অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।
বুধনকে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উঁচু টেবিলের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে শুয়ে থেকে থেকে সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। শেফালিকাদি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। সত্যব্রত কাছে যেতেই বললেন, “ডাক্তারবাবু, পেশেন্টকে তো মনে হচ্ছে আগে একটা আইবোপ্রুফেন ইনিজেকশন দিলে ভালো হয়। আপনি দেখুন। যদি বলেন, আমি ইনজেকশন রেডি করি।”
শেফালিকাদির বয়স হয়েছে। আগে অন্য হেলথ সেন্টারে ছিলেন। সত্যব্রত ওপরওয়ালা হলেও এই কিছুদিনের ভিতরেই দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক এসে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে-থা করেননি। বাপ-মা মরা ভাইঝিকে মানুষ করছেন। তাঁর পরামর্শের দাম আছে। তবুও সত্যব্রত আগে দেখতে চাইল। ভালো করে এক্সামিন না করে কোন ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলে অন্য বিপদ হতে পারে। আর সব শুনে মনে হচ্ছে, এটা সহজ কোন কেস না।
কোন রোগ সঠিকভাবে বুঝতে গেলে রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলাই যে সঠিক পথ, এ-ব্যাপারে সব ডাক্তারই একমত হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সত্যব্রত হতাশ হল। সে থরো চেকআপ করেও কিছুই বুঝতে পারছিল না। একজন পুরুষের দেহে যে লক্ষণগুলি ফুটে উঠছে, তা একমাত্র গর্ভাবস্থায় থাকা নারীশরীরেই দেখা পাওয়া সম্ভব। এদিকে বুধন কিছুই বলতে পারছিল না। তার যন্ত্রণার ধরণ কেমন, কখন বাড়ে বা কমে, অন্য সমস্যা কী হচ্ছে—এসব কিছুই জানা গেল না। এ-ব্যাপারে যতই প্রশ্ন করা হোক না কেন, সে দুর্বোধ্য কিছু কথা বলে চলল কেবল। যেমন—তার কী কষ্ট হচ্ছে জানতে চাওয়ায় সে বলল, “কিং ইজ কামিং! নো পেইন, নো গেইন…!”
শেফালিকাদির বয়স হয়েছে। আগে অন্য হেলথ সেন্টারে ছিলেন। সত্যব্রত ওপরওয়ালা হলেও এই কিছুদিনের ভিতরেই দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক এসে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে-থা করেননি। বাপ-মা মরা ভাইঝিকে মানুষ করছেন। তাঁর পরামর্শের দাম আছে। তবুও সত্যব্রত আগে দেখতে চাইল। ভালো করে এক্সামিন না করে কোন ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলে অন্য বিপদ হতে পারে। আর সব শুনে মনে হচ্ছে, এটা সহজ কোন কেস না।
কোন রোগ সঠিকভাবে বুঝতে গেলে রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলাই যে সঠিক পথ, এ-ব্যাপারে সব ডাক্তারই একমত হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সত্যব্রত হতাশ হল। সে থরো চেকআপ করেও কিছুই বুঝতে পারছিল না। একজন পুরুষের দেহে যে লক্ষণগুলি ফুটে উঠছে, তা একমাত্র গর্ভাবস্থায় থাকা নারীশরীরেই দেখা পাওয়া সম্ভব। এদিকে বুধন কিছুই বলতে পারছিল না। তার যন্ত্রণার ধরণ কেমন, কখন বাড়ে বা কমে, অন্য সমস্যা কী হচ্ছে—এসব কিছুই জানা গেল না। এ-ব্যাপারে যতই প্রশ্ন করা হোক না কেন, সে দুর্বোধ্য কিছু কথা বলে চলল কেবল। যেমন—তার কী কষ্ট হচ্ছে জানতে চাওয়ায় সে বলল, “কিং ইজ কামিং! নো পেইন, নো গেইন…!”
শেফালিকাদি বললেন, “ছেলেটা একটা নসিয়ায় আছে মনে হচ্ছে। রূপকথার গল্প বলছে। ও হয়ত মনে মনে কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন। সেখানে রাজা-রানি আছে, রাজপুত্র আছে, হয়ত রাজকন্যাও। আচ্ছা ডাক্তার আচার্য এটা প্রেম-ঘটিত মানসিক সমস্যা নয় তো? এই বয়সে এমনটা হওয়া তো বিচিত্র নয়!”
“হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই। ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতেই হবে। কারণ, ওর বেবি বুমে হাত রেখে আমিও ফিল করেছি, ওটার মধ্যে কিছু নড়াচড়া করছে। সাধারণ কোভেদ সিনড্রোম বলে ভেবেছিলাম, যদিও সেটা এই বয়সের একজন অবিবাহিত ছেলের পক্ষে অস্বাভাবিক। আজ অবধি দ্বিতীয়টি দেখা গিয়েছে কি না জানা নেই। কোনও মেডিকেল জার্নালে পড়িনি কখনও। আমি নিজেই বিভ্রান্ত বোধ করছি। কী হতে পারে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
“আমার মতে ওকে আজ ইঞ্জেকশন দিয়ে এখানেই রাখা হোক। কাল সকালে দরকার হলে সদরে কিংবা যদি চান চার্চের হসপিটালের সাহায্য নিয়ে করা যাবে। ওদের ওখানে আলট্রাসোনোগ্রামের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক, অন্য কিছু মানসিক সমস্যা থেকে হচ্ছে কি না। এমন হতেই পারে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ছিল। তার থেকেই বাড়াবাড়ি হয়েছে। এখন তো ইঞ্জকশন দেওয়া হোক।”
“হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই। ওর বাড়ির লোকের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতেই হবে। কারণ, ওর বেবি বুমে হাত রেখে আমিও ফিল করেছি, ওটার মধ্যে কিছু নড়াচড়া করছে। সাধারণ কোভেদ সিনড্রোম বলে ভেবেছিলাম, যদিও সেটা এই বয়সের একজন অবিবাহিত ছেলের পক্ষে অস্বাভাবিক। আজ অবধি দ্বিতীয়টি দেখা গিয়েছে কি না জানা নেই। কোনও মেডিকেল জার্নালে পড়িনি কখনও। আমি নিজেই বিভ্রান্ত বোধ করছি। কী হতে পারে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
“আমার মতে ওকে আজ ইঞ্জেকশন দিয়ে এখানেই রাখা হোক। কাল সকালে দরকার হলে সদরে কিংবা যদি চান চার্চের হসপিটালের সাহায্য নিয়ে করা যাবে। ওদের ওখানে আলট্রাসোনোগ্রামের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক, অন্য কিছু মানসিক সমস্যা থেকে হচ্ছে কি না। এমন হতেই পারে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ছিল। তার থেকেই বাড়াবাড়ি হয়েছে। এখন তো ইঞ্জকশন দেওয়া হোক।”
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৫: আর্য কোথায়?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল
বিভ্রান্ত সত্যব্রত সায় দিল। আপাতত এর চেয়ে ভালো কোন পথ সে দেখতে পাচ্ছিল না। রেশমা পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। শেফালিকাদি তাকে ইঞ্জেকশন রেডি করতে বললেন। সত্যব্রত তাকিয়ে দেখছিল বুধনকে। কালো কষ্ঠিপাথরের মতো গায়ের রঙ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। মুখ-চোখ কেমন যেন শুকনো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, কিন্তু কিছুই দেখছে না। যেন কোনও অন্য জগতে বিচরণ করছে সে। মাঝে একবার জানালার দিকে তাকাল। হেলথ সেন্টারের জানালার পাশেই একটা লাল পলাশের গাছ। তাতে রাশি রাশি ফুল ধরে আছে। আঁধার নেমে আসবে আর একটু পরেই। পলাশের রঙ গাঢ় কালচে রক্তের মতো দেখাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়েই সে একবার উচ্চারণ করল, “নুনিয়া…!”
চমকে উঠল সত্যব্রত। ছেলেটা কি তার অসুস্থতার একমাত্র সঙ্গী নুনিয়াকে খুঁজছে? না কি এটাই নুনিয়ার আসার সময়, যার জন্য বুধন নুনিয়াকেই এক্সপেক্ট করছে এখন? আচ্ছা, এমন নয় তো যে শেফালিকাদি যেম বলছিল, তেমনটা হয়েছে। ওয়ার্কশপে বুধন ক্লাস করতে যেত, নুনিয়াও সেখানেই থাকে। ফলে তাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তা নিয়ে কেউ হয়তো কিছু বলেছে, মারধোরও করে থাকতে পারে, এই জন্যই সে একটা ট্রমায় ভুগছে! ভালো করে অনেক কিছু খবর না নিলে কীভাবে এই জটিল রোগের নিরাময় সম্ভব তা ভেবে পেল না সত্যব্রত।
চমকে উঠল সত্যব্রত। ছেলেটা কি তার অসুস্থতার একমাত্র সঙ্গী নুনিয়াকে খুঁজছে? না কি এটাই নুনিয়ার আসার সময়, যার জন্য বুধন নুনিয়াকেই এক্সপেক্ট করছে এখন? আচ্ছা, এমন নয় তো যে শেফালিকাদি যেম বলছিল, তেমনটা হয়েছে। ওয়ার্কশপে বুধন ক্লাস করতে যেত, নুনিয়াও সেখানেই থাকে। ফলে তাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তা নিয়ে কেউ হয়তো কিছু বলেছে, মারধোরও করে থাকতে পারে, এই জন্যই সে একটা ট্রমায় ভুগছে! ভালো করে অনেক কিছু খবর না নিলে কীভাবে এই জটিল রোগের নিরাময় সম্ভব তা ভেবে পেল না সত্যব্রত।
আরও পড়ুন:
ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৪: পুতুলের মাথায় কোঁচকানো সোনালি চুল, চোখ দুটো কেমন যেন অদ্ভুত, কিন্তু এটা আমায় কে পাঠালো?
