, ঠিক সেইরকম। পৃথিবীর যত ধান, যব, সোনা, পশু, নারী এ সব কিন্তু একজনের ভোগেচ্ছা নিবৃত্তির জন্যে পর্যাপ্ত নয়। তাই এই তৃষ্ণা পরিত্যাগ করা উচিত। দুর্বুদ্ধিযুক্ত মানুষের কামপিপাসা ত্যাগ করা দুষ্কর তাই কামনা পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। জরাজীর্ণ মানুষের কাম জীর্ণ হয় না। প্রাণঘাতী অসুখ এই ভোগেচ্ছা, সেটি সর্বদা বর্জন করাতেই আছে সুখ।
কেটে গেল হাজার বছর। কাল বিষয়ে অভিজ্ঞ, রাজর্ষি যযাতি হিসেব করে চলেছেন তাঁর নির্ধারিত যৌবনের সময় —শেষসীমা, কাল, মুহূর্ত পর্যন্ত। শেষে স্বর্গের অপ্সরা বিশ্বাচীর সঙ্গে নন্দনবনে, অলকাপুরীতে, উত্তর মেরুশিখরের শোভা হয়ে, ভ্রমণ করে বেড়ালেন। গুণে দেখলেন, সময় শেষ হয়েছে। পুত্র পূরুর কাছে স্বীকার করলেন, পুত্রের যৌবন গ্রহণ করে যথেষ্ট উৎসাহে, যথেচ্ছভাবে যৌবনকাল উপভোগ করেছেন। এত সব কামনা উপভোগ করেও কামনা কিন্তু প্রশমিত হয় না। বরং বৃদ্ধি পায়। আগুনে ঘি ঢাললে যেমন আগুন বেড়েই চলে, ঠিক সেইরকম। পৃথিবীর যত ধান, যব, সোনা, পশু, নারী এ সব কিন্তু একজনের ভোগেচ্ছা নিবৃত্তির জন্যে পর্যাপ্ত নয়। তাই এই তৃষ্ণা পরিত্যাগ করা উচিত। দুর্বুদ্ধিযুক্ত মানুষের কামপিপাসা ত্যাগ করা দুষ্কর তাই কামনা পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। জরাজীর্ণ মানুষের কাম জীর্ণ হয় না। প্রাণঘাতী অসুখ এই ভোগেচ্ছা, সেটি সর্বদা বর্জন করাতেই আছে সুখ।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?
রাজা যযাতি অকপটে স্বীকার করলেন, বিষয়াসক্তিতে ডুবে থেকে হাজার বছর কেটে গেল তথাপ্যনুদিনং তৃষ্ণা মমৈতেষ্বভিজায়তে। তথাপি প্রতিদিন আমার কামোপভোগের লিপ্সা বেড়েই চলেছে। তাই রাজা মনস্থ করেছেন, বিষয়তৃষ্ণা বর্জন করে পরমাত্মার ধ্যানে নিবিষ্টচিত্তে শীতগ্রীষ্মে ভাবলেশহীন দ্বন্দ্বশূন্য হয়ে, পুত্রাদি পিছুটানের প্রতি মমত্ব না রেখে, হরিণের মতো মুক্ত জীবন যাপন করবেন। রাজা যযাতি, খুশি হয়ে, প্রিয়পুত্র পূরুকে ফিরিয়ে দিলেন যৌবন। প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাকে রাজ্য গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। পূরো! প্রীতোঽস্মি ভদ্রং তে গৃহাণেদং স্বযৌবনম্। রাজ্যঞ্চেদং গৃহাণ ত্বং ত্বং হি মে প্রিয়কৃৎ সুতঃ।। জরা গ্রহণ করলেন যযাতি,ধৈর্যশীল পুরু ফিরে পেলেন যৌবন।
পূরুর রাজ্যাভিষেকের আয়োজন শুরু হল। প্রথমেই বাধা। ব্রাহ্মণেরা আপত্তি জানালেন। রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র যদু, যিনি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর পুত্র অর্থাৎ শুক্রাচার্যের দৌহিত্র তিনি। সে থাকতে, শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু রাজা হবেন কেন? ক্রমানুযায়ী তার স্থান,সবথেকে নীচে যে। কথং জ্যেষ্ঠানতিক্রম্য কনীয়ান্ রাজ্যমর্হতি। জ্যেষ্ঠদের অতিক্রম করে,কনিষ্ঠ, রাজপদের যোগ্য হয় কী করে?