শান্তা দেবী।
চলুন সময়ের চাকা উল্টোমুখে ঘুরিয়ে যাওয়া যাক উনিশ শতকে। এলাহাবাদ শহর, মায়ের কাছে পৌরাণিক গল্প শুনছে দুটি বোন— শান্তা আর সীতা! গল্প শুনতে শুনতে মনের মধ্যে গল্প বলার ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে একটু একটু করে। শুধু মা নয়, মাস্টারমশাই নেপালচন্দ্র রায় শোনাতেন বিদেশি লেখকদের গল্প। আসলে এলাহাবাদে তখন মেয়েদের পড়ার মতো ভালো স্কুল ছিল না। তাই বাবা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক, তাঁর দুই বন্ধুর কাছেই লেখাপড়া করতেন শান্তা দেবীরা। যাক, আসল কথায় আসি। শান্তা দেবীর জন্ম হয় ১৮৯৩ সালের ২৯ এপ্রিল।
শান্তা দেবী সেই সময়কার বেশ বিখ্যাত লেখক। তিনি আর তাঁর বোন সীতাদেবী লেখালিখি করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। শান্তাদেবী ছোটবেলায় এলাহাবাদে থাকতেন। তিনি ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্ম তাঁরাই ছিলেন, যাঁরা একজন নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, পুতুল পুজোয় ভরসা করতেন না। অনেক খোলা মনে ব্রাহ্ম অভিভাবকরা সন্তানদের বড় করতেন। শান্তা দেবী জীবনে এই সুযোগটা পেয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে বেথুন স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন। বেথুন কলেজ থেকে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন বিএ পরীক্ষায়। শান্তা দেবী পদ্মাবতী স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। বহুভাষাবিদ ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায়, এছাড়াও অর্থনীতি আর অঙ্কে পারদর্শী ছিলেন।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৭: আশাপূর্ণা দেবী—স্বপ্ন আর সত্যির লেখক!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
শান্তা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৩ সাল নাগাদ। এলাহাবাদে থাকলেও মাঝে মাঝে পৈত্রিক বাড়ি বাঁকুড়াতে আসতেন। ফলে বাংলা সাহিত্যচর্চা ভালো ভাবেই করতেন তাঁরা। তাছাড়া প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদকের মেয়েরা বাংলা সাহিত্যচর্চা করবেনই একথা বলাই বাহুল্য। রামানন্দ নিজে নারী প্রগতির পক্ষে ছিলেন। কাজেই দুই মেয়েকেই তৈরি করেছিলেন মনের মতো করে। তারপর ১৯০৮ সালে তাঁরা পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন বেথুন স্কুল ও কলেজের নতুন জীবন! শান্তা দেবী লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন। বাবার সূত্রে অনেক পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। ফলে সাহিত্যিক জীবন আরও সমৃদ্ধ হয়।
আরও পড়ুন:
বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম
খুব অল্প বয়সে ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনা, ব্রিটিশ শাসন, বাঙালি জীবনের উত্থান, পতন— সবটাই লক্ষ করেছিলেন তাঁরা। রাখিবন্ধনের দিন শান্তা দেবীর পরিবার অরন্ধন পালন করত। শান্তাদেবী এত গুণীজনের সংস্পর্শে থাকলেও নিজের স্বকীয়তা হারাননি। লেখায় সেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট। শান্তা দেবীর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘সুনন্দা’! শান্তা দেবী আর তাঁর বোন দুজনে মিলে শ্রীশচন্দ্র বসুর ‘ফোকটেলস অফ হিন্দুস্থান’ এর অনুবাদ করেন ‘হিন্দুস্থানী উপকথা’ নামে। বইয়ের ছবিগুলি এঁকেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। শান্তাদেবী ‘সংযুক্তাদেবী’ ছদ্মনামে একটি উপন্যাস লেখেন। উপন্যাসের নাম— ‘উদ্যানলতা’! সে সময়ের নারী স্বাধীনতার ছবি উপন্যাসে স্পষ্ট। উপন্যাসটি ‘দ্য গার্ডেন ক্রিপার’ নামে পরে অনুবাদ করা হয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে শান্তা দেবীর গল্পসংকলন ‘টেলস অফ বেঙ্গল’ প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১৭: শোকস্তব্ধ কবি সারারাত ছাদে পায়চারি করেছিলেন
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা
শান্তিনিকেতনে দু’ বছর থেকে নন্দলাল বসুর কাছে আঁকা শিখেছিলেন। দেশ বিদেশে আঁকা প্রশংসিত হয়েছে তাঁর। এরপর শান্তাদেবীর বিবাহ হয় বিখ্যাত ঐতিহাসিক কালিদাস নাগের সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে দেশ-বিদেশে ঘুরে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন, তার প্রতিফলন ঘটল লেখায়। মহেঞ্জোদড়োর কথা, জাপানের ডায়েরি ইত্যাদি ভ্রমণকাহিনি লিখেছিলেন। আমেরিকা থাকার সময় তিনি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর অবদান মনে রাখার মতো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক লাভ করেন ‘ভারতের মুক্তিসাধক রামানন্দ ও অর্ধশতাব্দীর বাংলা’ বইটির জন্য। অনেক লেখা লিখেছিলেন—জীবনদোলা, চিরন্তনী, দুহিতা,অলখঝোরা, উষসী, সিঁথির সিঁদুর, বধূবরণ, দেয়ালের আড়াল, পঞ্চদশী ইত্যাদি। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি লিখেছিলেন শোক ও সান্ত্বনা, এছাড়াও পূর্বস্মৃতি। ছোটদের জন্যও লিখেছিলেন তিনি। সাতরাজার ধন, হুক্কাহুয়া, কেমন জব্দ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৪: রাজসহায়ে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের, রাজারই প্রয়োজনে বিপদের মুখে পড়তে হয়
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়
শান্তাদেবীর লেখা যে একেবারে ত্রুটিহীন ছিল, সেকথা বলব না। কিন্তু সেই সময় দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলার সৎসাহস খুব কম মেয়েরই ছিল। গল্প উপন্যাসের চরিত্রের অন্তরালে শান্তাদেবীর নিজের স্বর শুনতে পাওয়া যায়। বিস্মিত হতে হয় শান্তা দেবীর গল্পের চরিত্র যখন অভিভাবককে বলেন, বিবাহের জন্য তিনিলেখাপড়া শেখেননি। পরকীয়া সম্পর্ক ও তার জেরে প্রায়শ্চিত্ত নয়, আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় চরিত্র। ফিরিঙ্গি মহিলার বাৎসল্য এবং প্রয়োজনে উগ্রচণ্ডা মূর্তির ছবি— অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাল্যবিবাহ, বৈধব্য —এইসব সমস্যা এসেছে শান্তা দেবীর লেখায়। আসলে একটি মেয়ের সমস্যার কথা একজন মহিলা লেখকই পারেন। শান্তা দেবী সেই কাজটিই করেছেন। আশাপূর্ণা দেবীর ভাষায় তাঁকে আমরা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার বলতেই পারি।
সহায়ক বই
● পূর্বস্মৃতি, শান্তা নাগ
● শান্তাদেবী ও সীতা দেবী,সুশীলকুমার গুপ্ত
সহায়ক বই
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত এবং পরীক্ষায় আসবে না তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।