বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


শোভনাসুন্দরী।

লেখকের জন্ম লেখক পরিবারে হলে সে বড় ভালো কাণ্ড! তবে উনিশ শতক, সে তো বড় সহজ সময় ছিল না। মেয়েদের যেখানে পালকি সমেত জলে ডুব দেওয়ানো হত, সেখানে এক মহিলার লেখকের জন্ম! কঠিন আবেগের পথ পার করে একটি মেয়ের খাতায় শব্দের কুসুম ফুটে উঠত। তার চারপাশে অনেক ভ্রুকুটি, নিন্দা মন্দ, ছি ছি-র ঝড় পেরিয়ে মেয়েটি লিখে ফেলতেন মনের কথা। কত আবেগের চাপাচুপি! কত ছদ্মবেশী চরিত্র! সব মিলিয়ে সে এক জটিল তত্ত্বের মতো!
অনেকদিন আগেকার কথা! জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পুরনো দালান, কড়িবরগায় কতই না গল্প জমাট বাঁধা হয়ে আছে। নস্টালজিয়ার মলাট খুলে সেসব গল্পের প্রচ্ছদ দেখতে হয়। অবাক হতে হয় মনে মনে। যে বিপুল কর্মপ্রবাহ এই ঠাকুরবাড়ির উৎস থেকে প্রবাহিত হয়েছিল সেই আমলের সমাজের স্তরে স্তরে, সে প্রবাহ একটা যুগ বদলের ক্ষমতা রাখে। আজ ঠাকুরবাড়ির একটি জ্ঞানপিপাসু মেয়ের গল্প বলি। সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি সাহিত্যধারার চর্চা তিনি করে গিয়েছিলেন। লোকসাহিত্যের চর্চা! সুদূর রাজস্থানের জয়পুরে গিয়েও ঠাকুরবাড়ির শিকড় এক আশ্চর্য জ্ঞানবৃক্ষের জন্ম দিয়েছিল শোভনাসুন্দরীর মনে। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম কন্যা শোভনাই হোক আমাদের আজকের কথকতার নিউক্লিয়াস। সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগের কেন্দ্রে পদ্মাসনে আজ হোক তাঁর অধিষ্ঠান।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

রবি ঠাকুরের পরিবারের মেয়ে শোভনা। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখার চেয়ে তিনি স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারীর ‘কাহাকে’ অনুবাদ করতে করতে শোভনা স্বপ্ন দেখতেন লেখক হওয়ার। বইয়ের পাতায় কালো হরফে স্বপ্ন বুনে দেওয়ার কথা মনে মনে ভাবতেন আর শুরু হয়েছিল শোভনার লেখক জীবনের প্রস্তুতিপর্ব! শোভনার সঙ্গে বিয়ে হয় হাওড়া শিবপুর এলাকার ইংরেজির অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর উৎসাহ ও প্রেরণা শোভনাসুন্দরীর লেখকজীবনে এক নতুন পর্ব শুরু করে দিল। তাছাড়া ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মানেই সে-সময়ের আলোকবর্তিকা। কাজেই শোভনা নিজের অন্তরের আলোয় জীবনের পুথির পাতায় নিজের জন্য নতুন গল্প খুঁজে পেলো। কিন্তু স্বর্ণকুমারীর মতো গল্প লিখে উঠতে পারলেন না শোভনা। তিনি শুরু করলেন হারিয়ে যাওয়া রূপকথা, উপকথা সংগ্রহের কাজ। এই কাজটি শুরু করেছিলেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে।

তারপর ঠাকুরবাড়ির এই মেয়েটি নতুন উদ্যমে শুরু করলেন হারিয়ে যাওয়া রূপকথা উপকথার কাজ! তবে গ্রামবাংলার রূপকথা নয়। তিনি রাজস্থানের প্রাচীন সব উপকথা সংগ্রহ করে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করলেন। তখন স্বামীর কর্মসূত্রে তিনি জয়পুরে। সম্পূর্ণ অন্যরকম প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত হল শোভনার গল্প—ফুলচাঁদ, ডালিমকুমারী, গঙ্গাদেব, লুব্ধবণিক তেজারাম, দিলীপ ও ভীমরাজ ইত্যাদি সব উপকথা কেন্দ্রিক গল্প। জয়পুরী প্রবাদও সংগ্রহ করেছিলেন শোভনা।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৫: মা সারদার ভ্রাতৃবিয়োগ

