মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

নিজের উপর রাগ হচ্ছিল অরণ্যের। কেন যে আসতে গেল সে। তৃষা বুঝয়েছিল যে, মাত্র দিন তিনেকের ট্যুর। আনন্দে-ফূর্তিতে কেটে যাবে দেখতে দেখতে। এমনিতেও রবিবার জিম বন্ধ থাকে। তার সঙ্গে শুক্র আর শনিবারটা জুড়ে নিলে সব দিক ম্যানেজ হয়ে যায়। অরণ্য জিম কামাই করে না একদিনের জন্যও। অতএব এতদিন পরে নিজেরই জিম থেকে নিজে ছুটি নিলে তা ম্যানেজ করতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার উপর সে তো ভেবেইছিল, এখানে এসে নতুন নতুন রিলস বানিয়ে আপলোড করবে। তাতে ভিউয়ারস আরও বাড়লে তারই লাভ।

আজকাল তো ‘ওনলি ফ্যানস’ গোছের সাইট থেকেও ভালোই ইনকাম হয় তার। সে জানে, তার শরীর সুন্দর এবং নারী ও বিশেষ পছন্দের পুরুষ— উভয়ের কাছেই প্রার্থনীয়। আর শরীর নিয়ে যেহেতু কোনও সংস্কার নেই তার, অতএব তা প্রদর্শনেও আপত্তি নেই তার। কিন্তু কাল থেকে যা ঘটে চলেছে, তারপর আজ সকালে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হল সে, তাতে নিজের উপর রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তৃষা ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ থম মেরে বসেছিল। একবার বলছিল বটে, কাল সে পার্টি চলাকালীন কিছু একটা দেখেছে, অস্বাভাবিক কিছু, কিন্তু সেটা কী, তা মনে করতে পারছিল না। এদিক-ওদিক করছিল। তারপ মাথা ধরেছে বলে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও স্বস্তি পেল না। রিসর্টের কিচেন থেকে ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মাছ ভাজা দিয়ে গিয়েছিল রুমে রুমে। আজকের দিনটা এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব হল না বলে দুঃখপ্রকাশ সহ। কিন্তু সেটা যেমন দিয়ে গিয়েছিল, তেমনই পড়ে আছে। তৃষা বা অরণ্য কেউই দাঁতে কাটেনি কিছু। খিদে নেই দুজনেরই। খিদে পেলে এনার্জি বার আছে, খেয়ে নেবে অরণ্য। তৃষাও চাইলে খেতে পারে, কিন্তু সে এনার্জি বার পছন্দ করে না বিশেষ।
হাতের মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সে, যদিও তার চোখ মোবাইলের দিকে থাকলেও, মন মোবাইল দেখছিল না। সে ভাবছিল, ভোর রাতে আর একটু সক্রিয় হলে আচমকা এসে পড়া রহস্যটা এত জটিল বলে মনে হত না। সে এখনও ভুলতে পারছে না যে, ভোর রাতে সে শর্ট ফিল্ম মেকিং করা অজয়বাবুকে দেখেছিল। এখন জানতে পারছে, অজয়বাবুর ছদ্মবেশে থাকা মানুষটি লালবাজারের গোয়েন্দা, পাভেল নাম। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে পাভেল কেন ওই সময় বেরিয়েছিলেন? তদন্তের প্রয়োজনে কী? আর বেরুলেনই যদি, দু’দুটো খুনকে কেন আটকাতে পারলেন না? না কি, তিনি ফেরার পরেই খুনটা হয়েছিল? আততায়ী কি তবে আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছিল? এ তো শিকারী নিজেই শিকারের হাতে বেকুব বনে গেল ! মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তার।

মোবাইলে মেসেজ ঢুকল। জিমের একটি ছেলে মেসেজ করেছে। ছেলেটির নাম পলাশ, ট্রেনার। আরও তিনজন ট্রেনার আছে, সঙ্গে সে নিজে তো আছেই। কবে ফিরবে জানতে চেয়েছে সে। কবে যে ফিরতে পারবে, বলতে পারছে না সে। পলাশরা তো জানেই না যে, সে কী রকম অবস্থায় আছে! যদি জানত, তা হলে হয়তো সমবেদনা জানিয়ে মেসেজ করতো। কিন্তু শুকনো সমবেদনার চেয়ে এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন আভাস বা ইশারা পেলেও সে বেশি আশ্বস্ত হত।

