শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


রাসসুন্দরী দাসী।

মেয়েটি বসে বসে অঝোরে কাঁদছে। মায়ের কাছ থেকে একটি বোঁচকা নিয়ে সখীর সঙ্গে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল। মেয়েটি বড় ভীতু। কথায় কথায় চোখে জল আসে। সেই সুযোগে সমবয়স্করা ঠকিয়ে নেয়। আঘাত করে। মেয়েটি শুধু দয়াময়কে ডাকে। তার মা বলেছেন, কষ্ট হলে দয়াময় আছেন। যারা অন্যকে আঘাত করে, তাদের ছেলেধরা ধরে নিয়ে যায়। মেয়েটি ভাবে, যারা তাকে আঘাত করছে তাদের যদি ছেলেধরা ধরে নিয়ে যায়? তখন? আবার চোখে জল আসে। বিনয়ী এক মেয়ের গল্প বলি আজ? রাসসুন্দরী দেবী। ছোটবেলা থেকে ভয়, ত্রাস আর দুঃখে তাঁর চোখে জল আসত।

অনেকেই বলতেন, ‘উনি একটি সোহাগের আরসী, কিছু না বলিলেই কাঁদিয়া উঠেন।’ মেয়েদের জন্য উনিশ শতক ছিল প্রায় অন্ধকার যুগ। নারীশিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছে সদ্য! কিন্তু মেয়েদের দুটি সমান্তরাল জীবন চলছিল তখন! একদিকে অন্তঃপুরবাসিনীরা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যন্ত্রের মতো জীবনযাপন করছিলেন। অন্যদিকে কিছু মেয়ে ধীরে ধীরে শিক্ষার আলো দেখছেন। পুরনো সময় যেন গড়িমসি করে আড়মোড়া ভাঙছে। সমাজের চোখে মেয়েদের লেখাপড়া করা তখন পাপ। এইরকম সময় একান্নবর্তী বিরাট পরিবারের একগলা ঘোমটা দেওয়া এক নিরক্ষর গৃহিনী কেমন করে লিখে ফেললেন একটি আত্মজীবনী এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অমর হয়ে গেলেন সেকথা রূপকথার মতোই অবিশ্বাস্য।
আত্মজীবনী লেখা খুব সহজ নয়। লেখককে অকপট হতে হয়। মধ্যযুগের বাংলায় কিছু চৈতন্যজীবনীগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মজীবনী? নাহ্! মঙ্গলকাব্যের আত্মপরিচয়জ্ঞাপক পদগুলিতে লেখকের জীবন সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিজেকে লুকিয়ে রাখার মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। বাঙালি লেখকরা কিন্তু আত্মজীবনী লিখলেন না। অন্তত রাসসুন্দরীর আগে লিখলেন না। রামমোহন, মধুসূদন নিজের জীবনী সম্পর্কে নীরব। বঙ্কিমচন্দ্রও চরিত্রের ছদ্মবেশে অনেক কথা বললেন। কিন্তু আত্মজীবনী এল না তাঁর কলমে।

আত্মজীবনী একধরণের কনফেশন— সমালোচক গোলাম মুরশিদ একথা বলেছেন। কিন্তু আমরা সমালোচকের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলাম না। কেন? আসলে একটি একলা মেয়ের কাছে পিতৃগৃহ ছেড়ে আসার ঘটনা আজও বেদনাদায়ক। রাসসুন্দরী শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে পরাধীন, পিঞ্জরের পাখি বলেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল কম। পরচর্চা তাঁর ভালো লাগত না। তাই পড়া ও লেখাকেই নিজের প্রকাশের ভাষা বানিয়েছিলেন। দয়াময় বা আধ্যাত্মিক আশ্রয়ের অন্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও থাকতে পারে। প্রসঙ্গে আসি। একজন বাঙালি কিন্তু সকলের অজান্তে লিখতে শুরু করলেন আত্মজীবনী। নীরবে, অপ্রত্যাশিতভাবে। তিনিই রাসসুন্দরী। তাঁকে আলাদা করে ‘লেখক’ বা ‘ লেখিকা’র বা ‘মহিলা লেখক’ এর তকমা না দিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীকারের মর্যাদা দেওয়া যায়।
গল্প শুরুরও তো একটা গল্প থাকে। রাসসুন্দরীর গল্পের শুরু পাবনার এক অজ পাড়াগাঁয়ে, পোতাজিয়া গ্রামে। পিতৃহীন মেয়েটি মায়ের যত্নে মানুষ। অপরূপ সুন্দরী রাসসুন্দরী সকলের আদরে বড় হয়েছিলেন বলেই হয়তো একটু মুখচোরা লাজুক ছিলেন। বাড়িতে মুখ ফুটে চাইবার আগেই সব কিছু পেয়ে যেতেন। হয়তো তাই নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পাননি। বছর আটেক বয়স থেকে অভিভাবকরা রাসসুন্দরীকে রেখে আসতেন বাড়ির পাঠশালায় মেমসাহেবের সামনে। লেখাপড়া তখন বাঙালি মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। কাজেই মেমসাহেব তাঁকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টাও করেননি। নিয়মিত বসে থাকাই তাঁর কাজ ছিল। তবে প্রখর বুদ্ধিমতি স্থিতধী মেয়েটি শুনে শুনে পড়তে শিখে গেলেন। সাইকোলজির ভাষায় যাকে বলে ‘Deep listening’! লেখা শেখা হবে আরো পরে।

