শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

রাতে এ দিকে শোঁ শোঁ হাওয়া বয়। পরীর বিলের জলের ওপর দিয়ে ভিজে বাতাস এসে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। এলোমেলো করে দেয় গায়ের কাপড়। প্রথম প্রথম ঘুম আসতো না তার। উন্মত্ত ভালোবাসাবাসির শেষে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ত পরাণ। অনেক রাত অবধি জেগে থাকত পূর্ণিমা। এইসব রাতে ঘরে আলো জ্বালতে দিত না পরাণ। বলত, “তুই তো আর কোনও হুরিপরি নয়! তেমনটা হলে কথা ছিল। ওদের আলোতে থাকলে মানায়। আর তোকে মানায় অন্ধকারে। বলতে নেই, অন্ধকারেই তোর মুখখানা সবচেয়ে ভালো লাগে আমার!”

লোকটার কি যে সব হেঁয়ালিপনা কথা, বুঝতেও পারে না সে। তবে জেগে থাকতে থাকতে কখনও সে শোনে জানালা-দরজার খটখট, পিছনের বারান্দায় টানা গ্রিল লাগিয়েছে লোকটা, হাওয়ার আঘাতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠলে ঝনঝন আওয়াজ শোনা যায় তারও। আর তার মনে হয়, কেউ বা কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আধো আধো গলায় সাত জন্মের শত্তুর পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চাটি যেন কার কথার উত্তরে কী সব বলে। প্রথম দিন ভয়ে কেঁপে উঠে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, “ও কে গো? কে ও? কে কথা বলে?”

পরাণ বৌকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলেছিল, “ও কিছু না, হাওয়ার শব্দে অমন কত কিছু মনে হয়। ঘুমা। পরীর বিলে কত হুরিপরী নেমে আসে, ওদের কথা শুনতে নেই, বলতে নেই। ঘুমা !”
ঘুমিয়ে পড়তও একসময় সে। দিনের আলোয় শান্ত পরীর বিল দেখে আর রাতের কথা কিছু মনে থাকত না। পাখির আওয়াজে ভরে যেত বিলের সকাল। রান্নাবান্নার ব্যস্ততায় সে-সব দিকে মন দেওয়ার ফুরসতও তার থাকত না। স্বামীর জলখাবার করে দিয়ে ঘরের বেবাক কাজ সারতে হত। স্বামী বেরোনোর আগে বাচ্চাকে খাইয়ে বেরোত। কোনওদিন দুধমুড়ি, কোনওদিন সুজির পায়েস—বাচ্চার খাবার বলতে ছিল এই। দুপুরবেলা পরান ফিরে আগে স্নান করত। তারপর গলা ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ কিংবা দুধ দিয়ে মেখে খাইয়ে দিত বাচ্চাকে।

এই একটা দিকে পূর্ণিমা বেঁচেছে। বাচ্চাটি দুধ খেতে ভারি ভালোবাসে। তিন বেলাই দুধ পেলে আর কিছু চায় না। তা না হলে, হাজার বায়নাক্কা থাকলে পূর্ণিমাই পড়ত মুশকিলে। রাতের বেলাতেও ওই একই রকম ভাবে দোকান বন্ধ করে ফিরে বাচ্চার কাছে গিয়ে বসত পরাণ। কি কথা বলত কে জানে? বিয়ের পরে পূর্ণিমা একদিন স্বামীর ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে নিজে সোহাগ করে খাওয়াতে গিয়েছিল। বাচ্চাটি তার হাতে খেতে চায়নি বলে তাকে ‘ঠাস্‌’ করে থাপ্পড় মারে সে। সেই মুহূর্তে পরাণও এসে পৌঁছয়।

সেদিনই প্রথম এবং শেষ পরাণ তার গায়ে হাত তোলে। তারপর ফিসফিস করে ভয়ংকর শীতল গলায় বলে, “আর কোনওদিন আমি না বললে বাচ্চার ঘরে ঢুকবি না! ওকে খাওয়ানো তো দূর! তা নইলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না, বুঝলি? মনে থাকবে?” ভিতরে ভিতরে যদিও রাগে গর্জাচ্ছিল সে, কিন্তু পরানের চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে উঠেছিল।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৩: আঁশ/১

