রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল

ফাদার আন্তোনিয়োর মুখ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। একটু আগেও কিন্তু তিনি বেশ হাসিখুশিই ছিলেন। বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা করেছিলেন সত্যব্রতকে। আন্তোনিয়ো সামান্য আস্তে আস্তে বললেও বেশ ভালোই বাংলা বলেন এবং কথাবার্তা বাংলাতেই বললেন। সত্যব্রতকে বসতে বলে প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন, “আই অ্যাম এক্সট্রিমলি ভেরি স্যরি। আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল! আপনি ডাক্তার মানুষ, এখানে আপনাকে আটকে রাখার অর্থ অনেক পেশেন্টকে বিপদে ফেলা। যেখানে হেলথ্‌ সেন্টারে আপনিই একমাত্র ডক্টর!”

“নাহ্‌! ঠিক আছে ফাদার। এমনিতেও আপনাদের এত ভালো হসপিটাল থাকতে পেশেন্টপার্টি একজন ডাক্তারকে ঠিক ভরসা করতে পারে না। ফলে, আপনি জানেন কি না জানি না, এই হেলথ্‌ সেন্টারে পেশেন্ট তেমন হয় না। নেহাত এখানে ব্যর্থ হলে বা ডেলিভারি কেস হলে তখন কেউ বাধ্য হয়ে যায়। তাছাড়া এখানে এসে অন্য ডাক্তারি প্রায় ভুলতেই বসেছি!”
“তা ট্রান্সফার নিচ্ছেন না কেন?” আন্তোনিয়ো মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর মুখ ভাবলেশহীন, দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, মনের মধ্যে উল্টোদিকের মানুষটির জন্য কী অনুভূতি কাজ করছে!
“ট্রান্সফার চাইলেই পাওয়া যায় না। আমি অবশ্য চাই-ও নি। এখানকার নেচার, মানুষজনের সারল্য—সব কিছুর প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি।
“অত বিশ্বাস করবেন না। আগুনও দেখতে খুব সুন্দর, শীতল বলে মনে হয়। হাত দিলে হাত পুড়ে যায়। কাভার পেজ ভালো হলেই কনটেন্ট এবং ক্যারেক্টার ভালো হয় না ডক্টর!”
“এই কথাটি আপনি যথার্থ বলেছেন ফাদার!”
“ধন্যবাদ! এবার কাজের কথায় আসা যাক! বলুন, আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কী?”
আন্তোনিয়ো আসলে ভদ্র ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, অনেক খেজুরে হয়েছে, এবার কাজের কথায় আসুন আর তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন।
সত্যব্রত বললেন, “আমি এসেছি একজনের ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিতে।”
“খোঁজখবর নিতে?” ফাদার অবাক হলেন, “কার ব্যাপারে?”
“আপনাদেরই অরফ্যানেজ হোমে থাকে, নুনিয়া!”
“নুনিয়া!” ফাদারের মুখ গম্ভীর আকার ধারণ করল, “তার খোঁজে কী দরকার?”
“দরকার আছে ফাদার!”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু চার্চ যেহেতু লিখিত-পড়িত ভাবে তার বাবার কাছে থেকে তাকে এখানে এনেছে, অতএব চার্চের সম্পূর্ণ অধিকার আছে, কেন হঠাৎ তার মতো মেয়ের খোঁজ পড়ল! ও কী আবার কিছু করেছে?”
সত্যব্রত অবাক হলেন। এই মেয়েটিকে নিয়ে এদের এত আপত্তির কী আছে? ওঁরা কি কিছু গোপন করতে চাইছেন? তবে তিনি অপ্রস্তুত হলেন না। সঙ্গত কারণ আছে বলেই তিনি এসেছেন। সত্যব্রত বললেন, “দেখুন ফাদার, আমি বাধ্য হয়েই নুনিয়ার খোঁজ করছি। আপনি তো জানেন, দিন কয়েক হল আমাদের হেলথ সেন্টারে আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটেছে। একজনকে পেশেন্ট হিসেবে ভর্তি করেন তার বাবা-মা, পেশেন্টটি সম্ভবত আনকমন একটি অসুখে ভুগছিল, কিন্তু আমরা ট্রিটমেন্ট করার আগেই সে রাতারাতি কোথাও উধাও হয়ে যায়। আর তার পরেই জানা যায়, যার নাম নিয়ে সেই ছেলেটিকে ভর্তি করা হয়েছিল, সেই আসল নামের মালিক ছেলেটি তার বেশ কয়েকদিন আগেই কোন কারণে মারা গিয়েছে এবং তার অর্দ্ধভুক্ত দেহ জঙ্গলে উদ্ধারও করে পুলিশ!”

ফাদার শান্ত উত্তাপহীন গলায় বললেন, “এ ভাবে না শুনলেও মোটের উপর শুনেছি। কিন্তু তার সঙ্গে নুনিয়ার কী সম্পর্ক?”

