রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধপধপিতে দক্ষিণ রায়ের মন্দির।

সেই প্রাচীন কাল থেকে সব দেশে ব্যক্তিপুজো চলে আসছে। মানুষ সেইসব ব্যক্তিকেই পূজনীয় করে তোলে যাঁরা শৌর্যে, বীর্যে বা মহত্ত্বে মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেন। একটা সময় আসে যখন ব্যক্তি দেবত্ত্বে উন্নীত হন। আর সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা বেশি করেই ঘটেছে কারণ সুন্দরবন প্রথম থেকেই ছিল শ্বাপদসঙ্কুল এক গহন বাদাবন যেখানে জীবনধারণ করা ছিল চরম কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। স্বভাবতই সেখানে যে বা যাঁরা অভাবনীয় বীরত্ত্ব বা মহত্ত্ব দেখিয়েছেন তাঁরা সুন্দরবাসীর মনে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে কত লোককথা, উপকথা, লোকগাথা। সুন্দরবনে এমনই এক লৌকিক দেবতা হলেন দক্ষিণ রায়। সুন্দরবনবাসীর কাছে তিনি হলেন ব্যাঘ্রদেবতা।

সপ্তদশ শতকে নিমতা গ্রামের বাসিন্দা কবি কৃষ্ণরাম দাসের লেখা “রায়মঙ্গল” কাব্যে দেবতা দক্ষিণ রায়ের মহিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। গল্পটি এইরকম। বনিক পুষ্পদত্ত সমুদ্রযাত্রার জন্য বরদহের রতাই বাউল্যাকে একটি বাণিজ্যতরী নির্মাণের আদেশ করেন। রতাই তার ছয় ভাই ও এক ছেলেকে সাথে নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে কাঠ কাটতে যায়। কিন্তু জঙ্গলে তারা একটি বড় গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের রাজা দক্ষিণ রায় ক্ষেপে গেলেন, কারণ ওই গাছটিতে তিনি থাকতেন।
ক্রুদ্ধ দক্ষিণ রায় ছয়টি বাঘকে পাঠালেন রতাইয়ের ছয় ভাইকে হত্যা করার জন্য। বাঘেরা ছয় ভাইকে হত্যা করলে শোকাকুল রতাই আত্মহত্যা করতে গেল। আর তখনই সে এক দৈববাণী শুনতে পেল—যদি সে তার ছেলেকে দক্ষিণ রায়ের উদ্দেশ্যে বলি দেয় তবেই সে তার ছয় ভাইকে ফিরে পাবে। সেইমতো রতাই দক্ষিণ রায়ের পুজো করে ছেলেকে সেখানে বলি দিল। ফলে সে তার ছয় ভাইকে ফিরে পেল। তারপর সে ফিরে এসে পুষ্পদত্তকে দক্ষিণ রায়ের মহিমার কথা শোনাল।

যাইহোক, রতাইয়ের আনা কাঠ দিয়ে মনুষ্যবেশী হনুমান ও বিশ্বকর্মা সাতদিনে সাতটি বাণিজ্যতরী বানিয়ে দিল। সবচেয়ে ভালো তরীটির নাম হল ‘মধুকর’।

এ বার পুষ্পদত্ত মধুকরে চেপে বাণিজ্য এবং তাঁর নিখোঁজ পিতার সন্ধানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তাঁর মা সুশীলা দক্ষিণ রায়ের পুজো করে ছেলেকে বললেন, বিপদে পড়লে যেন দক্ষিণ রায়কে স্মরণ করে। নদীপথে রওনা হয়ে পুষ্পদত্ত খনিয়ায় পৌঁছে দক্ষিণ রায়ের পুজো দেন। তারপর গঙ্গাসাগরে পৌঁছে উপকূল ধরে এগোনোর সময় সমুদ্রের বুকে একটা অপরূপ প্রাসাদ দেখতে পান। কিন্তু সহযাত্রীরা কেউই তা দেখতে পায়নি। এরপর তিনি তুরঙ্গ শহরে পৌঁছলে সেখানের রাজাকে ওই প্রাসাদের কথা বলেন। রাজা ওই প্রাসাদ দেখতে চাইলে পুষ্পদত্ত তা দেখাতে ব্যর্থ হন। তখন মিথ্যা বলার জন্য রাজা তাঁকে বন্দি করেন ও শিরশ্ছেদের আদেশ দেন। তখন পুষ্পদত্ত দক্ষিণ রায়ের আরাধনা শুরু করেন।

