বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


একদিন সারদা মার বাড়ির রাখালকে পুণ্যপুকুরের বাঁশবনে শাঁখামুটি সাপে কামড়ায় বাঁ হাতের তর্জনীর ডগায়। সারদা মা বললেন, ‘সিংহবাহিনীর মাড়োতে ওকে নিয়ে যাও,’ আর মায়ের স্নানজল খাওয়াতে ও আঙুলে মাটি লাগাতে বললেন। তাই করা হল। রাখাল ছেলেটি ভালো হয়ে গেল। মাঠের আলপথ দিয়ে একদিন আসার সময় মার ভাইপো ভূদেবকেও জাতসাপে কামড়ায় আর সে জ্ঞান হারায়। তাকে সারদা সিংহবাহিনী দেবীর মাটির প্রলেপ দিয়ে সারারাত ঘরে শুইয়ে রাখেন। সকালে তার জ্ঞান ফিরে আসে। সেই বছরের শেষে শ্রীমার পেটের প্লীহা খুব বেড়ে যাওয়ায় তা গ্রাম্য প্রথায় দাগাবার জন্য মা সারদার মা তাঁকে কয়াপাটের হাটতলায় নিয়ে আসেন। সেখানে শিবমন্দিরে তখন অন্য একজনের প্লীহা দাগানো হচ্ছিল।

অনেকের কাজ মিটে যাওয়ার পর, যে প্লীহা দাগাচ্ছিল, তাকে সারদার মা বললেন যে, অনেক বেলা হয়েছে। তাই চান করে নতুন কাপড়খানি পড়তে ও একটু জল খেতে বললেন। আর ওই পুরোন পাতা যা দিয়ে পিলে দাগানো হচ্ছিল, তা আগুনে ফেলে দিয়ে সারদার জন্য সব নতুন করে নিয়ে আসতে বললেন। মা সারদার সহ্য শক্তি এত বেশি ছিল যে, তিনি পরে প্রবোধবাবুকে বলেছিলেন, পিলে দাগাবার সময় তাঁর বিশেষ কষ্ট হয়নি, সামান্য লেগেছিল মাত্র। তবে তিনি সেরে উঠলেন। শোনা যায়, পিলে দাগাবার জন্য একসময় ঠাকুরও কয়াপাটের হাটতলায় এসেছিলেন।
১২৮২ সালের ফাল্গুনী শুক্লার দ্বিতীয়া তিথিতে ঠাকুরের রত্নগর্ভা জননী দক্ষিণেশ্বরে তাঁর পুত্রের সাক্ষাতে গঙ্গাপ্রাপ্ত হন। এই সংবাদ শুনে সারদা ঠাকুরের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন। ঠাকুর অত্যন্ত মাতৃভক্ত। তিনি রোজ সকালে নিজ মায়ের ঘরে নহবতে গিয়ে তাঁর চরণে ফুল নিবেদন করে আসতেন। আবার রাতে তাঁর মায়ের ঘুমোন অবধি পদসেবা করতেন। সারদা মা একজন পরিচারিকা ও গোঁসাইদাস নামে একজনকে সঙ্গে করে দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন সেই বছরের চৈত্র মাসের পাঁচ তারিখে।

এখানে এসে সারদা আগের মতোই শম্ভূবাবুর তৈরি চালাঘরে থাকতে লাগলেন। ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীও মায়ের সঙ্গে ওই ঘরে থাকতেন। এই সময় ঠাকুরের আমাশয় রোগ হয়। আর সেই সময় কোথা থেকে একজন কাশীবাসিনী পরিচয়ে বয়স্ক স্ত্রীলোক এসে ঠাকুরের সেবা করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে শ্রীমা যখন প্রথমবার কাশী যান, তখন বহু খোঁজ করেও সেই স্ত্রীলোকটির আর দেখা পাননি। ঠাকুরের সেবার জন্য তিনি সারদাকে চালাঘর থেকে নিয়ে আসেন। সারদা মায়ের আগে ঠাকুরের সামনে কখনও তাঁর মাথার ঘোমটা সরাতেন না। কিন্তু এই কাশীবাসিনী সারদার এই সংকোচভাব একেবারে দূর করে দিয়েছিলেন।

একদিন রাতে তিনি সারদাকে ঠাকুরের ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন খুলে দেন। আর ঠাকুর সেদিন সারারাত তাঁদের ভগবৎ কথা শোনাতে লাগলেন। ঠাকুরের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে তাঁরা দু’জন আনন্দে বিভোর হয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। কখন যে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে জানতেও পারেননি। ১২৮৩ সালে শ্রীমা সাবিত্রীব্রত পালন করেন, যার কথা স্বামী সারদানন্দ তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া, শ্রীম তাঁর কথামৃতেও একথা বলেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

