রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

হেলথ সেন্টারে নিজের চেম্বারে থম মেরে বসে ছিলেন সত্যব্রত। কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। একটু তফাতে একখানা বহু ব্যবহারে জীর্ণ কাঠের হাতলওলা বেঞ্চে বসে ছিল ন্যাথানিয়েল গোবিন্দ সোরেন। সে কোনও কথা বলছিল না, কেবল মাঝে মাঝে তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলছিল আপন মনে। রেশমা আজ সকালের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপাতত তাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছে শেফালিকা। গতকাল রাতে বুধনের দায়িত্বে শেফালিকা ছিল। আর আজ যখন জানা গেল, বুধন মাহাতোর মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে, তখন সে আতংকিত হয়ে পড়েছে যে, তাহলে, কাল রাতে যার সঙ্গে সে কাটিয়েছে। তাহলে কি সে বুধনের প্রেতাত্মা? এতেই সে ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। মানুষ তার জীবনে এক-আধবার ক্ষণিকের জন্য হয়তো কোনও রহস্যময় অস্তিত্বের মুখোমুখি হতে পারে, কিন্তু সে ঘটনাও সকলের জীবনে ঘটে না! লাখে একটা ঘটে কি না সন্দেহ। আর এখানে সেই রহস্যময় অস্তিত্বের মুখোমুখি হওয়া নয়, তার সঙ্গে পাশাপাশি রাত কাটানো—এতটা চাপ রেশমা নিতে পারেনি। দুপুর থেকেই তার ধুম জ্বর এসেছিল। তাকে জ্বর কমানোর ওষুধ এবং সিডেটিভ দিয়ে কোনও মতে সামাল দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার আবার কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভেবে চিন্তিত সত্যব্রত।
কিন্তু চিন্তার কারণ কেবল রেশমা নয়, চিন্তার কারণ মনোরমাও। আজকের ঘটনা শুনে সে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে যে, পরশুর মধ্যে যদি সত্যব্রত কোনও ব্যবস্থা না নেয় কিংবা ওপরওলাকে চিঠি লিখে এখান থেকে ট্রান্সফারের তদ্বির করতে উঠেপড়ে না লাগে, তাহলে সামনের রবিবারেই সে বাপের বাড়ি চলে যাবে তার দুই সন্তানকে নিয়ে। যেখানে ভূত-প্রেত পর্যন্ত হেলথ সেন্টারে ধাওয়া করে, সপ্তাহখানেক আগে মারা যাওয়া ছেলে পেশেন্ট সেজে হেলথ সেন্টারে ভর্তি হয়, সেখানে মনোরমা তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রাণে ধরে থাকতে পারবে না। অনেকদিন থেকেই সে চেষ্টা করছিল কলকাতা ফিরে যাওয়ার, কিন্তু সত্যব্রত নানা কথা বলে তাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আটকে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়! এবার সে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে বলে জানিয়ে দিয়েছে আজ দুপুরে। ওরা ফিরে যেতেই পারে, কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করতেই পারে, তাতে আপত্তি নেই সত্যব্রতর। এখানে থাকলে তো ওই চার্চের স্কুলে ভর্তি না করিয়ে উপায় ছিল না। একটাই তো স্কুল যা মন্দের ভালো। কিন্তু কলকাতায় গেলে সে সমস্যা থাকবে না। যদিও ছেলে-মেয়ে দু’টি এখান থেকে চলে গেলে তারা বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে।