“দেখুন ওই বুধন নামের ছেলেটি, যার দেহ পরে পাওয়া যায়, আমি জানতে পেরেছি, তাকে নুনিয়া খুব ভালোবাসত। ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল দুজনের। নুনিয়া মাঝেমধ্যেই হয়তো চার্চ থেকে কিংবা অন্য কোথাও থেকে চকোলেট ইত্যাদি পেলে বুধনের জন্য নিয়ে যেত। দু’জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পও করত। আমাদের জানা প্রয়োজন, সেই গল্প করার সময় বুধন নুনিয়াকে কিছু বলেছে কি না! নুনিয়া যদি কোন ক্ল্যু দিতে পারে…!”

ফাদার বললেন, “নুনিয়া আবার কী ক্লু দেবে? তার কী কথার ঠিক আছে। হতেই পারে সে বুধনের সঙ্গে মেলামেশা করত, কিন্তু দুটি বাচ্চার মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জেনে কি খুন-জখমের কিনারা করা যায়? আর তাছাড়া সে তো পুলিশের কাজ!”

“দেখুন, অন্যের নামে পেশেন্ট সেজে আসা দ্বিতীয় ছেলেটি যে দিন হেলথ্‌ সেন্টারে ভর্তি হল, সেইদিন আমি যখন তাকে পরীক্ষা করছি, দেখি নুনিয়া জানালা দিয়ে একদৃষ্টে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে কেন গিয়েছিল, আর যদি গিয়েও থাকে সে কেন নকল বুধনকে চিনতে পারল না, সেটা আমাদের জানা খুব দরকার!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪১: তদন্ত শুরু

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

“আপনার এই আগ্রহকে আমি সাপোর্ট করতে পারছি না ডক্টর, মার্জনা চাইছি তার জন্য। নুনিয়া কেন সেখানে গিয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু ওই মেয়েটিই অদ্ভুত। যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, সময়জ্ঞান একেবারেই নেই, আমাদের চার্চের নিয়মকানুন মানে না। ওকে দেখে অন্যেরাও এই সমস্ত ভুল আচরণ শিখলে বিপদ। মেয়েটিকে নিয়ে আমরা খুবই বিব্রত। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না, আর গেলেও বুধনের আনন্যাচারাল ডেথের সঙ্গে তার যে কোন সম্পর্ক নেই, এ-ব্যাপারে আপনাকে আমি আশ্বস্ত করতে পারি।”

সত্যব্রত বললেন, “তা এমন যার স্বভাব তাকে আপনাদের অরফ্যানেজ হোম থেকে চলে যেতে বলতেই তো পারেন?”

“এখনই সম্ভব নয়। মা-বাপ মরা অনাথ। ফাদার রডরিগ ওকে এখানে নিয়ে আসেন। প্রভু যিশু ওকে রক্ষা করেছেন। ফাদার রডরিগ আমাদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, নুনিয়াকে এখান থেকে সরানো যাবে না, অন্তত তিনি যতদিন বেঁচে আছেন। মেয়েটি, সবাই জানে, একবার ব্রুটালি রেপড্‌ হয়েছিল। ওইটুকু মেয়ে দ্যাট কন্ডিশনে প্রায় পনেরো দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছে। ফাদার রডরিগ আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে না পৌঁছলে সব শেষ হয়ে যেত। জীবনে একবার এই রকম একটি ভয়ঙ্কর ঘটনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ও, তার পরেও গভীর ট্রমার মধ্যে ছিল দীর্ঘদিন, তবু প্রভু যিশু যে ওকে রক্ষা করতে পেরেছেন এটাই অনেক। ফাদার রডরিগের বিরুদ্ধাচরণ এখানে কেউ করে না। অতএব তিনি যতদিন আছেন, ততদিন ওকে আমাদের মেনে নিতে হবে। তারপরে কী হবে তা আমি বলতে পারছি না।”
“নুনিয়ার এই নিয়ম না মানার স্বভাবটা বদলানোর চেষ্টা কেন করেননি?”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৬: মোমো চিত্তে!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

“আমরা সকলেই চেষ্টা করেছি। ভালোবেসে বুঝিয়ে, কখনও কখনও শাসন করেও বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে সব কিছুই ঠান্ডা মাথায় শুনেছে, পরে আর সেগুলি মেনে চলেনি। সে চলতে চায় নিজের মর্জি মাফিক, কিন্তু চার্চে সেটা চলে না। হয়তো ফাদার রডরিগের চলে যাওয়ার পর ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
“অন্য কোথাও মানে?”
“চার্চের দূরবর্তী কোন সেন্টারে। অনেকের মত হল, নুনিয়া যেহেতু এই অঞ্চলেই জন্মেছে এবং বড় হয়েছে ফলে এই অঞ্চলটি সে ভালোভাবেই চেনে। এই কারণে সে এখানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানর সাহস পায়। কিন্তু দূরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে যদি পাঠানো হয়, তা হলে হয়তো সে এমন আচরণ আর করবে না!”

