রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত দোলাচল। এরকম সত্যি সত্যি ঘটছে না এটা আমার মনের ভুল সেটা আমি বুঝতে পারছি না।

— আপনি কে বলছেন?

— সব সময় পরিচয় এত জরুরি কেন? আপনার কোন অপরিচিত ফ্যান থাকতে পারেন না। তার সঙ্গে কথা বলার আগে কি আপনি আধার কার্ড চেক করেন?

— না মানতেই হবে আপনার কথা ভীষণ ইন্টারেস্টিং।

— সেই সুবাদে প্রায় মাঝরাতে ফোন করার অপরাধ কিছুটা লাঘব হবে কি?

— আমি কি বলেছি অপরাধ হয়েছে?

— হয়তো মনে মনে ভেবেছেন!

— আমি কি ভাবছি সেটা তো আপনি সম্ভবত আমার ভাবার আগেই বুঝতে পারছেন।
সেই অনাম্নী খিলখিল করে হেসে উঠলো।

— আপনার সেরকম মনে হচ্ছে বুঝি!

— হ্যাঁ তবে একটা কথা না বললেই নয়। পরিচয়ের আদিতে আছে নাম। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতায় আছে।

— সে তো অমিত আর লাবণ্যের পরিচিতি। আপনি অমিত নন আমিও লাবণ্য নই। আপনার লাবণ্যের নাম তো আফিফা!

— আপনি আফিফাকে চিনলেন কি করে? যদি নাও চেনেন। তার বিষয়ে আপনার জানারও তো কথা নয়।

— সেটাই তো রহস্য!

— দেখুন আমি নিশ্চিত বুনি ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ আমার সঙ্গে আফিফার কথাটা জানে না।

— ঠিক। ঠিক কথা।

— মানে।

— মানে আপনি যা বলছেন সেটাই ঠিক। এরা দু’ জন ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ জানেন না।

— তাহলে আপনি কি করে জানলেন? কে আপনি?

— আপনার সঙ্গে আমার এতবার দেখা হয়েছে। সুইমিং পুলে। আপনার বাড়ির সামনে। এমনকি আপনার হোটেল রুমে। নিচের ব্যাঙ্কোয়েটে।
আমার হাত-পা ঘামছে। বিছানার পাশে সাইডটেবল থেকে আমি জল খেলাম।

— হ্যালো! হ্যালো!

— আমি শুনছি।

— এগুলো আমি আসলে আমার মনের ভুল ভেবেছিলাম। ইদানিং আমার এটা হচ্ছে।

— হ্যালুসিনেশন

— বলতে পারেন।

— তাই সাইকোলজিস্ট এর থেরাপি নেবার কথা ভাবছেন?

— এক ডাক্তার বন্ধু বলেছিলেন। আমি এখনও জানিনা ঠিক কি করব।

— আমার মনে হয় আপনারা যারা লেখালেখি করেন, তাদের মধ্যে একটা স্প্লিট পার্সোনালিটি কাজ করে। একটা দ্বৈত সত্তা। আপনারা নিজেই নিজের মনকে ভাঙতে পারেন। হয়তো এই জন্য আপনাদের মুড সুইংও হয়। সৃষ্টি করতে গেলে তো পাঁচজনের মধ্যে থেকেও একটু আলাদা হতেই হয়।

—আচ্ছা একটা কথা আগে আমি যাদের মিট করেছি। আপনি বলছেন আগে আপনিই এসেছেন। কিন্তু তাদের গলার স্বর বা কথা বলার ধরন অন্যরকম। আই মিন আজকে আপনার সঙ্গে। মানে ব্যাংকোয়েটে বা এখন। আগের তাদের কোন মিল নেই।

—হতে পারে। আমরা তো এই পৃথিবীর কেউ নই। যে একই রকম দেখবেন। রোজ। সকাল বিকেল সন্ধ্যে।

—আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

— আমি ঠিক কী চাই তাই তো?

— হ্যাঁ মানে সেটাই বলবো ভাবছিলাম।

— বন্ধুত্ব।

— বন্ধুত্ব?

— হ্যাঁ বন্ধুত্ব। অদ্ভুত লাগছে না? অশরীরী আত্মার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে?