এই বয়স থেকে তারা যদি বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে লালিত-পালিত হয়, তাহলে পিতা এবং সন্তানের মধ্যে যে বন্ধন গড়ে ওঠা জরুরি, তা তো হবেই না। উপরন্তু ওদের বড় হওয়াটাও মিস করবেন তিনি। কোনও স্মৃতি থাকবে না, যা যে-কোনও পিতা-মাতার কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত। মনটা বিষণ্ণ লাগছিল তাঁর। তিনি তো ভালো করেই জানেন, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেউ আসতে চায় না, ফলে যাকে বলির পাঁঠা করা হয়, সে হাজার আবেদন করলেও কিছু হবে না, যতদিন না আর একটি বলির পাঁঠা জোটে। ছোটবেলায় পড়া ঘ্যাঁঘাসুরের গল্পের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। সেই নৌকার লোকটি যখন সেই দুষ্টু রাজার হাতে বৈঠা ধরিয়ে দিতে পারল, তখনই সে মুক্তি পেল সেই কাজ থেকে। তাঁর কপাল এতো ভালো না। একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, তারপর তাকালেন গোবিন্দের দিকে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২২: কেস কালাদেও: ফাইল নম্বর ১

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৪: বাড়ির চৌবাচ্চায় মাছ চাষ করে পরিবারের নিত্যদিনের মাছের চাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

গোবিন্দ থেকে থেকে মাথাটা নাড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে এখনও। আজ সকালের ঘটনা, জঙ্গল থেকে পাওয়া আধ-খাওয়া বুধনের লাশ তার উপরেও যে প্রভাব ফেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

সত্যব্রত একবার গলা পরিষ্কার করার আওয়াজ করলেন। গোবিন্দ যেন শুনতে পায়নি, আগের মতোই আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগলো। সত্যব্রত এবার শঙ্কিত হলেন। ভয়ে মাথার গণ্ডগোল হয়ে যায়নি তো লোকটার? তিনি আস্তে ডাকলেন, “গোবিন্দ!”

গোবিন্দ যথা পূর্বং তথা পরং। আবার ডাকলেন সত্যব্রত, “গোবিন্দ?”

গোবিন্দ মাথা তুলল। তার চোখ করমচার মতো লাল। কিন্তু তাকিয়েই রইল, কোন প্রত্যুত্তর দিল না।

সত্যব্রত আবার ডাকলেন, “গোবিন্দ! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে তুমি এখনই যাও। আমি তোমাকে ছুটি দিলাম। তাছাড়া তোমার ডিউটি আওয়ার তো শেষ, তুমি স্বচ্ছন্দে বাড়ি চলে যেতে পারো। বাকিটা আমি সামলে নেবো ঠিক!”

এবার গোবিন্দ মুখ খুলল, “সামলে নেবো বললেই কি নেওয়া যায়? একটা কালঝড় আসতে চলেছে ডক্টর সাহেব। অনেক রক্ত, অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে তবে হয়তো সেই ঝড় থামবে। তাতে আমরা কেউ নই। অদৃশ্য সেই অপশক্তির হাতের পুতুল মাত্র।”

সত্যব্রত অবাক হয়ে গেলেন। এখানে এতদিন আছেন, গোবিন্দের মুখে কখনও এ হেন দার্শনিক কথা শোনেননি। তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন যে, দুপুর রোদের গরমে এবং প্রায় অনাহারে গোবিন্দের মাথা বিগড়ে গিয়েছে। কোয়ার্টারে গিয়ে রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আবারও বললেন, “যাও, তুমি কোয়ার্টারে গিয়ে বিশ্রাম নাও গে যাও!”

গোবিন্দ মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “ডক্টর সাব, যে বুধন মাহাতোর রূপ ধরে এসেছিল সে তবে কে?”

“আমি কী করে জানবো বল গোবিন্দ? আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছি! আমি নিজেই এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি, কোন কূল-কিনারাই খুঁজে পাচ্ছি না! এরকমও কী হতে পারে? না কি কারও বিশুদ্ধ শয়তানি এ ভাবে আমাদের বিভ্রান্ত করছে?”
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

গোবিন্দ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলল, “যার মুখ মিষ্টি নয়, সে-ই পারবে বাঁচাতে! নচেত কেউ নয়!”

