শারীরিক বা মানসিক চিন্তা যে ক্রিয়ার মাধ্যমে ফল উৎপন্ন করে থাকে তাকে কর্ম বলে। সৃষ্ট এই জগৎ কর্মস্থল। প্রত্যেকেই কর্ম করে। কর্ম ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। কিন্তু এই কর্মকে কীভাবে যোগেএ পরিণত করা যায়, সেই কৌশলই কর্মযোগ। কর্মযোগে পরিণত করে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধিকেই বলে কর্মবিজ্ঞান।
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে বলেছেন, সংসারে থাকতে হলে দাসীর মতো ভাব আরোপ করে থাকবে। সে পরের ছেলেকে নিজের ছেলের মতো আদর যত্ন করে, সমস্ত কাজ নিজের বাড়ির কাজের মতোই করে। কিন্তু তাকে যখন বিদায় করে দেওয়া হয়, তখন সে গাঁটরি বেঁধে চলে যায়। আর পিছন ফিরে তাকায় না। তার কোনও মোহ বা টান থাকে না। তেমনি সংসারে এই আসক্তি বা টান ত্যাগ করে থাকার কথা বলছেন। প্রথমে কর্মী, কর্মযোগে এই আসক্তির ভাব ত্যাগ করে সংসারে সাক্ষীর মতো অবস্থান করে কাজ করবে। সমস্ত কাজ করবে কিন্তু মন থাকবে ঈশ্বরের উপর। সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে কর্তব্য কর্ম করে যাওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে বলেছেন, সংসারে থাকতে হলে দাসীর মতো ভাব আরোপ করে থাকবে। সে পরের ছেলেকে নিজের ছেলের মতো আদর যত্ন করে, সমস্ত কাজ নিজের বাড়ির কাজের মতোই করে। কিন্তু তাকে যখন বিদায় করে দেওয়া হয়, তখন সে গাঁটরি বেঁধে চলে যায়। আর পিছন ফিরে তাকায় না। তার কোনও মোহ বা টান থাকে না। তেমনি সংসারে এই আসক্তি বা টান ত্যাগ করে থাকার কথা বলছেন। প্রথমে কর্মী, কর্মযোগে এই আসক্তির ভাব ত্যাগ করে সংসারে সাক্ষীর মতো অবস্থান করে কাজ করবে। সমস্ত কাজ করবে কিন্তু মন থাকবে ঈশ্বরের উপর। সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে কর্তব্য কর্ম করে যাওয়া।
স্বামীজি বলছেন, “যদি আমরা ঈশ্বরের বিশ্বাস করি তবে মানতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, যা কিছু আমার বলে মনে করি সব তাঁরই, ঈশ্বরের। প্রকৃত কর্মযোগী স্বর্গ যাওয়ার জন্যও প্রার্থনা করে না।” কর্মযোগী তাহলে নিজেকে বদ্ধ করে ফেলে। সেই বন্ধন সোনার হতে পারে, সে শিকল সোনার হতে পারে। কিন্তু তা বন্ধন স্বরূপ। স্বামীজি এও বলছেন, “অভিসন্ধি শূন্য হয়ে কর্ম করলে নতুন শৃঙ্খল পরতে হয় না। পরন্তু পুরানো শৃঙ্খল খুলে যায়। আমরা যখন প্রতিদানের আশা না করে সৎ চিন্তা চারিদিকে প্রেরণ করি তা সঞ্চিত থাকবে; শৃঙ্খল ভেঙ্গে যাবে। আমরা ক্রমশ পবিত্রতর থেকে থাকব। যতদিন না পবিত্রতম মানবে পরিণত হই, ততদিন আমাদের কাজ করতেই হবে।” নিঃস্বার্থ কাজের দ্বারা আমাদের চিত্তের শুদ্ধ করণ হয়।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫৪: গিরিশের অটল বিশ্বাস ছিল, রামকৃষ্ণদেব সবই পারেন
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫২: গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটক ‘হরগৌরী’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, শুদ্ধ মন, শুদ্ধ আত্মা এক। যে কর্মের দ্বারা আত্মভাবের বিকাশ হবে তাই কর্ম। যার দ্বারা অনাত্ম ভাবের বিকাশ হবে তা অকর্ম। জীবকে যখন কর্ম করতেই হচ্ছে যেভাবে কর্ম করলে আত্মার দর্শন হয়ে মুক্তি লাভ হবে সেই চেষ্টাই করা উচিত। নিষ্কাম কর্মই কর্মযোগ। স্বামীজি গীতার বিশেষত্ব সম্বন্ধে বলছেন। “প্রথম: যোগের সমন্বয়; দ্বিতীয়: নিষ্কাম কর্ম। এই নিষ্কাম কর্ম অর্থে আজকাল অনেকে অনেকরূপ বলেন; নিষ্কাম হওয়ার অর্থ উদ্দেশ্যহীন