সত্যব্রত বুঝলেন, নুনিয়ার জীবন গভীর সংকটে। চার্চের প্রধান হিসেবে যতদিন ফাদার রডরিগ আছেন, ততদিনই মেয়েটিও এখানে আছে। তারপ হয়তো খুব কড়া শাসন চলে এমন কোন সেন্টারে তাকে পাঠিয়ে দেবেন চার্চ কর্তৃপক্ষ। ফাদার রডরিগের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে ভালো হতো তাঁর। এঁরা অনেক কথা বলবেন কিন্তু কোঞ্জ এক অজ্ঞাত কারণে মেয়েটির সঙ্গে তিনি দেখা করেন, কথা বলেন—এঁরা সেটা চাইছেন না। হতেই পারে, অরফ্যানেজ হোমে বাচ্চাদের কড়া শাসনে রাখা হয়, শাস্তিও দেওয়া হয় কড়া রকমের। সে-সব কথা নুনিয়া তাঁকে বলে দিলে তিনি জেনে যাবেন ফলে এটা-ওটা বলে ফাদার তাঁকে কাটিয়ে দিতে চাইছেন কোনওরকমে। নুনিয়ার ব্যাপারে জানতে হলে ফাদার রডরিগের সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভালো হতো।

সত্যব্রত বললেন, “আচ্ছা, আমি কি একবার ফাদার রডরিগের সঙ্গে কথা বলতে পারি?”

ফাদার আন্তোনিয়ো বললেন, “আপনি সম্ভবত জানেন না, ফাদার গুরুতর অসুস্থ। দুটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায়। চার্চের ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোনও উন্নতিই হচ্ছে না। কলকাতা থেকেও ডাক্তার আনা হয়েছে। এখন তো অ্যালঝাইমার রোগেও ভুগছেন। কাউকে চিনতে পারেন না। পুরানো অতীতের কথা মনে আছে, যেমন ছোটবেলার স্কুলের কথা, প্রথম কারনিভাল দেখার কথা, ভাইবোনেদের কথা—কিন্তু তার পরের ঘটনা আর কিছু মনে নেই। কাউকে চিনতেও পারেন না। ইনফেকশনের ভয়ে ডাক্তারের নির্দেশেই কাউকে তাঁড় কাছে যেতে দেওয়া হয় না। এমনকি আমিও যাই না, বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াই, ঘুরে চলে আসি। ওঁর সঙ্গে আপনার দেখা হবে না ডক্টর। কিন্তু কেন? আমার সঙ্গে কথা বলে কি আপনি হ্যাপি নয়?”
আরও পড়ুন:

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার

“সে-কথা ভেবে বলিনি ফাদার। এমনি, ফাদার রডরিগ যেহেতু ওকে ওই রকম একটা অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলেন, তিনিই হয়তো ভালোভাবে বলতে পারবেন, কারা ওকে মলেস্ট করেছিল, রেপ করেছিল!”
“আর বলে কী হবে? তারা কি সাজা পাওয়ার জন্য বসে আছে? মেয়েটিও অদ্ভুত, তাদের কারও নাম বলতে চায় না। বলতে গেলেই না কি সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। আর ও অসুস্থ হয়ে পড়ে! যাক্‌, আমার কাজ আছে, বেরুবো এক্ষুনি। ফলে আজ আর সময় দিতে পারছি না। নাইস টু মিট ইউ। আবার আসবেন একদিন। কথা হবে।” উঠে পড়লেন ফাদার আন্তোনিয়ো।

সত্যব্রত নিরাশ হলেন। ভেবেছিলেন এখানে এসে অনেক কিছু জানতে পারবেন, কিন্তু কোথায় কী? এঁরা তো নুনিয়ার সঙ্গে কথা বলতেই দিচ্ছেন না। আসলে ভয় পাচ্ছেন সভবত। নুনিয়া কোন ভাবে জড়িয়ে পড়লে চার্চের বদনাম। উঠে পড়লেন তিনি। বললেন, “থ্যাংকস ফাদার, অনেকখানি সময় দিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম, মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারব, তাতে হয়তো কিছু জানা যাবে। কিন্তু…সে যাক্‌ ! আজ আসি।” বলে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন সবে, এমন সময় একজন চার্চের ইউনিফর্ম পরা লোক তাঁর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “নুনিয়ার ব্যাপারে জানতে চান? চার্চ থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করুন, জঙ্গলের রাস্তার ধারে। আমি অন্য দিক দিয়ে পৌঁছচ্ছি। সাবধান, চার্চের প্রায় সর্বত্র সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। আমি চললাম।” বলে অদ্ভুতভাবে লোকটা চলে গেল। এমন সময় দেখা গেল চার্চের খোয়া বিছানো পথ ধরে নুনিয়া হেঁটে আসছে। তার মুখ অদ্ভুতভাবেই বিষণ্ণ! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content