চলো যাই ঘুরে আসি: মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা
শেফালিকাদি ইঞ্জেকশন নিয়ে এগিয়ে গেলেন। রেশমাকে ছেলেটির হাত চেপে ধরতে বললেন। মানসিকভাবে রোগী অসুস্থ। ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় হাত-পা ছুঁড়লে বিপদ। রেশমা চেপে ধরতেই একটা কাণ্ড হল। বেডের উপর উঠে বসল বুধন। তারপ হিসহিসে গলায় যেন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করল, “বোকার দল…আঁধার ঢুকে পড়েছে… রাজা আসছেন… প্রস্তুত হও! রাজার রাজধানী পিশাচ পাহাড়!” বলে গলা তুলে হাহাহা করে হাসতে লাগল আর মাথা ঝাঁকাতে লাগল আনন্দে। রেশমা একা তাকে সামলাতে পারে না কি? সত্যব্রত এগিয়ে গিয়ে শেফালিকাদির হাত থেকে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে বলল, “দিদি, আপনিও ধরুন। পেশেন্ট যেভাবে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে তাতে রেশমার একার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি।”
ইঞ্জেকশন দিতেই কিছু সময়ের মধ্যে বুধন এলিয়ে পড়ল। তাকে শুইয়ে দেওয়া হল আস্তে আস্তে বেডের উপর। গোবিন্দকে ডেকে বলতে যাবে যে, একে তুলে একটা জেনারেল বেডে দিয়ে দিতে। এমন সময় খোলা জানালার দিকে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে গেল। জানালা দিয়ে টেবিলে শায়িত বুধনের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুনিয়া। তার মুখ গম্ভীর।
ইঞ্জেকশন দিতেই কিছু সময়ের মধ্যে বুধন এলিয়ে পড়ল। তাকে শুইয়ে দেওয়া হল আস্তে আস্তে বেডের উপর। গোবিন্দকে ডেকে বলতে যাবে যে, একে তুলে একটা জেনারেল বেডে দিয়ে দিতে। এমন সময় খোলা জানালার দিকে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে গেল। জানালা দিয়ে টেবিলে শায়িত বুধনের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুনিয়া। তার মুখ গম্ভীর।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২১: ক্যানসার মানেই মৃত্যু?
দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর
সত্যব্রত এত অবাক হল যে বলার নয়। এই সাঁঝবেলাতে নুনিয়ার বয়সী কারুরই চার্চের হোস্টেলের বাইরে থাকা নিয়ম নয়। নিশ্চয়ই সেখানে সন্ধ্যার সময় সমস্ত আবাসিক উপস্থিত কি না খোঁজ করা হয়। অ্যাটেনডেন্সও থাকতে পারে। তাহলে নুনিয়া এ-সময় সেখানে অনুপস্থিত থাকলে হয় সকলে তাকে খুঁজবে, নয়তো এই অপরাধেই তাকে হোস্টেল থেকে তাড়িয়েও দিতে পারে। তার উপর হেলথ সেন্টার থেকে চার্চের দূরত্ব কম নয়। মিনিট পঁচিশেক তো বঠেই। এই ভরা সাঁঝের বেলা নুনিয়া সেখানে ফিরে যাবেই বা কীভাবে? সে চেঁচিয়ে ডাকল, “নুনিয়া? তুই এখানে?”
শেফালিকাদি বললেন, “নুনিয়া? এখন? এখানে? কোথায় ডাক্তার আচার্য?”
জানালার দিকে হাত তুলে দেখাতে গিয়ে সত্যব্রত দেখল, পলকের জন্য শেফালিকাদির প্রশ্ন শুনে তাঁর দিকে সে যখন তাকিয়েছিল, সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে নুনিয়া। ওরা কেউই তখন বুধনের দিকে তাকায়নি। তাকালে দেখতে পেত, বুধনের মুখে একটা অদ্ভুত বিজাতীয় হাসি ফুটে উঠেছে।—চলবে
শেফালিকাদি বললেন, “নুনিয়া? এখন? এখানে? কোথায় ডাক্তার আচার্য?”
জানালার দিকে হাত তুলে দেখাতে গিয়ে সত্যব্রত দেখল, পলকের জন্য শেফালিকাদির প্রশ্ন শুনে তাঁর দিকে সে যখন তাকিয়েছিল, সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে নুনিয়া। ওরা কেউই তখন বুধনের দিকে তাকায়নি। তাকালে দেখতে পেত, বুধনের মুখে একটা অদ্ভুত বিজাতীয় হাসি ফুটে উঠেছে।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।