দক্ষিণ রায় ও নারায়ণির বারামূর্তি।

ভক্তের আহ্বানে দক্ষিণ রায় তাঁর ব্যাঘ্রবাহিনী নিয়ে তুরঙ্গ শহর আক্রমণ করেন এবং রাজাকে হত্যা করেন। রাজার মৃত্যুতে ক্রন্দনরত রানি দক্ষিণ রায়ের দৈববাণী শুনতে পান, যদি দক্ষিণ রায়ের মূর্তি গড়ে পুজো করেন তবে রাজাকে বাঁচিয়ে দেবেন। রানি এই কথা শুনে তাঁর পুজো শুরু করেন। ফলে রাজা বেঁচে ওঠেন এবং তাঁর কারাগারে বন্দী পুষ্পদত্তের পিতাকে মুক্ত করেন। আর উপরি হিসেবে পুষ্পদত্তের সাথে রাজকন্যা রত্নাবতীর বিয়েও দেন। তারপর পিতা ও পত্নীসহ পুষ্পদত্ত দেশে ফিরে আসেন।

ব্যক্তি দক্ষিণ রায় কে ছিলেন বা তিনি কোন সময়ে ছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেকের মতে দক্ষিণ রায় আসলে কারও নাম নয়, ‘দক্ষিণ প্রদেশের অধিপতি’ এই অর্থে দক্ষিণ রায়। এজন্য তাঁকে ‘দক্ষিণেশ্বর’-ও বলা হয়। প্রচলিত মতে তাঁর রাজত্বের সীমানা ছিল দক্ষিণে কাকদ্বীপ, উত্তরে ভাগীরথী নদী, পশ্চিমে ঘাটাল ও পূর্বে বাকলা জেলা। অনেকের মতে তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের একজন রক্ষক। মুসলিম শাসকদের চাপে এবং সুফি সাধক, পীর বা গাজীদের প্রভাবে যখন সুন্দরবন অঞ্চলের নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছিল তখন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দক্ষিণ রায়, ধর্মান্তরের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়কে। কারও কারও মতে, দক্ষিণ রায় ছিলেন সুন্দরবনের প্রথম রাজা মদন রায়ের প্রধান সেনাপতি। আবার কারও মতে তিনি রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ও মদন রায়ের বংশধর।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

১৬৮৬ সালে কবি কৃষ্ণরাম দাস বিরচিত “রায়মঙ্গল” কাব্যে দেখতে পাই দক্ষিণ রায় ‘আঠারো ভাটির দেশ’ অর্থাৎ সুন্দরবনের রাজা। তাঁর বাসস্থান খাড়ি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দীঘি থানার অন্তর্গত গ্রাম খাড়ি আজও রয়েছে। রায়মঙ্গল কাব্যে দেখতে পাই দক্ষিণ রায় খনিয়ার প্রান্তে ইসলাম ধর্মের প্রচারক বড়ো খাঁ গাজীর সাথে ভয়ানক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জয়নগর ২ নং ব্লকে এখনও রয়েছে খনিয়া নামাঙ্কিত খনিয়া-সাহাজাদাপুর গ্রাম। আবদুল গফুরের লেখা “কালু গাজী চম্পাবতী” কাব্যেও দেখি যে ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান ভরসা হলেন দক্ষিণ রায়। এই কাব্যেও উল্লেখ রয়েছে যে দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে বড় খাঁ গাজীর যুদ্ধ হয়েছিল খনিয়াতে। খনিয়ার কাছে আজও রয়েছে ‘মুকুট রাজার দীঘি’ এবং খনিয়ার উত্তরে চণ্ডীপুর গ্রামে রয়েছে বড় খাঁ গাজীর জীর্ণ কবর।