ব্রাহ্মণদের আবেদন—রাজা ধর্মসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। রাজা ব্যাখ্যা করলেন, কেন তিনি জ্যেষ্ঠকে রাজ্য দিতে পারেননি। যে পুত্র পিতার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, সজ্জনদের মতে সে পুত্রই নয়। প্রতিকূলঃ পিতুর্যশ্চ ন স পুত্রঃ সতাং মতঃ। শুধু যদু নয়, যথাক্রমে তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু, অনু এই চারপুত্রই পিতার আদেশ অবজ্ঞা করেছে।
যযাতির মতে, যে পুত্র মাতাপিতার বচনানুসারে চলে, তাঁদের মঙ্গল কামনা করে এবং মাতাপিতার সপক্ষে থেকে পুত্রবৎ যার আচরণ সে-ই প্রকৃত পুত্র। পূরু পিতার আদেশ পালন করেছে, সে পিতার জরা ধারণ করে পিতাকে সম্মানিত করেছে। তাই কনিষ্ঠ পূরুই, রাজার যোগ্য উত্তরাধিকারী। বন্ধু হয়ে সে যযতির কামেচ্ছা পূরণ করেছে। আচার্য শুক্রের বরদান সার্থক হল। বরটি ছিল পুত্রো যস্ত্বানুবর্ত্তেত স রাজা পৃথিবীপতিঃ। পিতার আদর্শ অনুসরণ করে যে পুত্র, সে-ই হবে পৃথিবীর অধীশ্বর। রাজা যযাতি, ব্রাহ্মণদের অনুমোদন প্রার্থনা করলেন। আপনাদের অনুনয় করছি, আপনারা পূরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন। ভবতোঽনুনয়াম্যেবং পূরু রাজ্যেঽভিষিচ্যতাম্।
পূরুর রাজ্যাভিষেকের আয়োজন শুরু হল। প্রথমেই বাধা। ব্রাহ্মণেরা আপত্তি জানালেন। রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র যদু, যিনি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর পুত্র অর্থাৎ শুক্রাচার্যের দৌহিত্র তিনি। সে থাকতে, শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু রাজা হবেন কেন? ক্রমানুযায়ী তার স্থান,সবথেকে নীচে যে। কথং জ্যেষ্ঠানতিক্রম্য কনীয়ান্ রাজ্যমর্হতি। জ্যেষ্ঠদের অতিক্রম করে,কনিষ্ঠ, রাজপদের যোগ্য হয় কী করে?ব্রাহ্মণদের আবেদন—রাজা ধর্মসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। রাজা ব্যাখ্যা করলেন, কেন তিনি জ্যেষ্ঠকে রাজ্য দিতে পারেননি। যে পুত্র পিতার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, সজ্জনদের মতে সে পুত্রই নয়। প্রতিকূলঃ পিতুর্যশ্চ ন স পুত্রঃ সতাং মতঃ। শুধু যদু নয়, যথাক্রমে তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু, অনু এই চারপুত্রই পিতার আদেশ অবজ্ঞা করেছে।