হওয়া। বাস্তবিক তা যদি অর্থ হয়, তাহলে হৃদয় শূন্য পশুরা ও দেওয়াল গুলি নিষ্কাম কর্মী। অনেকে জনকের উদাহরণে নিজেকে নিষ্কাম কর্মিরূপে পরিণত করতে ইচ্ছে করেন। (কিন্তু জনক তো বিদেহ ছিলেন) প্রকৃত নিষ্কাম কর্মী পশুবৎ জড় প্রকৃতি বা হৃদয়শূন্য নহেন। তাঁর অন্তর এতদূর ভালোবাসায় ও সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয় যে তিনি সমগ্র জগতকে প্রেমের সহিত আলিঙ্গন করতে পারেন। এরূপ প্রেম ও সহানুভূতি লোকে সচরাচর বুঝিতে পারে না।”
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি
এই যোগ সমন্বয় ও নিষ্কাম কর্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার মধ্যে উপস্থাপনা করেন। তাঁর সমস্ত শরীরে উদ্দাম নিরলস কর্মপ্রবণের প্রতিচ্ছবি ও অথচ তাঁর মুখ নীল আকাশের মতো বীর, গম্ভীর, প্রশান্ত। স্বামীজির প্রিয় শ্লোক গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে—
“ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।”
স্বামীজি বলছেন, “জগতে পাপ তাপ নাই, রোগ শোক নাই, যদি কিছু পাপ জগতে থাকে তাহা এই ‘ভয়’। যে কোনও কার্য তোমার ভিতর শক্তির উদ্রেক করিয়া দেয় তাহাই পূণ্য। আর যাহা তোমার শরীর মনকে দুর্বল করে তাহাই পাপ এই দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। তুমি বীর তোমার এই দূর্বলতা সাজেনা, পরিত্যাগ কর।” জ্ঞানে দ্বারা মুক্তি লাভ হয়। কিন্তু সে জ্ঞান আসে প্রকৃত নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়েই।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।”
স্বামীজি বলছেন, “জগতে পাপ তাপ নাই, রোগ শোক নাই, যদি কিছু পাপ জগতে থাকে তাহা এই ‘ভয়’। যে কোনও কার্য তোমার ভিতর শক্তির উদ্রেক করিয়া দেয় তাহাই পূণ্য। আর যাহা তোমার শরীর মনকে দুর্বল করে তাহাই পাপ এই দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। তুমি বীর তোমার এই দূর্বলতা সাজেনা, পরিত্যাগ কর।” জ্ঞানে দ্বারা মুক্তি লাভ হয়। কিন্তু সে জ্ঞান আসে প্রকৃত নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়েই।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
স্বামীজি ‘প্রকৃত ধর্ম’ প্রবন্ধে বলছেন “জ্ঞান লাভ করবার আগে কর্ম ত্যাগ করলে তাতে দুঃখ এসে থাকে। আত্মার জন্য কর্ম করলে তা থেকে কোনও বন্ধন আসে না। কর্ম থেকে সুখের আকাঙ্ক্ষাও করো না, আবার কর্ম করলে কষ্ট হবে এই ভয়ও করো না। সমস্ত কর্ম ভগবানে অর্পণ করো। সংসারে থেকো, কিন্তু সংসারের হয়ে যেও না। পদ্মপত্রের মূল পাঁকের মধ্যে থাকে, কিন্তু তা সব সময়ই শুদ্ধ থাকে—সেই রকম লোকে তোমার প্রতি যেরকম ব্যবহারই করুক না তোমার ভালোবাসা যেন কারও প্রতি কম না হয়।”
ততদিন আমাদের কাজ করতেই হবে যতক্ষণ না জগতের জগতভাব বিলুপ্ত হয়ে আত্মভাব সম্প্রসারিত হবে। যখন তা হবে তখন আর কাজ থাকবে না, আমাদের কাজও করতে হবে না। কাজ শেষ হবে। কর্ম করেই কর্মের পারে যেতে হবে। কাঁটার সাহায্যে কাঁটা তুলতে হবে, তাছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।—চলবে।
ততদিন আমাদের কাজ করতেই হবে যতক্ষণ না জগতের জগতভাব বিলুপ্ত হয়ে আত্মভাব সম্প্রসারিত হবে। যখন তা হবে তখন আর কাজ থাকবে না, আমাদের কাজও করতে হবে না। কাজ শেষ হবে। কর্ম করেই কর্মের পারে যেতে হবে। কাঁটার সাহায্যে কাঁটা তুলতে হবে, তাছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।—চলবে।
<>strong* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।