এর মধ্যে রাসসুন্দরী বিবাহিত। সরল একটি মেয়ের জীবনের এই পরিবর্তন তাঁর মনের মধ্যে অনেক না বলা কথার জন্ম দিল। অপ্রকাশিত মনের ভাবগুলি প্রকাশের পথ খুঁজতে লাগল। শ্বশুরবাড়ি বা স্বামী খুব প্রতিকূল ছিলেন না। কিন্তু রাসসুন্দরীর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা ছিল তাঁর ভীরু স্বভাব। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বাস্তবিক ভয়টি আমার প্রধান শত্রুছিল।’ এই ভয় আসলে লোকনিন্দার ভয়। উনিশ শতক কেন? এই যুগের অনেক মেয়েও এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেন না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১: চন্দ্রাবতী—বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছন্দের আড়ালে প্রতিবাদী কবি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী

যাইহোক রাসসুন্দরীর বাবা ছিলেন পদ্মলোচন রায় এবং স্বামী ফরদিয়া গ্রামের নীলমণি রায়। রাসসুন্দরী অতিশৈশবেই পিতৃহীন হয়েছিলেন। স্বামী মানুষটিকে ‘বেশ ভালো’র তকমা দিলেও বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি। রাসসুন্দরীর জীবনে তীব্র প্রভাব ছিল তাঁর মায়ের। মায়ের আধ্যাত্মিকতা তাঁর মধ্যে ছিল। ‘দয়াময়’ যে আর কিছু নয় একটা তীব্র ভক্তি ও বিশ্বাস— এটা বুঝেই ভীরু কোমল মেয়েকে মা এই সম্পদ দান করেছিলেন। এই সম্পদই রাসসুন্দরীকে বিপুল সংসারসমুদ্র পার করতে সাহায্য করে।

শাশুড়ির অবর্তমানে একটি বিরাট পরিবারের কর্ত্রী আর বহুসন্তানবতী এক নারীর অনেকদিন খাওয়াই হত না। ঘোমটার আড়াল থেকে নিজের ঘরটুকুই ভালো করে দেখতে পেতেন না, তো পৃথিবী!তবু মেয়েটির লেখাপড়ার ইচ্ছে হল। পুথি পড়ার পুথি লেখার। অথচ ১৮ থেকে ৪১ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমাগত সন্তানের জন্ম দিতে থাকা মেয়েটি সংসারের কর্ত্রী হয়েও স্বামীর ঘোড়াটির দিকেও তাকাতে পারতেন না। শুধু দয়াময়কে ডাকতেন। একদিন বুঝি দয়াময় সাড়া দিলেন। রাতের স্বপ্নে রাসসুন্দরী দেখলেন, তিনি চৈতন্যভাগবত ’ পড়ছেন। পড়ার ইচ্ছে তীব্র হল। অথচ উপায়? বাড়িতে অজস্র বইয়ের মধ্যে কেমন করে চিনবেন চৈতন্যভাগবত?পরেরদিনই ঘটল আরেকটি অলৌকিক ঘটনা।

রাসসুন্দরীর স্বামী তাঁর আটবছরের ছেলে বিপিনকে এসে বললেন —‘আমার চৈতন্যভাগবতটি পুস্তকখানি থাকিল। আমি তোমাকে লইয়া যাইতে বলিলে তুমি লইয়া যাইও।’ রাসসুন্দরী চমকে উঠলেন। দয়াময়ের ইঙ্গিত ধরতে পারলেন। কাঠের আড়িয়ায় লাগানো ছবি দেখে বইটি চিনে রাখলেন। গোপনে পড়া শুরু হল। জীবনে শোক তাপ দুঃখ বেদনার ঝড়ঝাপটা আসে যায়। রাসসুন্দরী গোপনে উনোনের মধ্যে বইয়ের পাতা লুকিয়ে পড়তে থাকেন। কেউ জানতেও পারে না। উনিশ শতকের এক লেখকের নির্মাণপর্ব চলছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৭: তেজস্ক্রিয় স্যান্ডউইচ

