বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


কাহিনি বৈশিষ্ট্য: মার্ডার মিস্ট্রি (২০২৪ )
ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: দীনেশ ভিজান মূল কাহিনিঃঅনুজা চৌহান-এর উপন্যাস ‘ক্লাব ইউ টু ডেথ’
কাহিনি চিত্রনাট্য সংলাপ : গজল ধালিয়াল, তমোজিৎ দাস, সুপ্রতিম
সেনগুপ্ত
নির্দেশনা: হোমি আদাজানিয়া
অভিনয়ে: পঙ্কজ ত্রিপাঠি, কারিশ্মা কাপুর, সারা আলি খান, সঞ্জয় কাপুর
ডিম্পল কাপাডিয়া, তিস্কাচোপরা, বিজয় ভার্মা প্রমুখ
সময়সীমা: ১৪২ মিনিট
দেখা যাবে: নেটফ্লিক্স


১৫ মার্চ তারিখ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে মার্ডার মুবারক। ছবির নামের মতো অভিনেতা অভিনেত্রীদের নামের ক্ষেত্রেও চমক। অনুজা চৌহানের ‘ক্লাব ইউ টু ডেথ’ নামের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবির সৃষ্টি। বিইং সাইরাস, ককটেল, ফাইন্ডিং ফেনি, আংরেজি মিডিয়াম এইসব ছবির সুবাদে পরিচিত চিত্রপরিচালক হোমি আদাজানিয়া এই ছবির নির্মাতা। ছবিতে নানান চরিত্রে ছড়িয়ে রয়েছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি, সারা আলি খান, বিজয় ভার্মা, ডিম্পল কাপাডিয়া, কারিশমা কাপুর, সঞ্জয় কাপুর, টিস্কা চোপড়া, সুহেল নায়ার, তারা আলিশা বেরি প্রমুখ শিল্পীরা।

দ্য রয়েল দিল্লি ক্লাব, দিল্লি শহরের এমন একটি ক্লাব যেখানে শুধু সমাজের গন্যমান্য মানুষজনের আনাগোনা। ওই আমাদের টলিক্লাব গোছের ব্যাপার। ওখানে মেম্বারশিপ পাওয়া মানে জাতে ওঠার মই হাতে পাওয়া। কিন্তু এখানেই সাপলুডো খেলার মতো বিনা-আয়েসে পাওয়া মই হাতছাড়া হয়ে সাপের মুখে পড়তে হয়। আর গাছে তুলে মই কেড়ে নিলে যা হয়, লক্ষণের শক্তিশেল নাটকের প্রথম দৃশ্যেই রামচন্দ্রের স্বপ্ন-বর্ণনা। সুকুমার রায় উল্লেখিত সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘চড়তে-চড়তে হঠাৎ পা পিছলে একেবারে—পপাত চ, মমার চ!’
এই সুবিখ্যাত ক্লাবে এটা-সেটা নাচাগানা হয়েই থাকে। প্রেম-ভালোবাসা, পরচর্চা-পরনিন্দা, কাঠিবাজি, লেঙ্গিবাজির অতি উত্তম পরিবেশ এবং পরিস্থিতি এই ক্লাবেই পাওয়া যায়। কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রায় সারাটাদিন এই ক্লাবেই কাটে। ক্লাবই ঘরবাড়ি। বহুবার বহু হিন্দি ছবিতে এলিট ক্লাসকে বে-আব্রু হতে দেখেছি আমরা, এখানেও দেখব। এই ক্লাবের ফিটনেস কোচ লিও’র মৃতদেহ পাওয়া গেল জিমের মধ্যে। কোনও আঘাত করে খুন নয়। দেখে মনে হবে ওয়েট লিফটিংয়ের সময় আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এসিপি ভবানী সিং এবং সাব-ইন্সপেক্টর পদম এলেন খুনের তদন্ত করছেন।

এই খুনের তদন্তে জবানবন্দি নেবার সময় আমরা ছবির একএকটি চরিত্র এবং চরিত্রের অতীত সম্বন্ধে জানতে পারি। তারপর মার্ডার মিসট্রির ক্ষেত্রে যেমন হয়। প্রায় সমস্ত চরিত্রকেই হাবে-ভাবে-সম্ভাব্য খুনির মতো দেখানো হয়। সকলের মধ্যেই পুজোর ফুলের ওপর চন্দন ছেটানোর মতো সন্দেহের কালি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। শেষে গিয়ে যার ওপর সব থেকে সন্দেহ কম ছিল সেই দোষী সাব্যস্ত হয়।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: গড়পড়তা থ্রিলারের ভিড়ে মেরি ক্রিসমাস-এর কাহিনি স্বতন্ত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