সে জানাল, “আই অ্যাম স্টাক ইন এ মেস, আই কান্ট টেল ইয়্যু হোয়েন আই উইল ব্যাক। আদারওয়াইজ আই অ্যাম ফাইন!”
“মেস! হোয়াট কাইন্ড অফ মেস? মেয়ে নিয়ে কোন লাফড়া না কি?” পলাশ জানতে চাইল।
অরণ্য বুঝতে পারছিল, পলাশ ঠাট্টা বলে ভাবছে, কিংবা জেনেবুঝেই ঠাট্টা করছে। সে প্রথমে কোন রিপ্লাই দিল না। তারপর লিখল, “তৃষা হিয়ার। নো স্কোপ টু গেট আ রিল্যাক্সেশন!”
“ও হো! ব্যাড লাক!” পলাশ সমবেদনা জানানোর ছলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয় যেন।
“ও কে বস! এনজয়!” বলে পলাশ মেসেজ থামায়।
আর এনজয়! এবারের ট্রিপে এনজয় সকলের মাথায় উঠেছে। কী করবে সে? পার্ক স্ট্রিট থানার ইনচার্জ সরখেলের সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্ব আছে। তাদের মতো ব্যবসাদারদের লোকাল থানা চিনে রাখে, এদেরও চিনে রাখতে হয় লোকাল থানাকে। হপ্তা কিংবা মাসোয়ারা ঠিক পৌঁছে যায় যথাস্থানে। তারাও ফুল প্রোটেকশন দেয় অরণ্যদের মতো ছোটবড় বিজনেস-ওনারদের। সরখেলকে কি ফোন করে বলবে সে? যাতে কোন সাহায্য পাওয়া যায়। লালবাজারের এই দুই অফিসারকে নিশ্চয়ই চেনে সরখেল। না চিনলে কাউকে তো চেনে? তাঁদের কাউকে বললে, অরণ্যকে কি তিনি সাসপেক্টস তালিকা থেকে মুক্ত করতে পারবেন না?
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৪: জঙ্গল বিপদে আছে…

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু! পর্ব-২৯: ঘুমের ওষুধ কি সিন্নিতে মেশানো ছিল?

কিন্তু নাহ! ফোন করা যাবে না। পরক্ষণেই ভাবল সে। সরখেলকে ফোন করা মানে দু’দিকে বিপদ আসবে তার। রহস্যময় মার্ডার কেসে সে জড়িয়ে পড়েছে জানলে, তার জিমের ব্যবসা লাটে উঠবে। অনেকেই আসা বন্ধ করে দেবে তার জিমে। দ্বিতীয়, সরখেলকে জানানো মানে পার্ক স্ট্রিট থানাকে জানানো, সে ফিরে গেলে মাসোয়ারার পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেবে, সে-ব্যাপারে অরণ্য নিশ্চিত। অতএব থানাকে নিজের থেকে জানানো যাবে না। তবে, আর একটা দিকও ভাবছে সে। আজ সকলের এজাহার নেওয়ার পর পুলিশ নিশ্চয়ই সকলের হয়্যার অ্যাবাউটস জানতে লোকাল থানাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সেই কারণেই সকলের বাড়ির অ্যাড্রেস তারা নিয়ে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরখেল জানতেই পারবে। তখন ফিরে গেলেও থানায় ডেকে পাঠিয়ে সরখেল তাকে জবাই করার ফিকির খুঁজবে। আচ্ছা বিপদে পড়ল সে।

মাথাটা দপদপ করছিল তার। একটা শাওয়ার নিতে হবে। যদি তাতে কমে একটু। আসলে এই টেনশন নিতে পারছে না সে। মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল। “প্লিজ, শো ইয়োর আনকাভারড ফ্রন্টাল অন ডিএম।” একটা আননোন প্রোফাইল থেকে মেসেজটা ঢুকেছে। অন্য সময় হলে বাজাতো সে, তেমন কেউ হলে পাঠাতে দ্বিধা করত না। অবশ্যই নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে। আজকাল তো অনেকেই এই পথে ভালো রোজগার করছে। শো করলেই যদি টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকে যায়, তাহলে আর আপত্তি কিসের? কিন্তু আজ তার মুড অফ আছে বলে সে “ফাক ইউ” বলেই থেমে গেল। মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলল সে বেডের ওপর। নিচে ইন্টারোগেশানের সময় যে পোশাক পরে গিয়েছিল, তা পরেই ছিল সে এতক্ষণ। এবার একে একে পোশাক খুলে সে শাওয়ার নেওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, এমন সময় দরজায় নক করল কেউ। ভ্রূ কুঁচকে গেল তার। তৃষা কি ফিরে এল? এত তাড়াতাড়ি? সে একটা টাওয়াল জড়িয়ে দরজা খুলতেই দেখল অঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