কৃষ্ণরাম দাস ছাড়াও দক্ষিণ রায়ের লোকগাথা রচনা করেছেন কবি হরিদেব ও রুদ্রদেব। ১৭২৩ সালে হরিদেবের লেখা “রায়মঙ্গল” থেকে জানা যায়, দক্ষিণ রায় হলেন জঙ্গলের রাজা যে জঙ্গলে বাঘে-মানুষে কথা বলে এবং তাঁর সেবক হল ধীবরেরা। তিনি বলেছেন দক্ষিণ রায় ও তাঁর ভাই কালু রায় হলেন শিবের কামজ পুত্র ভব ও শর্ব। তিনি গনেশ হিসেবে দক্ষিণ রায়কে দেখাতে চেয়েছেন। শনির কোপে বিচ্ছিন্ন গনেশের মাথা দক্ষিণে এসে পড়ে তা দক্ষিণ রায়ে পরিণত হয়। হয়তো সেই কারণেই কোথাও কোথাও বারামূর্তি বা মুণ্ডমূর্তি প্রতীকে দক্ষিণ রায়ের পুজো হয়।

শিল্পীর তুলিতে দক্ষিণ রায়ের ব্যাঘ্রবাহিনীর সাথে খনিয়ার প্রান্তরে বড়ো খাঁ গাজীর যুদ্ধ।

অবশ্য বারামূর্তি হিসেবে একা দক্ষিণ রায় নয়, সঙ্গে তাঁর মা নারায়ণীরও পুজো হয়। তবে এই মানবীয় বারামূর্তি বা মুণ্ডমূর্তি পুজো পদ্ধতি বহু প্রাচীনকাল থেকে বহু প্রাচীন সভ্যতায় দেখা গিয়েছে। প্রাচীনকালে নিম্নবঙ্গে দক্ষিণ রায় ও নারায়ণীর একসাথে পঞ্চাশ জোড়া বা একশত বারামূর্তি পূজিত হত। একশত বারামূর্তি পূজাপদ্ধতি থেকে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুটি স্থানের নামকরণ হয় ‘বারাশত’। এই অঞ্চলে বারামূর্তি নির্মাণ শিল্পীরা খুবই বিখ্যাত। ‘বারাশত’ নামটি কালের স্রোতে পরিবর্তিত হয়ে আজ ‘বারাসত’ বা ‘বারাসাত’ হয়ে গেছে। দুটি স্থানের নাম বারাসত হওয়ায় দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জয়নগরের কাছে প্রাচীন জনপদটি ‘দক্ষিণ বারাসত’ নামে আজ পরিচিত।

দুই ২৪ পরগনার কোথাও কোথাও এখন গনেশের ধ্যানমন্ত্রে দক্ষিণ রায়ের পুজো হয়। আর পুজো করেন ব্রাহ্মণরা। যেহেতু তিনি লৌকিক দেবতা তাই তাঁর পুজোয় কোনও শাস্ত্রীয় বিধান থাকার কথা নয়, কোনও মন্ত্রও থাকার কথা নয়। সুন্দরবনের কৃষিজীবী, অরণ্যজীবী ও ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষের আরাধ্য লৌকিক দেবতা দক্ষিণ রায়। তাই তাঁর পুজো করার কথা সেইসব মানুষের, ব্রাহ্মণের নয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণরা নিম্নবঙ্গে দক্ষিণ রায়ের প্রাধাণ্য দেখে তাঁকে লৌকিক দেবতা থেকে পৌরাণিক দেবতায় উন্নীত করার লক্ষ্যে মনে হয় গনেশ ও দক্ষিণ রায়কে অভিন্ন বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া— প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস

মুসলমানি কেচ্ছাকাব্য “বনবিবি জহুরানামা”-তেও দেখতে পাই বনবিবির সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের তীব্র বিরোধিতা শেষে সম্মুখসমরে পর্যবসিত হয়। আর যুদ্ধে দক্ষিণ রায়ের পরাজয় হলে বনবিবির সঙ্গে সন্ধি স্থাপিত হয়। মুনশি বয়নুদ্দিশ রচিত “বনবিবি জহুরানামা”-তে দক্ষিণ রায়ের বাবার নাম বলা হয়েছে দণ্ড বক্ষ মুনি। এখানেও তাঁর মায়ের নাম নারায়ণী। তিনি তন্ত্র সাধিকা ও যুদ্ধনিপুনা। মায়ের প্রভাবে দক্ষিণ রায়ও তন্ত্রসাধক হয়ে ওঠেন। বনবিবির সঙ্গে প্রথমে নারায়ণীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নারায়ণী পরাজিত হন ও পরে সন্ধি হয়। অনেকের মতে এই দক্ষিণ রায় আসলে সুন্দরবনের এক শক্তিশালী তন্ত্রসাধক কাপালিক। আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসে দেখতে পাই যে নবকুমারকে দক্ষিণের অরণ্যের এক কাপালিক বলি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাই এ থেকে অনেকের ধারণা, অতীতে সুন্দরবন ছিল তন্ত্রসাধক কাপালিকদের বড়ো আস্তানা। দক্ষিণ রায় সেই কাপালিকদের এক মহাগুরু।

যোদ্ধাবেশে দক্ষিণ রায়।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দক্ষিণ রায়কে একজন ‘বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য’ বলে মনে করেন। মধ্যযুগে নিম্নবঙ্গ অঞ্চলের নিম্নবর্ণের অধিবাসীদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এইসব অধিবাসীকে বলা হত বৌদ্ধ-পোদ। তাঁর মতে, নিম্নবঙ্গ থেকে বৌদ্ধধর্মের অবসানের পর বৌদ্ধ ধর্মের দেবতারা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে দেবতায় পর্যবসিত হয়েছে। দক্ষিণ রায় সেই দেবতাদের অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ড. সুকুমার সেনের মতে, দক্ষিণ রায় হলেন ‘অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গল জাতির অন্যতম উপাস্য ব্যাঘ্র-মানব অপদেবতা’। লোকসংস্কৃতি-গবেষক ব্যোমকেশ মুস্তাফিও এঁকে দ্রাবিড়-মোঙ্গলীয় প্রভাবযুক্ত অপৌরাণিক বনদেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। সুন্দরবন গবেষক ডঃ মণীন্দ্রনাথ জানা মনে করেন মৌর্য যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-১৮৫ অব্দ) সমসাময়িক কালে দক্ষিণ রায়ের আবির্ভাব। আবার প্রত্নতত্ত্ববিদ সুধাংশু রায়ের মতে, মৌর্য যুগের আগে বাংলাদেশে ছিল মিশরীয় শাসকদের আধিপত্য। নিম্নবঙ্গের দক্ষিণ অংশে এমনই এক প্রভাবশালী মিশরীয় শাসক ছিলেন দক্ষিণ রায়। মিশরীয় শক্তির পতনের পর তিনি দেবতারূপে পুজো পেয়ে আসছেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

দক্ষিণ রায়ের উৎস যাই হোক না কেন তিনি যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। আর হয়তো তাই তিনি কারও বাড়িতে অধিষ্ঠান করেন না। সুন্দরবন অঞ্চলে তাঁর কোনও প্রাচীন ইটের মন্দির নেই। তিনি পূজিত হন কোনও বট, অশ্বত্থ বা নিম গাছের তলায়, আরণ্যক পরিবেশে। প্রধাণত মউলে, বাউলে, জেলে, মলঙ্গী, পোদ, বাগদি শ্রেণির মানুষ এঁর উপাসক। বহুকাল আগে থেকেই সুন্দরবনের মধ্যে যাত্রা করার আগে বনের প্রান্তে তাঁর পুজো করে প্রসাদী ফুল মাথায় বেঁধে তারা বনমধ্যে প্রবেশ করে। তাদের বিশ্বাস, এতে তারা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। কোথাও কোথাও মাটির ঢিপি বা পাথরের খন্ডে সিঁদুর মাখিয়ে দক্ষিণ রায়ের পুজো হয়।