যযাতির মতে, যে পুত্র মাতাপিতার বচনানুসারে চলে, তাঁদের মঙ্গল কামনা করে এবং মাতাপিতার সপক্ষে থেকে পুত্রবৎ যার আচরণ সে-ই প্রকৃত পুত্র। পূরু পিতার আদেশ পালন করেছে, সে পিতার জরা ধারণ করে পিতাকে সম্মানিত করেছে। তাই কনিষ্ঠ পূরুই, রাজার যোগ্য উত্তরাধিকারী। বন্ধু হয়ে সে যযতির কামেচ্ছা পূরণ করেছে। আচার্য শুক্রের বরদান সার্থক হল। বরটি ছিল পুত্রো যস্ত্বানুবর্ত্তেত স রাজা পৃথিবীপতিঃ। পিতার আদর্শ অনুসরণ করে যে পুত্র, সে-ই হবে পৃথিবীর অধীশ্বর। রাজা যযাতি, ব্রাহ্মণদের অনুমোদন প্রার্থনা করলেন। আপনাদের অনুনয় করছি, আপনারা পূরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন। ভবতোঽনুনয়াম্যেবং পূরু রাজ্যেঽভিষিচ্যতাম্।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৭: মুখোমুখি প্রথমবার /২
রাজার প্রস্তাব সমর্থন করলেন প্রজারা। যে পুত্র গুণবান এবং সর্বদাই মাতাপিতার হিতাকাঙ্খী, সে কনিষ্ঠ হয়েও জ্যেষ্ঠবৎ উত্তম। সবকিছুর যোগ্য, সে। তাই কল্যাণকামী পুত্র পূরুই এই রাজ্যের যোগ্য রাজা। আর বরদাতা শুক্রাচার্যের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারে না। পুরবাসী ও জনপদবাসীদের অকুণ্ঠ সমর্থনে রাজা যযাতি, পুত্র পূরুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তিনি পূরুকে রাজ্য দান করে বনবাসী হলেন।
জ্যেষ্ঠ যদু হতে উৎপত্তি হল যাদবদের,তুর্ব্বসুর বংশধরেরা হল যবন, দ্রুহ্যুর পুত্ররা হল ভোজবংশীয়, অনু হতে ম্লেচ্ছদের উদ্ভব হল। পূরুর বংশধরেরা হল পৌরববংশীয়, যে বংশ, রাজা কুরুর নামানুসারে কুরুবংশ নামেও খ্যাত হয়েছিল।
রাজা যযাতির কামনার তৃষ্ণা দৃষ্টান্তমূলক। শুক্রাচার্যের অভিশাপের ফলে জরাগ্রস্ত হয়ে হারানো যৌবনের পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টায় তিনি সন্তানদের দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি পুত্রদের সামনে টোপ রেখেছেন রাজ্যকে। যদিও কনিষ্ঠ পূরুর প্রদত্ত যৌবন উপভোগ করে, বাধ্য অনুগত পুত্রের ভূয়সী প্রশংসায় সোচ্চার হয়েছেন। সকৃতজ্ঞচিত্তে পূরুর রাজ্যপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন, যা পূরুর প্রতি কৃতজ্ঞ পিতার শ্রদ্ধা ও স্নেহের বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে।
রাজা যযাতি তাঁর অতৃপ্ত কামনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন যৌবনে উপনীত পুত্রদের সেরা সময়ের বিনিময়ে। এ কেমন পিতৃত্ব? পরিণত বয়স্ক প্রৌঢ় যদি শুধুমাত্র নিজের কাম চরিতার্থ করবার বাসনায় জীবন উপভোগ করতে চায় তাও আবার নিজের সন্তানের যৌবনের বিনিময়ে তবে তার পিতৃত্ব প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখে দাঁড়ায়। যৌবন বড় অস্থির চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী। সেই স্বল্পস্থায়ী যৌবনে আসে কামনার ঝড়, যা উড়িয়ে নিয়ে যায় বিবেকচেতনা, সুস্থচিন্তা, নীতিবোধ সবকিছু। যৌবন বড় বেসামাল, বেহিসেবী। যৌবন হারিয়ে যযাতি হয়েছেন দিশাহারা। তাঁর উত্তরসূরী পূরু সেই যৌবনকে অক্লেশে দান করলেন পিতাকে। পারেননি যদু, তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু, অনুরা। তারা জরার নানা দোষ আবিষ্কার করেছে। পিতার আদেশ অমান্য করে তারা সজ্জনসম্মত যথার্থ পুত্র হতে পারেননি। পিতার প্রতি আনুগত্য নিঃসন্দেহে কাম্য। পরিবারকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজজীবনের ঐতিহ্যপূর্ণ উজ্জ্বল দিক হল মাতাপিতার প্রতি পুত্রের দায়বদ্ধতাপালন।