নহবতের ঘরের বদ্ধ পরিবেশে বাস করতে করতে সারদার কিছু স্থায়ী রোগ দেখা দিল। রোগের বাড়াবাড়ি হলে তিনি জয়রামবাটি ও কামার পুকুরের খোলামেলা জায়গায় চলে আসতেন। তবু তাঁর মন পড়ে থাকত দক্ষিণেশ্বরে। ভাবতেন, ঠাকুর এখন কেমন আছেন, কে জানে। তাই একটানা দেশে থাকতে পারতেন না। প্রাণের টানে ঠাকুরের কাছে ছুটে যেতেন। কলকাতা থেকে ঘাটাল পর্যন্ত তখন স্টিমার সার্ভিস শুরু হওয়ায় যাতায়াতের পথটা একটু সুগম হয়েছে। তাও হাঁটাপথের দূরত্বও কিছু কম নয়। ঠাকুরের কাছে যাবার আনন্দে সেটুকু কষ্ট তাঁর কাছে কিছুই নয়। কিন্তু অনেক আশা নিয়ে এসেও কি কখনও তাঁকে নিকট আত্মীয়ের থেকে আঘাত সহ্য করতে হয়নি?

একবার মা শ্যামাসুন্দরী নিজে মেয়ে সারদাকে নিয়ে এসেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে পা রাখতেই ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় তেড়ে আসে। অথচ ঠাকুরের মা আর হৃদয় একই স্থান শিহড়ের বাসিন্দা। তবু, হৃদয় শ্যামাসুন্দরীদেবীর প্রতি না জানি কেন বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন। এমন কি তিনি মাঝে মাঝে তাঁর ছোট মামার ওপরেও কর্তৃত্ব দেখাতেন। সেই বলিষ্ঠ হৃদয় সারদার মাকে দেখেই ধমকে ওঠে, ‘এখানে কি চাই? কেন এসেছ? এখুনি ফিরে যাও’। নিজের মাকে চোখের সামনে রূঢ়ভাবে অপমানিত হতে দেখে ও ঠাকুরকে নিশ্চুপ দেখে মা সারদা মনে মনে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

অপমানিতা শ্যামাসুন্দরী মেয়েকে শুধু বললেন, ‘চল, দেশে ফিরে যাই, এখানে কার কাছে মেয়ে রেখে যাব’! সারদা নীরবে সজল নেত্রে নিজের মায়ের সঙ্গে বিদায় নিলেন। পড়ে হয়তো, অনেকের মনে হবে, সত্যি তো ঠাকুর কেন তাঁর ভাগ্নেকে কিছু বললেন না! হৃদয়ের স্বভাবের ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঠাকুরের দৃষ্টি এড়ায়নি। সে আগেও স্পষ্ট কথা বলত এবং মামাদের ওপর বিশেষ করে ছোটমামার ওপর তার অধিকার দেখাত। কিন্তু কালীমন্দিরের পুজোর ভার তার ওপর এসে পড়ায় ক্রমশঃ সে অর্থলোভি হয়ে উঠেছে। ঠাকুর ভক্তদের প্রণামী ছুঁয়েও দেখতেন না, এখন হৃদয় ঠাকুরের আড়ালে ভক্তদের থেকে বেশি প্রণামী নিতে লাগল। দেশে তার নতুন কেনা জমির পরিধির বৃদ্ধি হতে লাগল। অন্তর্যামি ঠাকুর সবই বুঝতেন। তিনি চেয়েছিলেন হৃদয় নিজ কৃতকর্মের ফল পাক। সারদার চোখের জল হল স্বয়ং জগদম্বার অশ্রু।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

সারদা মায়ের প্রতি পরমহংসদেবের যেমন প্রশ্নাতীত প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল, নতুবা তিনি নিভৃতে সারদা মাকে জগদম্বিকা জ্ঞানে তাঁর চরণে নিজের জপমালা নিবেদন করতেন না। তেমনই ঠাকুরের প্রতি সারদা মায়েরও অনন্য ভক্তি ও প্রীতির সংবেদনা ছিল। তাই হৃদয়ের আস্ফালনে ঠাকুর তখন মুখে কিছু না বললেও তাঁর কোমল হৃদয় ব্যথিত হয়েছিল নীরবে। পরে তিনি তাই জয়রামবাটিতে খবর পাঠিয়ে সারদাকে দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে আসেন। আর এই ঘটনার জন্য বারবার দুঃখ প্রকাশ করেন।

শ্রীমার প্রতি ঠাকুরের আবেগের প্রকাশ সংযত হলেও নহবতের জীবনে শ্রীমাকে কাঠিন্যের মধ্যে রেখে তিনি তাঁকে নিজের অবর্তমানে আরও কঠিনতর কর্তব্য পালনের জন্য যোগ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। আর হৃদয়ের অতিলোভের জন্য আর তার দুর্ব্যবহারের জন্য সে তার কর্মের ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে মথুরবাবুর উত্তরাধিকারির দ্বারা দক্ষিণেশ্বরের চৌহদ্দিতে ঢোকার অধিকার হারায়। তাকেও একদিন চোখের জলে মন্দির ছাড়তে হয়। এমনকি তার কেনা জমি-জমাও পরিবার ভরণপোষণের জন্য বিক্রয় করতে হয়। শুধু তাই নয়, সঞ্চিত ধনও শেষ হয়ে যায়। পথে পথে কাপড় ফেরি করতে হয়েছে তাকে দুমুঠো অন্নের জন্য।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content