শারদীয়ার গল্প-১: পুরুষোত্তম/৪

মনে হচ্ছিল, লোকটা যেন তাকে খুন করেই ফেলবে। সে মাথা নেড়ে বলেছিল, মনে থাকবে। সেদিন থেকে সে ওই হতচ্ছাড়া বাচ্চার কাছেও ঘেঁষে না। মরুক, মরুক। জন্মের শত্তুর মরলেই তার হাড় জুড়োয় ! রাতে দোকান থেকে ফিরে বাচ্চাকে আগে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তবে খেতে আসত পরাণ। ঘুমিয়ে পড়ত তাড়াতাড়ি। সারাদিন তার ধকল তো কম যায় না। পূর্ণিমা নিজেও যে সবদিন জেগে থাকত তা নয়। তারও সারাদিন বাড়ির কাজে পরিশ্রম কম হয় না। শুলেই দু চোখের পাতা জুড়ে আসে। তবে কোন কোনওদিন ঘুম আসতে চায় না। শরীর উসখুস করে। আজকাল আদর সোহাগের পালা কমে এসেছে। সেসব দিকে খেয়ালই নেই যেন লোকটার। এই বছর দেড়েক বিয়ে হল তাদের, এখনো বাচ্চাই আসে নি তার। প্রত্যেকবার তাকে কি যেন ট্যাবলেট খেয়ে নিতে বলে পরাণ। সে-ও খেয়ে নেয়। একদিন বাচ্চার কথা বলতে সে কেবল বলে হইল, “চিন্তা করিস না! সময় হোক, হবে!”
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?

ক’দিন ধরেই চাপা অস্বস্তিতে ঘুম আসছে না পূর্ণিমার। পিছনের বারান্দার দিকের জানালায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। বারান্দার গ্রিলের বাইরে কিছুটা জায়গা ফাঁকা, তারও পরে কলাগাছের ঝোপ, সজিনা গাছ, কয়েকটা নারকেল গাছ, তারও পরে বিলের চৌহদ্দি শুরু। জলার ধারে ধারে নালিঘাসের সারি, বেকুনজুবাজ গাছের ভিড়। ভুঁইওখড়া গাছের মধ্যে লুকিয়ে বসে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। জোনাকি উড়ছে ঢোলকলমি গাছের মাথার উপর। সামনেই বোধহয় পূর্ণিমা। এইরকম এক আষাঢ় মাসের পুর্ণিমার দিন সে জন্মেছিল বলে ঠাকুমা তার নাম রেখেছিল—পূর্ণিমা। হঠাৎ তার যেন মনে হল, বিলের ধারে বাঁধানো ঘাটের পৈঠার উপর একটি মেয়ে বসে আছে, মাথার একঢাল চুল মেলে দিয়ে। আর তার পায়ের কাছে যেন পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চাটি বসে। ভয়ে শিউরে উঠল সে, “কে? কে ওখানে?”

তার গলার আওয়াজে উঠে পড়েছিল পরাণ। বলল, “কী হয়েছে রে? রাত বিরেতে চিল্লাচ্ছিস কেন? একটু ঘুমাতে দিবি না নাকি?”

ভয়ার্ত পূর্ণিমা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বিলের ধারে ঘাটের ওপরে কারা যেন বসে আছে! একটা মেয়ে, আর আর…”, কথা আটকে যায় তার, “আর তোমার বাচ্চা!”
“কী বলছিস কি তুই? এত রাতে তুই-ই বা ওখানে জানালার ধারে কি কচ্চিস? কই সর, দেখি!” বলে পরাণ এসে তাকে একপ্রকার জোর করে টেনেই সরিয়ে দেয় জানালা থেকে। তারপর বাইরেটা ভালো করে দেখে বলে, “কোথায় কে? হ্যাঁ রে, তোর মাথা-টাথা খারাপ হল নাকি?”
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

পূর্ণিমা তার কথার রাগ করে জানালা দিয়ে তাকে দেখাতে যাবে, তখন দেখল, কোথায় কে? কেউ কোথাও নেই। ঘাটের উপর কেবল জ্যোৎস্না আর পাশের পনস গাছের ছায়া পড়ে মনে হচ্ছে কেউ বসে আছে। ছায়াশরীর কেউ।

আর তখনই মনে হল, আরে পিছনের বারান্দার গ্রিলের গেটটা খোলা হাট করে। চোর টোর এল নাকি! পরানকে বলতে সে নির্বিকার ভাবে বলল, “চোরের নেওয়ার মতো কিছু থাকলে অনেক আগেই চোর আসত। খাবার পরে বিড়ি ধরিয়ে আমিই বিলের কাছে গিয়েছিলাম একবার, ফিরে আসার পর বন্ধ করতে মনে নেই তার। তুই শুতে যা, আমি বন্ধ করে আসছি। ভাগ্যিস দেখলি। না হলে শেয়াল-টেয়াল ঢুকে পড়লে চিত্তির হত। বাচ্চাটাকেও দেখি গিয়ে, ঘুমাচ্ছে কি না। তুই শুয়ে পড়!” বলে বেরিয়ে গেল।

আর তারপরেই যেন ফিসফিস করে গলার আওয়াজ পেল পূর্ণিমা। পরাণ কি বাচ্চাকে কিছু বলছে? —চলবে।
* গল্প (Short Story) – আঁশ (Aansh) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content