এখানেও তার অন্যথা ঘটেনি। কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটা হল গুরুপাক। মার্ডার মুবারক ছবিতে তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রী। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা গল্পকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মূল গল্প থেকে কম্পাসের কাঁটা সরে সরে গিয়েছে।

এরকম ঘটনা গত যুগের হিন্দি ছবিতে খুব ঘটতো। দু’জন নায়ক দু’জন নায়িকা নামী চরিত্রাভিনেতা, কমেডিয়ান, অসাধারণ সুরের গান এই সব কিছুকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে গল্প দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রচুর বড় হয়ে যেত। বহু সময় ধরে অনেক কিছু ঘটতো বটে, কিন্তু মনের মধ্যে কোনও ছাপ ফেলতো না। কিন্তু গত দু-দশকে হিন্দি ছবি তার চরিত্র অনেকটাই বদলে ফেলেছে। ছবি অনেক বেশি ঝকঝকে মেদহীন এবং মূলগল্পের প্রতি একনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।

মার্ডার মুবারকে অনেক রকমের ধোঁয়াশা তৈরি করতে গিয়ে কিছু কিছু জট পরিচালক নিজেই খুলতে পারেননি বা ছবির দৈর্ঘ্যের কথা ভেবে খোলার চেষ্টা করেননি। আসলে মার্ডার মুবারক একটি ওয়েব সিরিজের গল্প, যাকে চেপেচুপে কাহিনিচিত্রের নির্দিষ্ট মাপের সুটকেসে ধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৮: মোহিতকুমারী এক মহিলা আত্মজীবনীকার

সারা আলি খানকে এই ছবিতে বেশ ভালো লেগেছে। সঞ্জয় কাপুরও যথাযথ। কিন্তু এই ছবিতে দু’জন খুব প্রিয় অভিনেতা আমাকে হতাশ করেছেন। একজন বিজয় বর্মা। অনেক কাজ করছেন বটে, কিন্তু চরিত্র বাছতে সক্ষম হচ্ছেন না। এই মুহূর্তে হিন্দি ছবিতে অভিনেতা অভিনেত্রীদের যে প্রচণ্ড রকমের প্রতিযোগিতা, তাতে টিকে থাকতে গেলে সংখ্যায় বেশি নয়, চরিত্রগুণে ছবিতে অভিনয় না করতে পারলে অভিনয়যোগ্যতা গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। এই একই অনুযোগ আমার আরেক প্রিয় অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠীর প্রতি। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলিতে যে এক বিশেষ ‘আয়েশধর্মী চলন’ গোটা দেশে এমন কি বিদেশের ভারতীয়দের কাছেও তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল সেই স্টাইল অভিনয় এখন বোধহয় একটু একঘেয়ে করে দিচ্ছে।

মির্জাপুর, লুডো, সেক্রেড গেমস বা মিমি এই সব ছবি বা সিরিজে নিজেকে পরিবর্তন করলেও বেশিরভাগ নির্মাতাই পঙ্কজের কাছে তার পরিচিত ঢংকেই দাবি করে আসছেন। আর একজন পেশাদার অভিনেতা হিসেবে পঙ্কজ সেই দাবিই মিটিয়ে চলেছেন। আর এখানেই আসছে একঘেয়েমি। চরিত্র অভিনেতাদের চরিত্র বেছে অভিনয় করার সুযোগ অতীতে ছিল না, কিন্তু এখন যথেষ্ট পরিমাণ আছে। কারণ, এখন অভিনেতা-অভিনেত্রী পরিচালক-প্রযোজক নন, ছবির বিষয়বস্তু বা কনটেন্টই হল আসল রাজা। অতীতে এমন সুযোগ ছিল না। তখন ছবির জন্য নায়ক বা নায়িকাভিত্তিক গল্প তৈরি হত এবং ব্যবসাও করত। বিষয়ভিত্তিক ছবি খুবই কম তৈরি হত যেমন—পরশপাথর। তাই তাতে একজন চরিত্রাভিনেতা বিশিষ্ট অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী হিরো হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে বড় ইচ্ছে করছে। নান্দীকার থেকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিয়ে এসে যখন নান্দীমুখ নাটকের দল করেছিলেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে একটা বড় আর্থিক দায়ভার নিতে হয়েছিল। তখনও আজকের মতো বাংলা নাটকের থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেননি। ছোট বড় মাঝারি সব দলের ভালো নাটকের ক্ষেত্রেই মানুষ ভিড় করতেন। তাই নাটকের দলকে নিয়মিত নাটক করতে হতো। কিন্তু তখনকার বিখ্যাত অভিনেতারা নাটকের থেকে আজকের মতো স্বচ্ছন্দ রোজগার করতে পারতেন না। সরকারি অনুদান দেরিতে হলেও এতটাকা দলে আসত না। শুধু মুখচেনা অভিনেতাদের নাটক দেখতেই বেশি দামের টিকিট কেটে আজকের মতো দর্শক ভিড় জমাতেন না।