“মানে?” অবাক গলায় সত্যব্রত প্রশ্ন করলেন।
গোবিন্দ তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর কেমন ঘোরের মধ্যে আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করল, “যার মুখ মিষ্টি নয়, সে-ই পারবে বাঁচাতে! নচেত কেউ নয়!” বলেই গটগট করে চলে গেল ঘরের বাইরে।

সত্যব্রত ভোম্বলের মতো মুখ করে বসে রইলেন। “যার মুখ মিষ্টি নয় সেই পারবে বাঁচাতে”-র অর্থ কী? যে দেখতে সুন্দর নয়, সে-ই সকলের রক্ষাকর্তা? তাহলে তো তেমন মানুষ লাখে লাখে আছে, তাদের মধ্যে সে-ই বিশেষ ব্যক্তিটি কে, তা কী করেই বা খুঁজে পাবে সবাই? আচ্ছা, আবারও ভাবলেন তিনি, যদি হেঁয়ালির অর্থ এমন হয়, যার মুখ মিষ্টি নয়, অর্থাৎ কি না, একান্তই মুখরা এমন কেউ, তাহলে কী সে-ই পারবে এই অদ্ভুতুড়ে রহস্যের সমাধান করতে? পরক্ষণেই মনে এল, মনোরমার কথা। দিনরাত যা ঝগড়া করে, তার মুখে কেউ জন্মের সময় যে মধু দেয়নি, সে-ব্যাপারে সত্যব্রত নিশ্চিন্ত। তাহলে কি মনোরমার মতো মানুষের হাতেই রয়েছে এই রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মনোরমা তো কলকাতার মেয়ে। এই অঞ্চলের কিছুই চেনে না সে। জঙ্গল, টিলা এ-সব না কি তার একঘেঁয়ে লাগে। এ সব গাছপালা কেটে যদি শপিং মল, বাড়ির গায়ে বাড়ি, স্পা, দোকান-বাজার, ফুটপাত এঁটো করা ভীড়, কৃত্রিম পার্ক ইত্যাদি করা যেত, তাহলে না কি এই জায়গাটা মনুষ্য-বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠতে পারত। সে তো কোয়াটার্স ছেড়ে কোথাও বেরোতেই চায় না।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ‘কফস’ হল আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সেই ভয়ঙ্কর খাঁচা

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫: আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?

এখানে না কি পদে পদে সাপ আর বুনো জন্তুর আক্রমণের ভয়। যদিও এককালের জঙ্গল এখন মানুষের কল্যাণে অনেকটাই পাতলা। তার উপরে বুনো জন্তু নেই বললেই চলে। তবে সাপ আছে। কালাচ, শিয়রচাঁদা ইত্যাদি সাপের দেখা মেলে হরদম। জঙ্গুলে পথে কাঁকড়া বিছেরও দেখা মিলবে, তবে তারাও মানুষের কল্যাণে ক্রমশ কমে আসছে, একদিন হয়তো ডোদো পাখির মতোই লুপ্ত হয়ে যাবে। সত্যব্রতর মনে হয়, মানুষ এই সৃষ্টিকে যতখানি অসুন্দর করেছে, আর কোনও জীব ততটা নয়। হয়তো দেখা যাবে, এই কালাদেও-রহস্যও শেষ পর্যন্ত মানুষের কৃতকর্মের ফল। কিন্তু তাহলে, গোবিন্দের কথাটা? তার কী হবে? যদি ধরে নেওয়া যায়, তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, তাহলে এত গুছিয়ে সে কথা বলছে কী করে? তাছাড়া তার গলার স্বরের মধ্যে এমন এক দৃঢ়তা আছে, যার দরুন কথাটাকে উড়িয়ে দিতে পারা যাচ্ছে না।

অস্থির লাগছিল সত্যব্রতর। যে পারত এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে, সেই গোবিন্দই তো থেকেও নেই। তাহলে? কার কাছে যাবেন তিনি?—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content