অঞ্জন তাকে দেখে বলল, “আরে ব্রো, আমি কি ভুল সময়ে এসে পড়লাম না কি? তোমরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছিলে। স্যরি…”
“ফাক ইউ। কী যা-তা বলছ অঞ্জন? ঘরে আর কেউ থাকলে তো এনজয় করব? আমি স্নানে যাচ্ছিলাম। কিছু বলবে?”
“নাহ। এমনি এলাম। ভাবছিলাম কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাই। মাথাটা কিরকম ঘেঁটে আছে!”
অঞ্জনের মুখে “ঘেঁটে আছে” শব্দবন্ধ শুনে মজা পেল অরণ্য। অবাঙালি হয়েও অঞ্জন যে খাঁটি বাঙালি আদব-কায়দা রপ্ত করেছে, তা সে বেশ বুঝতে পারছে। ভালো লাগল তার। হালকা লাগছিল। সে বলল, “আরে না না, এসো। দশ মিনিট পরে স্নানে গেলেও অসুবিধে নেই।” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে অঞ্জনকে ঢোকার সুযোগ করে দিল।
অঞ্জন ভিতরে ঢুকতেই সে দরজা বন্ধ করল। প্রতিটা ঘরেই দুটো করে কাঠের চেয়ার আছে, তার উপর নরম কুশন পাতা, সেখানেই বসল দু’জন।
“কিছু নেবে? ড্রিংকস?”
“নিলে ভালো হত। কিন্তু নাহ্, যখন-তখন এ সব খাওয়া উন্মেষা পছন্দ করে না, ফলে…!” অঞ্জন প্রত্যাখ্যান করতে চায়।
“দুটো ক্যানবিয়ার আছে, তুমি নিলে আমিও নিতে পারি,” বলল অরণ্য, “জানতেও পারবে না উন্মেষা! আর বিয়ার কি অ্যালকোহল না কি?”
ওর সঙ্গে তর্ক করতে ভালো লাগছিল না অঞ্জনের। সে বলল, “ঠিক আছে। দাও !”
নিজের রুকস্যাকের ভিতর থেকে দুটো ক্যানবিয়ার বের করে আনল অরণ্য। তারপর তার একটা বাড়িয়ে দিল অঞ্জনের দিকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

অঞ্জন ক্যান খুলে এক চুমুক খেয়ে বলল, “তোমাকে খুব টেনশড্ লাগছে অরণ্য ! এনিথিং রং?”
তাড়াতাড়ি নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় অরণ্য। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে, “কিসের টেনশন? কেনই বা টেনিশন করতে যাবো?”
“সে তো তোমার ব্যাপার অরণ্য। তুমিই ভালো বলতে পারবে। আমি কেবল আস্ক করলাম। উত্তরে হ্যাঁ বা না বললে বুঝতাম!”
“নাহ! আপাততো, বিরক্তি আছে কিন্তু আর কিছু হয় নি। খারাপ লাগছে অঞ্জন, অনিলের কথা শুনে এখানে না-এলেই ভালো হত। কী কুক্ষণে যে রাজি হলাম!” নিজের মনেই আপশোস করে অরণ্য।
“সে একটা-দুটো মিসহ্যাপ হয়ে গেছে এখন, সে জন্যই বলছ। না হলে কিন্তু ট্রিপটা মন্দ হত না। অনিল ব্যবস্থা করেছিল ভালোই, কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী!”
তার কথার কোন জবাব দিল না অরণ্য। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করল কেবল।
অঞ্জন বলল, “অরণ্য, তোমার কী মনে হয়? অনিল কেন খুন হল?”
“কালাদেওর কীর্তি নয় বলছ?” এত সমস্যার মধ্যেও ঠাট্টা করল অরণ্য।
“ড্যাম ইট্। স্টপ দ্য ন্যুইসেন্স অরণ্য। কালাদেও না আর কিছু! আমার মনে হয়, কোন বদমাশ লোক আমাদের ট্রিপটাকে নষ্ট করে দিতে চাইছে! শিওর!”
“কেন? কী করেছি আমরা? আমাদের উপর কার এত রাগ যে এই অচেনা-পরিচিত শহরে এসে আমাদের প্রাণের পিছনে লেগেছে?”
“আমাদের নয় অরণ্য,” ভুল সংশোধন করে দেয় অঞ্জন, “অনিলের!”
“সে-রকম যদি হয়, তাহলে আর একজন কেন মারা গেল? আমি কার কথা বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছ তো? এই রিসর্টের ওই যে ছেলেটি, রুম বয় যে, কী নাম যেন, সে কেন খুন হল?”
“নিজেদের মধ্যে কোন গণ্ডগোল থাকতে পারে। রেষারেষি। যৌন ঈর্ষা ! যে কোন-কিছুই থাকতে পারে। সেটা তদন্ত হলেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু একটা কথা। থানার আইসি আমাদের কিন্তু থানায় যেতে বলেছিলেন একবার। আর্যর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। তার উপর মর্গে গিয়েও সনাক্ত করতে হবে। তাই না? মনে পড়েছে?”
উষ্মা প্রকাশ করে অরণ্য, “উফফ্! আমার কিন্তু মর্গ সহ্য হয় না!”
“এমন করে বলছ যেন মনে হচ্ছে, বেশ কয়েকবার মর্গে গেছ অথবা সেখানে প্রায়ই যাও, যেতে হয়?” অঞ্জন বলল।
“সেখানে থাকলেও ভালো ছিল। এই রকম সসেমিরার মতো অবস্থা হত না আমাদের !”
“সেটা আবার কী?” বুঝতে না পেরে অঞ্জন জিজ্ঞাসা করে।
“এর অর্থ হল ক্রিটিক্যাল সিচ্যুয়েশন!”
“ওহ্!”
অরণ্য হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, অঞ্জন, তুমি কি এর আগে কোনদিন এই পিশাচ পাহাড়ে এসেছ?”
অঞ্জন চমকে উঠল হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে, তারপর খর চোখে তাকাল তার দিকে, “জিজ্ঞাসা করল, “মানে? আমি এই অদ্ভুত জায়গায় কেন আসতে যাব?”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content