রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও দীনবন্ধু মিত্র।

বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্নগুলির একত্র সমাবেশে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়েও এক বছরের মধ্যে কোহিনুর থিয়েটারের যেমন শোচনীয় পতন ঘটেছিল, বোধহয় বঙ্গের কোনও রঙ্গালয়ের ইতিহাসে তেমনটি ঘটেনি। কোহিনুর থিয়েটারের সঙ্গে গিরিশচন্দ্রের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হলে, স্টার থিয়েটার তাঁকে তাদের দিকে নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। মিনার্ভাও নিশ্চিত ছিল না। মিনার্ভার পক্ষীয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি মহেন্দ্র কুমার মিত্রের একান্ত যত্ন ও আগ্রহ দর্শনে ১৩১৫ সালের শ্রাবণ মাস থেকে গিরিশচন্দ্র পুনরায় মিনার্ভা থিয়েটারে যুক্ত হলেন। মাস ময়না ৪০০ টাকা এবং খরচ বাদ দিয়ে থিয়েটারের লাভের পঞ্চমাংশের অধিকারী হয়ে থাকবেন গিরিশচন্দ্র।
মিনার্ভা থিয়েটারে এসে গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রথমে ‘শাস্তি কি শান্তি’ নামে একটি সামাজিক নাটক লিখলেন। ১৩১৫ সালে নানা কারণে কলকাতায় বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল। সেই সময় মিনার্ভা থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ গিরিশচন্দ্রকে এই বিষয় নিয়ে একটি সামাজিক নাটক লিখতে অনুরোধ করেন। ‘বলিদান’ নাটক অনুরোধে লিখিত হলেও গিরিশচন্দ্রের তাতে সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এই বিরাট উত্তেজনার সময় উত্তেজনার বিষয় নিয়ে নাটক লিখতে তিনি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে অবশ্য কর্তৃপক্ষের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি নাটকটা লিখলেন ‘শাস্তি কি শান্তি’। এই নাটকে গিরিশচন্দ্র বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে কোনওরকম মতামত প্রকাশ করেননি। নাটকের শেষে তিনি পাগলের মুখ দিয়ে একটি সংলাপ বলিয়েছেন, “বিবেচনা করুন, বিধবা সম্বন্ধে ঋষিদের যেরূপ ব্যবস্থা তা শাস্তি কি শান্তি?”
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৭: গিরিশচন্দ্রের ছত্রপতি শিবাজি নাটক বাজেয়াপ্ত করে ইংরেজ সরকার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

বিধবা বিবাহ স্বপক্ষে যেসব যুক্তি রয়েছে গিরিশচন্দ্র সে সকলের অবতারণা করতে ত্রুটি করেননি। নাটকের মধ্য দিয়ে প্রধান চরিত্র প্রসন্নকুমার তাঁর স্ত্রীকে বোঝাচ্ছেন “এখনো বলছো বিধবা বিবাহ মহাপাপ? ভ্রূণ হত্যা মহাপাপ নয়? স্বেচ্ছাচারিনি হওয়া মহাপাপ নয়? নীতি বিরোধী কাজ মহাপাপ নয়? উপায় থাকতে উপায় না করা মহাপাপ নয়?
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

১৯০৮ সালের ৭ নভেম্বর এই নাটক মিনার্ভা থিয়েটারের প্রথম অভিনীত হয়েছিল। প্রথম অভিনয় রজনীতে যেসব শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানিবাবু নামে যার পরিচয় প্রসন্ন কুমারের চরিত্রে), প্রিয়নাথ ঘোষ (বেণীমাধব), তারকনাথ পালিত (প্রকাশ), থাক বাবু (পাগল), হীরালাল চট্টোপাধ্যায় (হিরো), প্রকাশমনি (পার্বতী), হেমন্ত কুমারী( নির্মল), সরোজিনী (ভুবনমোহিনী), শশিমুখী (প্রমোদ), সুশীলা বালা (হরমন)। এই নাটকের সংগীত শিক্ষক ছিলেন দেবকান্ত বাগচী। প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রী এই নাটকের ভূমিকাভিনয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তবু এর মধ্যে সুরেন্দ্র বাবুর প্রসন্নকুমারের অভিনয় খুব মর্মস্পর্শী হয়েছিল। থাক বাবু দেখতেও যেমন সুপুরুষ ছিলেন পাগলের ভূমিকা তিনি করেছিলেন অত্যন্ত সুন্দর। হিরোর ভূমিকায় হীরালাল বাবু দর্শক হৃদয়ে একটা জীবন্ত চিত্র আঁকতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

এই নাটকটি গিরিশচন্দ্র স্বর্গীয় দীনবন্ধু মিত্রের নামে উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গ পাতায় তিনি লিখেছেন “আপনাকে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা প্রদান করিবার ইচ্ছা চিরদিনই ছিল, কিন্তু উপহার দিবার যোগ্য নাটক লিখিতে পারি নাই, এই জন্য বিরত ছিলাম। এক্ষণে দেখিতেছি, জীবনের শেষ সীমায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। তবে আর কবে আশা পূর্ণ করিব। সেই নিমিত্ত এই নাটকখানি অযোগ্য হইলেও আপনার পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিলাম। ভাবিলাম ক্ষুদ্র ফুলেও দেব পূজা হইয়া থাকে।

ইতি
চির কৃতজ্ঞ
শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ।”
—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content