শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।
বারাণসীতে আচার্য শঙ্কর গঙ্গাস্নান করে উঠে আসচ্ছেন এমন সময় এক চন্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিলেন। আচমকা চন্ডালের গা আচার্যের গায়ে লেগে গেল। এমনি শঙ্করাচার্য বলে উঠলেন, ‘এই তুই আমাকে ছুঁলি!’ চন্ডাল বলল, ‘আচার্য, তুমি আমায় ছোঁওনি, আমিও তোমায় ছুঁইনি।’ যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনি শরীর নন, পঞ্চভূত নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন। শঙ্করাচার্য ব্রহ্ম জ্ঞানী। তাঁর প্রথম প্রথম ভেদ বুদ্ধি ছিল। ভগবান শিব তাঁর ভেদ কাটানোর জন্য এমন করেন। তখন তাঁর ভেদ বোধ গেল। যিনি ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করেছেন তিনি ব্রহ্মস্বরূপই হয়ে যান।
তাঁর সর্বত্র প্রকাশ ও সর্বরূপ দর্শন করে তিনি মোহিত হয়ে যান। তার আর উচ্চ-নীচ ভেদ থাকে না। সর্বোচ্চ ব্রহ্মা থেকে তৃণা পর্যন্ত একই চৈতন্যের প্রকাশ বর্তমান। ভেদ আর থাকলো কোথায়! শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, কথামৃতে কৃষ্ণকিশরে কথা বলছেন। কৃষ্ণ কিশোর পরম হিন্দু, সদাচারি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তিনি বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। সেখানে ভ্রমণ করতে করতে তাঁর জল তৃষ্ণা পায়। একটা কুয়ো দেখে এগিয়ে গেলেন। একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাঁকে বললেন, ওরে, তুই আমায় এক ঘটি জল দিতে পারিস? তিনি বললেন, ঠাকুর আমি অতিহীন জাতি।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৪: যতক্ষণ না সংসারে ভোগের বাসনা শেষ হয়, ততক্ষণ কর্ম করা দরকার
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া
কৃষ্ণ কিশোর বললেন, তুই বল শিব আর জল দে’। শিব শিব করতে করতে তিনি জল দিলেন। আর কৃষ্ণ কিশোর জলপান করলেন। ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়। শ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন, এক গল্পে আছে, নারদের দীক্ষা হয়নি বলে ভগবান নারায়ণ নারদের শরীর শুদ্ধ হয়নি, লক্ষ্মী দেবীকে বলেছিলেন। ঈশ্বরের নামে সমস্ত দোষ কেটে যায়। শুদ্ধতায় মন ভরে ওঠে। ভেদভাব সংকীর্ণতা ডেকে আনে। অন্যদের থেকে পৃথক করে গণ্ডিতে বদ্ধ করে। আমি শ্রেষ্ঠ, এ তো অহংকার। সকলকে ভালোবাসতে হয়। কেউ পর নয়, সর্বভূতে সেই হরি বিরাজ করছেন। তিনি ছাড়া কিছুই নেই।
আরও পড়ুন:
হরিয়ানার পানিপথ থেকে গুজরাতের পোরবন্দর পর্যন্ত ১৪০০ কিমি ‘গ্রিনওয়াল’ তৈরি করবে ভারত
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২০: দু’জন সন্ন্যাসী এক জায়গায় হলেই সাধন-ভজন ভুলে তাঁরা জগৎ-সংসারের কথায় মগ্ন হয়ে যান
শ্রীরামকৃষ্ণ এও বলছেন, ভগবান শ্রীনারায়ণ প্রহ্লাদকে বললেন, ‘তুমি বড় লও।’ প্রহ্লাদ বলেন, ‘আপনার দর্শন পেয়েছি। আমার আর কিছু দরকার নাই।’ ঠাকুর ছাড়লেন না। তখন প্রহ্লাদ বললেন, ‘যদি বর দেবেন, তবে এইবার দিন, আমায় যারা কষ্ট দিয়েছে, তাদের যেন কষ্ট না হয়।’ পল্লাদ দেখছেন সকলের মধ্যে প্রভুই রয়েছেন। যিনি কষ্ট দিয়েছেন, আর যিনি রক্ষা করছেন কোনও ভেদ নাই। সর্বত্র তিনি প্রকাশিত থাকেন, সকলের মধ্যেই তিনি দুষ্ট রুপি নারায়ণ আবার শিষ্ট রুপি নারায়ণ।