বিশ শতকে পণ্ডিত মহলে প্রবাদ সংগ্রহের একটি প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। শোভনা ভিন্ন এলাকার প্রবাদের ঐতিহাসিক পটভূমি, অর্থ, বাংলায় অনুবাদ ইত্যাদি কাজে মগ্ন হয়েছিলেন। ‘কাল কি জয়োড়ী গধেড়ী, পরসো কী গীত গাবে’, শীতলা কুনসা ঘোড়া দে, আপ হী গধা চড়ে’! এছাড়াও জয়পুরি ঘরোয়া শিল্পকে নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন শোভনা। ছেঁড়া কাগজ দিয়ে তৈরি যা শিল্প, তাকে বলে ডোমলা শিল্প! সেই ডোমলা শিল্পের কাজেও নিজের মতো করে মগ্ন হয়েছিলেন শোভনা। এরপর তিনি বাংলা ভাষা ছেড়ে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন।

শোভনাসুন্দরী স্বর্ণকুমারীর ‘কাহাকে’ উপন্যাসটির অনুবাদ করেছিলেন ‘টু হুম’ নামে। লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানির থেকে তাঁর চারটে বই প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্যও লিখেছিলেন শোভনা। ‘ইন্ডিয়ান নেচার মিথস’, ‘ইন্ডিয়ান ফেবেলস অ্যান্ড ফোকলোর’, ‘দ্য ওরিয়েন্টাল পার্লস’, ইত্যাদি বই সাহিত্যের সম্পদ। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে ইংরেজিতে লেখার এই যে প্রবণতা, শোভনাসুন্দরী তার অন্যতম পথিকৃৎ।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

প্রতি মানুষ এই জীবনে কিছু কাজের ভার নিয়ে আসে। সময় তাকে সেই কাজের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যায়। শোভনার কাজ ছিল রূপকথা উপকথাকে বিস্মৃতির অতল থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা। সেই দিক থেকে তাঁকে লালবিহারী দে, রামসত্য মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র বসু, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ডিএন নিয়োগীর ঘরানার এক সাহিত্যিক বলা যায়। শোভনার রূপকথা, দেবকথার সংগ্রহ নেহাত কম ছিল না। শেষজীবনে ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা লেখাও লিখেছেন। বিদেশ সফর সেরে কয়েকটি মূল্যবান ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি। ‘ইউরোপে মহাসমরের পরে’, ‘লন্ডনে’, ‘রণক্ষেত্রে বঙ্গমহিলা’, ‘মহাযুদ্ধের পর প্যারিনগরীতে’, ইত্যাদি লেখা অনেক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এত কর্মকাণ্ডের পরেও হাওড়ার হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে গভীর কৃতিত্ব রেখে যান। এছাড়াও ‘বাণী নিকেতন’ নামে একটি গানের প্রতিষ্ঠানে গান শেখাতেন। এই বিপুল কাজের গতি স্তব্ধ হয় হঠাৎ করেই। মৃত্যু এসে যতি চিহ্ণ এঁকে দেয় তাঁর জীবনে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন তাঁর মৃত্যুতে শোকার্ত হয়ে। হাওড়ার শিবপুর শ্মশানে আজও শোভনার জন্য রবি ঠাকুরের লেখা কবিতার শব্দগুলি জ্বল জ্বল করে শোভনার বর্ণময় জীবনের মতো—
অস্তরবির কিরণে তব
জীবন শতদল
মুদিল তার আঁখি
মরমে যাহা ব্যাপ্ত ছিল
স্নিগ্ধ পরিমল
মরণে দিল ঢাকি।
লয়ে গেল সে বিদায়কালে
মোদের আঁখিজল
মাধুরীসুধা সাথে,
নূতনলোকে শোভনারূপ
জাগিবে উজ্জ্বল
বিমল নবপ্রাতে!


শিবপুর শ্মশানের পাশ দিয়ে যখনই যাই মনে হয় এক বুদ্ধিমতী লেখক জীবনের অনেক পথ পার হয়ে এইখানে শান্তিতে নিদ্রামগ্ন! অদূরে কোথাও অপেক্ষারত তাঁর লীলাকমল।

তথ্যসূত্র
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content