তবে আধুনিককালে তাঁর মন্দির নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধপধপিতে রয়েছে দক্ষিণ রায়ের বা দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। পৌষ সংক্রান্তি থেকে মাঘের সংক্রান্তির মধ্যে পুজো হয়। দক্ষিণ রায়ের চেহারা যোদ্ধার মতো। তাঁর বিরাট মোটা গোঁফ। আছে একটা লম্বা লেজও। দুই কষ থেকে লালা ঝরে। তিনি বাঘের উপরে উপবিষ্ট। অবশ্য ধপধপির মন্দিরে তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট। আবার তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আধুনিক সমরাস্ত্র বন্দুক। এটি অনুচিত কারণ এতে দেবতার প্রাচীণত্ব নষ্ট হয় ও মানুষের ভুল ধারণা জন্মায়। পুজোয় রায়মঙ্গল পালাগান হয়। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই সেই পালাগান শোনে। কোথাও কোথাও কীর্তনগানও হয়। পুজোয় পাঁঠা বলির প্রচলনও দেখা যায়।

দক্ষিণ রায়ের হাতে আধুনিক যুগের বন্দুক তুলে দেওয়া হয়েছে, যা তাঁর প্রাচীণত্বের সঙ্গে বেমানান।

সবশেষে দক্ষিণ রায় সম্বন্ধে বলা যায় যে, তিনি যুগ যুগ ধরে নানা লৌকিক দেবতার ও নানা সংস্কৃতির এক সম্মিলিত রূপ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, মিশরীয় নানা ধর্মের, আর্য ও অনার্য নানা জাতির উপাদানস্বরূপ ফুল দিয়ে গেঁথে তৈরি হয়েছেন মালাস্বরূপ দক্ষিণ রায়। তাই এককভাবে কোনও একটি ধর্মের বা সম্প্রদায়ের দেবতা হিসেবে দক্ষিণ রায়কে বিবেচনা না করাই শ্রেয়। যুগে যুগে দক্ষিণ রায়ের বিবর্তন হয়েছে। অধ্যাপক দুলাল চৌধুরী মনে হয় যথার্থই দক্ষিণ রায়ের ক্রমিক বিবর্তনকে এভাবে তুলে ধরেছেন—মউল্যা-মালঙ্গীর দেবতা দক্ষিণ রায়, ব্যাঘ্রভীতি নিরোধক দক্ষিণ রায়, দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলের, বাদার ও সুন্দরবনের শস্যরক্ষক ও প্রাণত্রাতা দক্ষিণ রায়।

এছাড়াও আমরা দক্ষিণ রায়কে নানা সময়ে তান্ত্রিক, ধর্মযোদ্ধা, ক্ষেত্রপাল, এমনকি সাম্প্রতিককালে রোগ নিবারণের দেবতা হিসেবে দেখতে পাই। ধপধপিতে দক্ষিণ রায়ের যে মন্দির আছে তার কাছেই রয়েছে বাওয়ালি নামে একটি গ্রাম। বাওয়ালি নামের অর্থ কাঠুরে। সুন্দরবন একসময় কলকাতা, এমনকি তারও আগে নদীয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তখন কাঠুরেরা এই মন্দিরে পুজো দিয়ে জঙ্গলে যেত যাতে বাঘের আক্রমণে প্রাণ না যায়। এখন কিন্তু রোগমুক্তির কামনায় সবাই ওই মন্দিরে যায়, মানত করে। সময়ের সাথে সাথে দেবতারও যে বিবর্তন হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা দক্ষিণ রায়।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content