পৃথিবীর অন্য কোণে বসবাসকারী বঙ্গসমাজ বাংলা নাটকের জনপ্রিয় কুশীলবদের নিয়মিত আমন্ত্রণ জানাতেন না। ফলে সেই প্রথিতযশা অভিনেতাদের জীবিকা অর্জনের জন্যই অপ্রয়োজনীয় ছবিতে বা যাত্রায় অভিনয় করতে হত। প্রখ্যাত এই নট ও নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল। অমন মাপের একজন মানুষ ও তাঁর দৈর্ঘের মতোই বিশালাকার হৃদয় বলেই আমার মতো অতি সামান্য এক গুণগ্রাহীকে উনি ব্যক্তিগতভাবে মনে রেখেছিলেন। একবার একটি যাত্রায় উনি অভিনয় করছেন বলেই আমি দেখতে গিয়েছি। গ্রিনরুমে দেখা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ঢুকতে পারবো কিনা সেই আত্মবিশ্বাস ছিল না। যাই হোক, পাহারায় থাকা ভলেন্টিয়ারকে আমার নাম জানালাম। ভলেন্টিয়ার ভিতরে গিয়ে ওঁকে নাম বলামাত্র উনি নিজে আমাকে ডেকে পাঠালেন।
গ্রিনরুমের ভিতরে গিয়ে দেখলাম বিশালাকার মানুষটি প্লাটফর্মের উপর শুয়ে আছেন আর তার মাথায় ঘাড়ে অমৃতানজন জাতীয় কোন একটি ক্রিম মালিশ করা হচ্ছে। জ্বর-সর্দিতে ভয়ংকর ভাবে কাবু। মাথা তুলতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই অবস্থায় অভিনয় কি করে করবেন?

জবাব এল, অভিনয়টাই তো পারি। অভিনয় বলেই পারবো। তবে দুঃখ কি জানো, এই পালাতে আমার চরিত্র একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার। পণের জন্য বিয়ে না হয়ে যাঁর মেয়েটি মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। আর বাবা হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু পালাকার পরিচালক এমনকি প্রযোজকের মনোগত ইচ্ছে, আমি এই চরিত্রে ওই দুঃখের মধ্যেই আমার হাটে-বাজারে ছবির সেই বিখ্যাত হাসিটা ব্যবহার করি। প্রথম যেদিন এই অনুরোধটা আমার কাছে এসেছিল আমি ঘণ্টাখানেক কথা বলতে পারিনি। পরে মনে হয়েছিল, যে এঁরা তো ব্যবসা করছেন। বোধহয় এই হাটে-বাজারে’র হাসির জন্যই আমাকে ওঁরা নিয়েছেন। এটা ব্যবসায়িক শর্ত। ওঁরা আমার ক্লায়েন্ট। ওঁদের অনুরোধ রাখাটা আমার দায় এবং কর্তব্য। কিন্তু শিল্পী অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর্যাদা তো আমি করতে পারি না। তাই ঠিক করলাম হাসিটা রাখবো, কিন্তু কন্যাহারা সেই বাবার আকুল কান্নাটা তার সঙ্গে আমি মিশিয়ে দেবো।

পঙ্কজ ত্রিপাঠী বাংলা পড়তে পারেন না, পারলে তাঁর সঙ্গেও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসাধারণ উপলব্ধি ভাগ করে নিতে পারতাম।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content