রাসসুন্দরী লিখছেন,‘ আমার মন ষড়ভুজ হল। ’ধীরে ধীরে রামায়ণ, মহাভারত, বৈষ্ণব সাহিত্যপাঠ শেষ হল। তাঁর বিধবা ননদেরা রাসসুন্দরীর পড়ার কথা জেনে চমকে উঠলেন। তাঁরাও রাসসুন্দরীর কাছে পড়া শিখলেন। তখনও লিখতে পারেন না রাসসুন্দরী। লেখা শিখলেন ছেলে কিশোরীলালকে চিঠি লেখার তাগিদ থেকে। তারপর যখন তাঁর উনষাট বছর বয়স তখন স্বামীবিয়োগ হয়। সেই আমলে বৈধব্য বড় যন্ত্রণার ছিল। তখন ১৮৬৯ সাল। এক বৈরাগ্য তাংর অপ্রকাশিত কথাগুলি লিখতে প্রেরণা দেয়। রাসসুন্দরী সৃজনশীল ছিলেন। তাঁর তৈরি পুতুল বড় প্রাণবন্ত হত।

১৮৭০ সাল থেকে রাসসুন্দরীর অক্ষরযাপন শুরু হয়। আত্মজীবনী প্রকাশিত হল। রাসসুন্দরীর ইচ্ছাপূরণ হল। তারপর তিনি আত্মজীবনীর দ্বিতীয় পর্ব লেখা শুরু করলেন। পঁচাশি বছর বয়স থেকে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল আর শেষ হল অষ্টআশি বছর বয়সে। তাঁর লেখা শেষ হতেই পৌত্র সরসীলাল সরকার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করেন। রাসসুন্দরীর মৃত্যু হয় ১৮৯৯ সালে। এই বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। রাসসুন্দরীর পৌত্রী সরলাবালা কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪২: আন্তোনিয়োর মুখোমুখি

রাসসুন্দরী সকল যুগের মেয়েদের কাছেই প্রেরণা স্বরূপ। তাঁর লেখাই ছিল তাঁর পুজো। তাঁর চোখের জল, বিনয় এবং কৃষ্ণের প্রতি নিষ্ঠা দেখে মনে হয় তিনি যেন কোনো শাপভ্রষ্ট বৈষ্ণবসাধক ছিলেন। অসীম প্রতিভা গোপনে নিয়ে এসেছিলেন। একগলা ঘোমটার আড়ালে তাঁর সংসারযাত্রা যেন তপস্যা। ধর্মের তাগিদে লেখা হলেও উনিশ শতকের সমাজব্যবস্থা, মেয়েদের জীবনযাত্রা, সেকালের পেশা, নেশা সবকিছুই উঠে এসেছে তাঁর কলমে। দাম্পত্যের সংজ্ঞাও আলাদা ছিল। মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে রাসসুন্দরীর মৃদুভাষণ আক্ষেপের মতোই শোনায়। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে মন্তব্য করেন। কৃষ্ণকে বলেন, ‘অধিকারী মশাই’! জীবনের যাত্রাপালার অধিকারী। রাসসুন্দরীর পৌত্রী সরলাবালার লেখা ‘হারানো অতীত’ থেকেও জানা যায় রাসসুন্দরীর দয়ামাধব তাঁর কাছে। জীবন্ত ছিলেন।

আত্মজীবনীতে তাঁ লেখা কিছু কবিতাও ছিল। একটিতে এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘সাপ হয়ে কামড়াও, ওঝা হয়ে ঝাড়ো। / হাকিম হয়ে হুকুম দাও, পেয়াদা হয়ে মারো।’ নিজের পুত্রের দুর্ঘটনা, আরেক পুত্রের মৃত্যু তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। একবার নিজে মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন। আসলে জীবনে কিছু করার ছিল তাঁর। পৃথিবীকে দেখানোর ছিল ভক্তি ও বিশ্বাসের জোর ঠিক কতখানি। লেখায় ভাবালুতা, পুনরাবৃত্তি বানানের সমস্যা আছে। কিন্তু তবু লেখাটি সেইসময়ের এক অকপট নিশ্চিন্ত দলিল। কৈলাসবাসিনী দেবী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়, ১৮৭৫ সালে। সেইকারণে তিনিই বাংলার প্রথম আত্মজীবনীকার। বাংলা সাহিত্যের এক সাহসী দৃষ্টান্ত।

সহায়ক বই
আমার জীবন, রাসসুন্দরী দেবী
নারী প্রগতির একশো বছর — রাসসুন্দরীথেকে রোকেয়া, গোলাম মুরশিদ
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content