শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) নবনীত সিকেরা। মোহিত রায়না (ডান দিকে)।

 

ভাউকাল: সিজন-১ এবং সিজন-২

ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: অ্যাপ্লস এন্টারটেইনমেন্ট, বাওয়েজা মুভিজ
কাহিনি-চিত্রনাট্য-সংলাপ: আকাশ মোহিমেন, জয়শীলা বনশল, রোহিত চৌহান
পরিচালনা: যতীন ওয়াগলে
অভিনয়: মোহিত রায়না, অভিমন্যু সিং, সিদ্ধার্থ কাপুর, বিদিতা বাগ, গুলকি যোশি, রবি পাণ্ডে, রেশমি রাজপুত, প্রদীপ নাগর প্রমুখ
ওটিটি রিলিজ: এমএক্স প্লেয়ার
পর্ব: সিজন ১ (১০), সিজন ২ (১০)
রেটিং: ৭.৫/১০

ভাউকাল শব্দটা আমাদের অজানা। আমাদের স্বল্প হিন্দিজ্ঞানে এই শব্দের ব্যবহার তেমন শুনিনি। ভাউকাল উত্তরপ্রদেশ বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের বারাণসী, এলাহাবাদ এবং আশপাশের এলাকার কথ্য হিন্দিতে চালু শব্দ। ভাউকাল মানে জোশ, ক্ষমতা বা দম। আবার ভাউকাল মানে ঘমন্ড বা অকারণ আস্ফালন। এই সিরিজের দুটি সিজন—১০টি করে ২০টি এপিসোড।

সিরিজের মূলচরিত্র নবনীত সিকেরা আইপিএস। যাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে দুই সিজনের এই সিরিজ। নবনীত সিকেরা ১৯৯৬ ব্যাচের উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের আইপিএস। এই মুহূর্তে নবনীত সিকেরা উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল। উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদ জেলার শিকোহাবাদ টাউনে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে নবনীতের জন্ম। সরকারি স্কুলে পড়াশোনা। আইআইটি রুরকি থেকে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এরপর ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেস থেকে এমবিএ। ১৯৯৬ সালে আইপিএস।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: লাপাতা লেডিজ—সহজ কমেডির ভাষায় গভীর জীবনবোধের কথা বলে

জিৎ সত্রাগ্নি’র গল্পে এবার জিৎ-রুক্মিণীর ছবি ‘বুমেরাং’

প্রকৃত নায়ক নবনীত সিকেরার অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ পদে প্রথম পোস্টিং হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের ভয়ংকর অপরাধপ্রবণ জেলা গোরখপুরে। পরে সেখানেই তিনি সুপারেনটেনডেন্ট অফ পুলিশ হন। ২০১২ সালে নবনীত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ হলেন। ২০১৪-এ ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ উত্তরপ্রদেশ।

পর্দায় নবনীত হয়েছেন নবীন। অসাধারণ অভিনয় করেছেন মোহিত রায়না। সিরিজে মোহিতের স্ত্রী এবং বাবার নামে কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। পূজা সিকেরার ভূমিকায় রেশমি রাজপুত যথাযথ। তবে নবীনকে সম্ভবত আইনি জটিলতা এড়াতে স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ করা হয়েছে আর জেলা বদলে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

ভোটস্য পরিবেদনা

উত্তরপ্রদেশে একসময় গুন্ডারাজ চলতো। বহু হিন্দি ছবিতে সেই সব রাজনৈতিক মদতপুষ্ট স্বঘোষিত ত্রাতার গুণকীর্তন করা হয়েছে। সবসময় ঘটনার থেকে দূরে থাকা বা দেরিতে পৌঁছনো, নেতা ও ত্রাতাদের চাটুকারিতায় পদ-বাঁচানো ঘুষখোর পুলিশের ভূমিকা ছিল হাস্যকর। সিনেমার কমিকরিলিফের-এর মতো। তিনি ঠিক না ভুল গণতান্ত্রিক না অগণতান্ত্রিক এ সমস্ত রাজনৈতিক বিচারের উদ্ধত্য বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। তাই সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি চোখের সামনে যেটা দেখতে পেয়েছি, তাতে লক্ষ্য করেছি উত্তরপ্রদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অপরাধ প্রবণতা কমে গিয়েছে। কেন কমেছে, কীভাবে কমে গিয়েছে? তাই নিয়েই দুই সিজনের এই সিরিজ ভাউকাল।