কিন্তু স্বেচ্ছাচারী পিতার ইচ্ছাপূরণ কী সর্বদাই কাম্য? আধুনিক ভরতবংশীয়দের মধ্যে পূরুর পিতার প্রতি আনুগত্য যেমন দৃষ্টান্তভূলক তেমনই পিতা যযাতির আকণ্ঠ যৌবনোপভোগের বাসনানিবৃত্তি কী সন্তানের কর্তব্য?এ বিষয়েও নিশ্চয়ই সংশয় থেকে যায়।
জ্যেষ্ঠ যদু হতে উৎপত্তি হল যাদবদের,তুর্ব্বসুর বংশধরেরা হল যবন, দ্রুহ্যুর পুত্ররা হল ভোজবংশীয়, অনু হতে ম্লেচ্ছদের উদ্ভব হল। পূরুর বংশধরেরা হল পৌরববংশীয়, যে বংশ, রাজা কুরুর নামানুসারে কুরুবংশ নামেও খ্যাত হয়েছিল।
রাজা যযাতির কামনার তৃষ্ণা দৃষ্টান্তমূলক। শুক্রাচার্যের অভিশাপের ফলে জরাগ্রস্ত হয়ে হারানো যৌবনের পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টায় তিনি সন্তানদের দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি পুত্রদের সামনে টোপ রেখেছেন রাজ্যকে। যদিও কনিষ্ঠ পূরুর প্রদত্ত যৌবন উপভোগ করে, বাধ্য অনুগত পুত্রের ভূয়সী প্রশংসায় সোচ্চার হয়েছেন। সকৃতজ্ঞচিত্তে পূরুর রাজ্যপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন, যা পূরুর প্রতি কৃতজ্ঞ পিতার শ্রদ্ধা ও স্নেহের বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে।
রাজা যযাতি তাঁর অতৃপ্ত কামনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন যৌবনে উপনীত পুত্রদের সেরা সময়ের বিনিময়ে। এ কেমন পিতৃত্ব? পরিণত বয়স্ক প্রৌঢ় যদি শুধুমাত্র নিজের কাম চরিতার্থ করবার বাসনায় জীবন উপভোগ করতে চায় তাও আবার নিজের সন্তানের যৌবনের বিনিময়ে তবে তার পিতৃত্ব প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখে দাঁড়ায়। যৌবন বড় অস্থির চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী। সেই স্বল্পস্থায়ী যৌবনে আসে কামনার ঝড়, যা উড়িয়ে নিয়ে যায় বিবেকচেতনা, সুস্থচিন্তা, নীতিবোধ সবকিছু। যৌবন বড় বেসামাল, বেহিসেবী। যৌবন হারিয়ে যযাতি হয়েছেন দিশাহারা। তাঁর উত্তরসূরী পূরু সেই যৌবনকে অক্লেশে দান করলেন পিতাকে। পারেননি যদু, তুর্ব্বসু, দ্রুহ্যু, অনুরা। তারা জরার নানা দোষ আবিষ্কার করেছে। পিতার আদেশ অমান্য করে তারা সজ্জনসম্মত যথার্থ পুত্র হতে পারেননি। পিতার প্রতি আনুগত্য নিঃসন্দেহে কাম্য। পরিবারকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজজীবনের ঐতিহ্যপূর্ণ উজ্জ্বল দিক হল মাতাপিতার প্রতি পুত্রের দায়বদ্ধতাপালন।কিন্তু স্বেচ্ছাচারী পিতার ইচ্ছাপূরণ কী সর্বদাই কাম্য? আধুনিক ভরতবংশীয়দের মধ্যে পূরুর পিতার প্রতি আনুগত্য যেমন দৃষ্টান্তভূলক তেমনই পিতা যযাতির আকণ্ঠ যৌবনোপভোগের বাসনানিবৃত্তি কী সন্তানের কর্তব্য?এ বিষয়েও নিশ্চয়ই সংশয় থেকে যায়।
