গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী।
একটি মেয়ে এবং একটি পত্রিকা! ঠিক এই জায়গা থেকে শুরু হোক আজকের গল্প। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কথা বলি। সেই সময়কার এক মহিলা কবি! ভারতী পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সূত্রে ভারতী পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হয়। কঠিনে কোমলে সেই পত্রবিনিময় গিরিন্দ্রমৌহিনীর মতো নবীন লেখকের কলমকে জোরালো করেছে বারবার। সেকালে ‘ভারতী’-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা গুলিতে ‘ঠাকুরি’ ভাষার প্রভাব ছিল। আসলে ভারতী পত্রিকার আড়ালে ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। তবে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কবি হিসেবে কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি শুধুমাত্র নিজের লেখাকে ‘ঠাকুরি ভাষা’র ঘেরাটোপে আবদ্ধ রাখলেন না। নিজের মতো নিজস্ব ভাষা তৈরি করলেন।
এই প্রসঙ্গে স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছিলেন, ‘রুচি বৈচিত্র্য যেমন চিরদিন বিদ্যমান থাকিবে, তাহা দোষের নহে, সৃষ্টি বৈচিত্র্যও তেমনি, তাহাও উপেক্ষার নয়। সত্য বলতে কি আমার ‘গদগদনদেগাদাবরী বারয়োঃ’ যেমন ভালো লাগে, আবার ঠাকুমার মুখে শ্রুত ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে নদী এল বান’ ইহাও তেমনি ভালো লাগে, আবার চাষা বৌয়ের মুখে ‘ঝরোকায় গলা বেড়িয়ে ডেঁড়িয়ে ছ্যালো’ এও তেমনি মিষ্ট লাগে। মূল কথা যেখানে যেমন, সেখানে তেমনটি হইলেই শোভন সুন্দর হয়।’ তখন ভারতীর সম্পাদক ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর শ্বশুরবাড়ি অত্যন্ত পুরনোপন্থী হলেও তাঁর স্বামী তাঁকে লিখতে বলতেন। প্রায়ই অরু দত্ত, তরু দত্তের লেখক প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করতেন গিরীন্দ্রমোহিনীর স্বামী। গিরীন্দ্রমোহিনীর বাবাও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। জীবনের দুই উল্লেখযোগ্য পুরুষের উৎসাহ পুরুষতান্ত্রিক সময়ে গিরীন্দ্রমোহিনীকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল।
গিরীন্দ্রমোহিনী তাঁর স্বামীর কাছে ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন। সেই সময় গিরীন্দ্রমোহিনী লিখলেন, ‘কবিতা হার’ আর ‘ভারতকুসুম’। বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্র উভয়েই পড়েছিলেন। সংস্কৃত মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে জ্যোতিষের পুথি কেড়ে রেখে দিতেন। মাস্টার মশাই মজা করে বলতেন, খনার পুনর্জন্ম হয়েছে। সংস্কৃত মাস্টারমশাইয়ের মত ছিল, মেয়েরা জ্যোতিষচর্চা করলে নির্বংশ হয়। গিরীন্দ্রমোহিনীর মতামত এই প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ—‘…আশ্চর্য্যের কথা, তিনি বহুপুত্রক হইয়াও পরে নিঃসন্তান হইয়াছিলেন।’ সেই সময় দাঁড়িয়ে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর এই মন্তব্য বেশ সাহসী।
গিরীন্দ্রমোহিনী তাঁর স্বামীর কাছে ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন। সেই সময় গিরীন্দ্রমোহিনী লিখলেন, ‘কবিতা হার’ আর ‘ভারতকুসুম’। বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্র উভয়েই পড়েছিলেন। সংস্কৃত মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে জ্যোতিষের পুথি কেড়ে রেখে দিতেন। মাস্টার মশাই মজা করে বলতেন, খনার পুনর্জন্ম হয়েছে। সংস্কৃত মাস্টারমশাইয়ের মত ছিল, মেয়েরা জ্যোতিষচর্চা করলে নির্বংশ হয়। গিরীন্দ্রমোহিনীর মতামত এই প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ—‘…আশ্চর্য্যের কথা, তিনি বহুপুত্রক হইয়াও পরে নিঃসন্তান হইয়াছিলেন।’ সেই সময় দাঁড়িয়ে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর এই মন্তব্য বেশ সাহসী।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু
সখীসমিতি এবং মহিলা সমাজ গড়ে উঠছে তখন। সেই সূত্রে স্বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর আলাপ। নিয়মিত পত্রবিনিময় চলত তাঁদের। পুরুষরা যতটুকু চাইতেন মেয়েদের শিক্ষা যে ঠিক ততটুকুই এগিয়ে যেতে পারতেন। এই ছিল তখনকার দিনের মহিলা লেখকদের সাহিত্যচর্চার পরিস্থিতি। তবে গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী এমন এক জোরালো মহিলা গোষ্ঠীর মধ্যে এসে পড়তে পেরেছিলেন। এইটি ছিল সেইসময়কার মহিলা লেখকদের জন্য সবচেয়ে আশার কথা।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?
বেথুন স্কুলের শিল্পমেলায় রবি ঠাকুরের ‘মায়ার খেলা’ অভিনয় হয়। সেই সময় মেয়েরা চিকের আড়ালে বসে বিনোদন আমোদ প্রমোদের অংশ হতেন। এই প্রথম পুরুষদের মতো গ্যালারিতে বসে নাটক দেখার আনন্দ অনুভব করেছিলেন মেয়েরা। গিরিন্দ্রমোহিনীও এই প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী মেয়েদের দলেই ছিলেন। আজকের মহিলা লেখকরা যেকারণে নিশ্চিন্তে লিখতে পারছেন। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?
স্বর্ণকুমারী আর গিরীন্দ্রমোহিনী সই পাতিয়েছিলেন। পরস্পরকে ‘মিলন’ বলে ডাকতেন। দু’ জনে লেখাপড়া নিয়ে চর্চা করতেন। কবিতায় পত্র বিনিময় করতেন। পুরুষদের মধ্যে এমন কালচারাল বন্ধুত্ব দেখাই যেত। কিন্তু গিরিন্দ্রমোহিনী এমন একটি বন্ধুত্বের সৃচনা করতে পেরেছিলেন উনিশ শতকের প্রবল কঠিন রুদ্ধ সময়। গিরীন্দ্রমোহিনীর লেখা চিঠি এবং লেখাগুলি ‘জনৈক হিন্দুমহিলার পত্রাবলী’ এবং ‘জনৈক হিন্দু মহিলা প্রণীত’ বলে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তাঁর নাম সকলেই জানে।
গিরীন্দ্রমোহিনী শুধু লিখতেন না, ছবিও আঁকতেন। তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। কবিতার হার, ভারত কুসুম, আভাস, অর্ঘ্য, স্বামীর প্রেম ইত্যাদি লেখা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে। এগুলির ঊর্ধ্বে আজ রইল গিরীন্দ্রমোহিনীর সংগঠনী প্রতিভার গল্প, স্বামী এবং বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর কমপ্যানিয়নশিপের কাহিনি।
গিরীন্দ্রমোহিনী শুধু লিখতেন না, ছবিও আঁকতেন। তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। কবিতার হার, ভারত কুসুম, আভাস, অর্ঘ্য, স্বামীর প্রেম ইত্যাদি লেখা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে। এগুলির ঊর্ধ্বে আজ রইল গিরীন্দ্রমোহিনীর সংগঠনী প্রতিভার গল্প, স্বামী এবং বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর কমপ্যানিয়নশিপের কাহিনি।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।