— নানা অদ্ভুত কিছু লাগছে না। আমার বরং বেশ কমফোর্টেবল লাগছে। মানে এটলিস্ট এটা বুঝতে পারছি যে সত্যিই এগুলো ঘটেছে একটাও আমার মনের ভুল নয়। ফলে মানসিকভাবে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার সঙ্গে একটা অতিজাগতিক বন্ধুত্ব হচ্ছে।

— আমি কিন্তুটা বুঝতে পারছি। আমার একটা নাম খুব জরুরি। তাই তো।

— হ্যাঁ।

— আপনার নাম থাকলেও আমি সেই নামে আপনাকে ডাকব না। কারণ নামটা আপনার বহিরঙ্গের। আত্মার কোন নাম হয় না। আমাকে আপনি মোহিনী বলে ডাকবেন। গুড নাইট।
কট করে ফোনটা কেটে গেল। এখন আমার কোন উৎকণ্ঠা নেই ভয় নেই। মানসিকভাবে বেশ তৃপ্ত লাগছে। ব্যাপারটা কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না সে ধরে বেঁধে সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে পাঠাবেই। কিন্তু একেবারে মনের ভেতরের গভীর গোপনে আমি একজন নিজস্ব বন্ধু পাব এটা আমাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। আজ রাতটা আমি খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো।

সাঁতার কাটলে বেশ খিদে পায়। ডাক্তারবাবুর নির্দেশে আমি অবশ্য ঠিক সাঁতার কাটি না। জলের মধ্যে চলবার চেষ্টা করি। এটাও যথেষ্ট শ্রম সাপেক্ষ। অন্তত আমার মতো ওজনের লোকের কাছে। একটা কথা মাঝে মাঝে মনে হয়। খিদে পেলে যদি খেয়েই ফেলি তাহলে রোগাটা হবো কি করে? নেটে বিস্তর ঘাটাঘাটি করে দেখেছি শুধু খেলেই মোটা হয় না, শরীর সেই খাবারটাকে ভাঙতে সক্ষম হলে তত সমস্যা নেই। এমন অনেক রোগা লোক দেখেছি যারা আমার থেকে যথেষ্ট বেশি খেয়েও বেশ রোগা পাতলা। ঝরঝরে। তাদের বিএমআর মানে ওই খাবার ভাঙার ক্ষমতা বা বেসিক মেটাবলিক রেট বেশি। এখানে আমার ঈশ্বরের উপর বেশ রাগ হয়।

হ্যাঁ, আমি ঘোরতর ঈশ্বরবিশ্বাসী তাই সৃষ্টিকর্তাকে সুপারপাওয়ার কেমিক্যাল এভলিউশন এসব না বলে সরাসরি ভগবান বলেই মানি। কারও কাছে তিনি আল্লাহ কারও কাছে গড। মানুষ যা গড়েছে সে তো কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি। সেই কবে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি স্বপ্ন দেখেছিলেন এরোপ্লেন হেলিকপ্টার বা সাবমেরিন-এর। তারপর ভাবতে ভাবতে ভাঙতে ভাঙতে জুড়তে জুড়তে এসব সত্যি হয়ে গেল। কিন্তু যিনি মানুষকে গড়েছেন তাঁর সৃষ্টিটা নিয়ে যদি একবার ভাবনা চিন্তা করা যায়। ধরা যাক মাথাটা সেখানে নার্ভ ইমপালস মানে ভাবনার তরঙ্গ চিন্তা দিয়ে বোধে পৌঁছে যায়। অসংখ্য সার্কিট বোর্ডকে ছোট্ট একটা জায়গায় ধরাতে ভদ্রলোক নরম ভাঁজ করা করা সার্কিটের কথা ভাবলেন। এই গোটা থলথলে সার্কিট বোর্ডকে শরীরের সবথেকে শক্ত হাড়ের কুঠুরির মধ্যে রাখলেন। গোটা শরীরটাকে এমন ভাগে ভাগ করেছেন যাতে এই কুঠুরি থেকে নার্ভের রজ্জু একটা ফ্লেক্সিবল হাড়ের পাইপ এর মধ্যে দিয়ে শরীরের সর্বাঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। এই ডেটা সেন্টারকে এবং শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সর্বক্ষণ জ্বালানি জোগাচ্ছে সেই অক্সিজেন এবং হরমোন নামের একটা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৭: সত্যিই চমকে উঠলাম, আমি কী ভাবছি তা উনি বুঝলেন কী করে?

| রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৯: কেস জন্ডিস

এই পাওয়ার জেনারেটারটা কিন্তু একটা শক্তপোক্ত হাড়ের খাঁচার মধ্যে। যেকোনও কারখানায় উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ বের হয় সেটা সরাবার ব্যবস্থা চালু না রাখতে পারলে মুশকিল। তাই তিনি একটা ক্লিনিং সিস্টেম দিয়েছেন। একজোড়া কিডনি। এখানে মজার কথা এই ক্লিনিং সিস্টেমটা আছে পিঠের দিকে তার পেছনে একটা শক্তপোক্ত পেশির চাদর আছে। হাত-পা কাজ করে তাই সেখানে কোনও গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক অঙ্গের ডিজাইন তিনি করেননি। অক্সিজেন না হলে শরীর চলবে না তাই নাকের সঙ্গে মুখের বাইপাস রেখেছেন। দেখার জন্য দুটো চোখ শোনার জন্য দুটো কান শ্বাস নেওয়া বা ছাড়ার জন্য নাকের দুটো ফুটো সেই সঙ্গে মুখ। দুটো হাত দুটো পা দুটো কিডনি দুটো ফুসফুস। একটা করে অল্টারনেটিভ সাপোর্ট সিস্টেম। মাথা একটা। শিরদাঁড়া একটা। হৃদপিণ্ড একটা। পাকস্থলী একটা।

এরকম একটা অসাধারণ মেশিনকে ডিজাইন করে জটিল একটা কোডিং সিস্টেম যার নাম জিন। সে আবার শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন যিনি এত জটিল জিনিস এভাবে বানাতে পারেন। তিনি তো মানুষের তৈরি যন্ত্রের মত প্রটোটাইপ করতে পারতেন। যেমন হাতুড়ি পেরেক সেফটি পিন চামচ একই রকম দেখতে। একই কাজ করে। তা তিনি করেননি।তিনি তার সৃষ্টির মধ্যে উনিশ-বিশ করেছেন। সেই সূক্ষ্ম বদলের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে কিন্তু ক্রোমোজোম আর জিনের মধ্যে। কেউ লম্বা কেউ বেঁটে। কেউ মোটা কেউ রোগা। কেউ খুব দ্রুত ছুটতে পারেন। কেউ দ্রুত অংক করতে পারেন। কেউ সুন্দর অভিনয় করেন।কেউ সুন্দর গান করেন। কেউ ভালো লেখেন। কেউ শাসন করতে ভালোবাসেন। কেউ শাসন মেনে নিতে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

আমরা যেমন আমাদের দৈনন্দিন কাজের প্রয়োজনে হাতুড়ি পেরেক সেফটিপিন চামচের রকমফের করি। তবলা ঠোকার হাতুড়ি আর দেওয়ালের পেরেক মারার হাতুড়ি এক রকম নয়। জেলের পাথর ভাঙ্গার হাতুড়ি অন্যরকম। জুতোর পেরেক দেওয়ালের পেরেক আলাদা। মোটা লোহার গজালোও এক রকমের পেরেক। সেফটি পিন এর কত ভাগ। গোল লম্বা তে-কোণা বড় ছোট। হাতাও চামচ আবার চায়ে চিনি দিতেও চামচ। ডাঁটির কত রকমফের। তেমনি মানুষের জীবন সভ্যতা সমাজ চলতে গেলে এই নানা রকমের মানুষের প্রয়োজন আছে। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে এই দুনিয়া।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৫: আমাদের নাকি রোজই চুল পড়ে!

হঠাৎ আমার মনে হল এখনই আমি দুর্গাপুর স্টেশন থেকে রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়া শতাব্দী এক্সপ্রেস উঠেছি। কলকাতা ফিরব। এত কিছু থাকতে আমি মানুষের শরীর নিয়ে ভাবছি কেন? মনে পড়ল গতকাল রাতে মোহিনীর কথাগুলো। মন বা মস্তিষ্কের যে ভাবনার রকম ফের – তাতেই আমার সৃষ্টিরা তৈরি হয়। আবার সেই মনে মনেই আমার মোহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। সবেমাত্র কাল রাতে।

হঠাৎ চলন্ত ট্রেনের জানালার বাইরে নজর চলে গেল। বাইরেটা অন্ধকার হলেও ট্রেনের ভেতরের জোরালো আলো লাইনের পাশটায় অনেকটা অংশ স্পষ্ট আলোয় দেখা যাচ্ছে। আমি চমকে উঠলাম। একটি কিশোরী মেয়ে হাতে একটা পুতুল ধরে ট্রেন লাইনের একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথার চুলটা পেছন থেকে এসে মুখটাকে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি কি লাইনে ঝাঁপাতে চাইছে? আমি কি চেন টানবো। থমকে দেবো শতাব্দীর গতি? —চলবে
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content