ছবি: প্রতীকী।
রাজার বিরুদ্ধে দেবযানীর অভিযোগ ছিল সন্তানবিষয়ে শর্মিষ্ঠা তাঁকে অতিক্রম করেছেন। শুধু সেটাই নয়। দেবযানীর মধ্যে ছিল উচ্চবর্ণজাত ব্রাহ্মণকন্যার উন্নাসিকতা। শর্মিষ্ঠার বিষয়ে পিতার কাছে তাঁর প্রথম অনুযোগ ছিল, অধর্মেন জিতো ধর্মো প্রবৃত্তমধরোত্তরম্। অধর্ম পরাজিত করেছে ধর্মকে। অধম, উত্তমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকন্যার দম্ভ,উন্নাসিকতা ধূলিসাৎ হয়েছে যখন রাক্ষস বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার পুত্র পূরু নিজের বিনয় ও ঔদার্যগুণে রাজ্যাধিকারী হয়েছেন। পূরুর রাজ্যলাভে দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার প্রতিক্রিয়া মহাভারতকার বর্ণনা করেননি।
যাদব, যবন, ভোজ,ম্লেচ্ছ একযোগে যযাতির বংশধারার অচ্ছেদ্য অংশ হল, পূরুর বংশধররা হল পৌরব। এক মহামিলনক্ষেত্র হয়ে উঠল মহাভারত। মহাভারতকার বলেছেন, যদোস্তু যাদবা জাতাস্তুর্বসোর্যবনাঃ স্মৃতাঃ। দ্রুহ্যোঃ সুতাস্তু বৈ ভোজা অনোস্তু ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।। যবন, ম্লেচ্ছ একযোগে মিশে আছে কুরুবংশধারায়। প্রত্যেকেই যযাতির বংশগতির অপরিহার্য অংশ। মহাভারতের অন্তরাত্মার বিনির্মাণে আছে সকল মানুষের অন্তর্নিবেশ। মহাভারতের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে, অভিশাপের ফলে উদ্ভব হয়েছে নানা জাতির। বিবিধের মাঝে এক মহান মিলনসঙ্গমস্থল হয়ে উঠেছে মহাভারত। কবির ভাষায়, হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনতশিরে—এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।—চলবে।
যাদব, যবন, ভোজ,ম্লেচ্ছ একযোগে যযাতির বংশধারার অচ্ছেদ্য অংশ হল, পূরুর বংশধররা হল পৌরব। এক মহামিলনক্ষেত্র হয়ে উঠল মহাভারত। মহাভারতকার বলেছেন, যদোস্তু যাদবা জাতাস্তুর্বসোর্যবনাঃ স্মৃতাঃ। দ্রুহ্যোঃ সুতাস্তু বৈ ভোজা অনোস্তু ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।। যবন, ম্লেচ্ছ একযোগে মিশে আছে কুরুবংশধারায়। প্রত্যেকেই যযাতির বংশগতির অপরিহার্য অংশ। মহাভারতের অন্তরাত্মার বিনির্মাণে আছে সকল মানুষের অন্তর্নিবেশ। মহাভারতের মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে, অভিশাপের ফলে উদ্ভব হয়েছে নানা জাতির। বিবিধের মাঝে এক মহান মিলনসঙ্গমস্থল হয়ে উঠেছে মহাভারত। কবির ভাষায়, হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনতশিরে—এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।