গুন্ডারাজের মূলঅস্ত্র ভয়। ভয় বিক্রি করে প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা, ভয় দেখিয়ে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে লুঠতরাজ খুন-রাহাজানির রাজত্ব কায়েম করা। ভয় প্রতিপত্তি বিক্রি করে নিরাপত্তার নামে বিপুল পরিমাণ তোলা আদায়, আবার সেই প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করেই রাজনৈতিক আশ্রয় অনুমোদন আদায় করা।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

কালেকালে দেশে দেশে এই একই ফর্মূলা চলছে চলবে। সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অনাচারের নিপাত যাবার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ বিশ্বাস করার মতো পরিস্থিতি বারবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তাই ভয়ের ব্যবসা রমরমিয়ে চলে।

এই সাংঘাতিক ভয়ের বাতাবরণ থেকেই গুন্ডাদলের নেতাদের ঘমন্ড বা অহংকার তৈরি হয়। তাদের বিচার করার অধিকার এ পৃথিবীর কারও নেই এটাই তাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে আঘাত করার জন্য তিনটি জিনিস লাগে। প্রথমত অন্যায় অবিচার অনাচার দূর্নীতি করতে করতে একটা সময় পাপের ঘড়া টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। টলটলে পাপ তখন ছলকে ছলকে পড়ে। একটা সময় যে অন্যায় করছে আর যারা অত্যাচারিত হচ্ছে, তারা দু-পক্ষই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এরপর আর কিছু হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, নবনীত সিকেরার মতো আত্মবিশ্বাসী, কঠিন মেরুদণ্ডের একজন প্রশাসনিক কর্তা প্রয়োজন হয়। যিনি বারবার ধাক্কা খেয়েও আবার ফিরে দাঁড়াতে জানেন আর গোটা প্রশাসনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস সততা ও নিষ্ঠার ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। যিনি প্রশাসনের মধ্যের অন্যায়কে মোকাবিলা করতে পারেন, আর সামাজিক অন্যায়কে কঠিন হাতে দমন করতে জানেন। তিনি প্রবল সাহসী, সেটা তাঁর জোশ ক্ষমতা বা ভাউকাল।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

আর শেষে যেটা একান্ত দরকার সেটা হল সাধারণ মানুষের সমর্থন, তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও আত্মবিশ্বাস। অত্যাচারী ধাক্কা খেলে প্রতি আক্রমণ করে। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে আবার বারংবার অন্যায়কে প্রতিবাদ জানানো সাধারণ মানুষই সততাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। দুটি সিজন ধরে ভাউকাল সিরিজ এটাই দেখিয়েছে। সিরিজের মূল চরিত্র নবীন এবং তার স্ত্রী পূজা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তবু হার মানেনি সিরিজের নায়ক নবীন ওরফে জীবনের নায়ক নবনীত সিকেরা। প্রশাসনিক নিয়মকানুনের বাধায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে যখনই হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়েছে নবীন, তখনই তাঁর স্ত্রী পূজা তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছেন। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলেই এমবিএ পাশ আইআইটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিশ্চিন্তে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন নবীন ওরফে নবনীত। কিন্তু এই সামাজিক অন্যায়কে নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্ব নিয়ে তিনি আইপিএস হয়েছেন। এত সহজে হার মানলে চলবে না।

হ্যাঁ, সিরিজটি একটু বেশি ভায়োলেন্ট, সাংঘাতিকভাবে রক্তাক্ত। তবে দুর্দান্ত গতিময়, উত্তেজনায় টানটান ‘ভাউকাল’ আপনার ভালো লাগবেই।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড। (Fiji)।

Skip to content