স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের যথার্থ স্বরূপ প্রবন্ধটিতে বলছেন, “আমাদের জীবন যতক্ষণ সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত থাকে, যতক্ষণ অপরের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে ততক্ষণই জীবিত। আর এই ক্ষুদ্র জীবনযাপনই মৃত্যু এবং এই জন্যই আমাদের মৃত্যু ভয় দেখা যায়। মৃত্যু ভয় তখনই জয় করা যেতে পারে। যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে, যতদিন এই জগতে একটা জীবনও রয়ে গিয়েছে ততদিন সেও জীবিত। এই রূপ উপলব্ধি হলে মানুষ বলতে পারে, আমি সকল বস্তুতে, সকল দেহে বর্তমান। সকল জীবের মধ্যেই আমি বর্তমান। আমি এই জগত। এই সমুদয় জগতই আমার শরীর। অনন্তকে ভাগ করা যেতে পারে না। অনন্ত খণ্ড খণ্ড করা যেতে পারে না। এই এক অবিভক্ত সমষ্টি স্বরূপ অনন্ত আত্মা রয়েছে। তিনিই মানুষের যথার্থ ‘আমি’ তিনি প্রকৃত ‘মানুষ’।
স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের যথার্থ স্বরূপ প্রবন্ধটিতে বলছেন, “আমাদের জীবন যতক্ষণ সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত থাকে, যতক্ষণ অপরের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে ততক্ষণই জীবিত। আর এই ক্ষুদ্র জীবনযাপনই মৃত্যু এবং এই জন্যই আমাদের মৃত্যু ভয় দেখা যায়। মৃত্যু ভয় তখনই জয় করা যেতে পারে। যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে, যতদিন এই জগতে একটা জীবনও রয়ে গিয়েছে ততদিন সেও জীবিত। এই রূপ উপলব্ধি হলে মানুষ বলতে পারে, আমি সকল বস্তুতে, সকল দেহে বর্তমান। সকল জীবের মধ্যেই আমি বর্তমান। আমি এই জগত। এই সমুদয় জগতই আমার শরীর। অনন্তকে ভাগ করা যেতে পারে না। অনন্ত খণ্ড খণ্ড করা যেতে পারে না। এই এক অবিভক্ত সমষ্টি স্বরূপ অনন্ত আত্মা রয়েছে। তিনিই মানুষের যথার্থ ‘আমি’ তিনি প্রকৃত ‘মানুষ’।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির
শ্রীমদ্ ভগবৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের মর্যাদা রক্ষার সপক্ষে বলছেন, “যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।” যিনি আমাকে সর্বত্র সর্বভূতে সকলের আত্মস্বরূপে দেখেন এবং ব্রহ্মাদি যাবতীয় ভূতসমূহ সর্বাত্মা আমাকে দেখেন, সেই আত্মৈকত্বদর্শীর কাছে ঈশ্বর আমি কখনও পরোক্ষ বা অদৃশ্য হই না। তিনিও আমার নিকট পরোক্ষ বা অদৃশ্য হন না।
যিনি বিগতস্পৃহ হয়েছেন, শরণাগতি ও আত্মসমর্পণ সাধন দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সর্বব্যাপী বিরাটকেই প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সকলের সঙ্গে অভিন্নতা স্থাপন করেছেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে আছে, ‘যত্র যত্র নেত্র ঝুরে, তত্র তত্র কৃষ্ণ ষ্ফূরে।” আমি যেদিকে ফিরাই আঁখি, সব কৃষ্ণময় দেখি। এই রূপ ভক্তের অনুভব।
যিনি বিগতস্পৃহ হয়েছেন, শরণাগতি ও আত্মসমর্পণ সাধন দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সর্বব্যাপী বিরাটকেই প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সকলের সঙ্গে অভিন্নতা স্থাপন করেছেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে আছে, ‘যত্র যত্র নেত্র ঝুরে, তত্র তত্র কৃষ্ণ ষ্ফূরে।” আমি যেদিকে ফিরাই আঁখি, সব কৃষ্ণময় দেখি। এই রূপ ভক্তের অনুভব।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।